আওয়ামী লীগ থেকে কেন দূরে সরে যাচ্ছে তরুণরা?
রবিন আকরাম : আমার ফেসবুকের তিনজন বন্ধুর পর পর তিনটি লেখা বেশ ভালো রকমের এলার্মিং। এরা বয়সে সবাই তরুন এবং ভোটার।
প্রথম লেখাটিতে লেখক বলছেন ২০০৮ সালে আওয়ামীলীগকে ভোট দিয়ে তিনি বড় ভুল করেছেন এবং এটির জন্য তিনি লজ্জিত, দ্বিতীয় লেখায় লেখিকা বলেছেন এইভাবে শিক্ষার্থীদের উপর আক্রমণ করে কিংবা তাদের জামাত-শিবির বানিয়ে দিয়ে কি ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব? তৃতীয়জন বলছেন, আপনারা গণহারে এই প্রজন্মকে আওয়ামী বিদ্বেষী বানিয়ে দিয়েছেন।
এই লেখকদের প্রত্যেকটি কথাই অত্যন্ত যৌক্তিক এবং আমি কিছুটা উদ্বেগ নিয়েই লিখছি এই লেখা।
শাহবাগ আন্দোলন, কোটা সংষ্কার আন্দোলন এবং এই কিশোর বিদ্রোহ এই তিনটি তাৎপর্যপূর্ণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামীলীগ একটা প্রজন্মকে বেশ ভালো করেই দূরে ঠেলে দিয়েছে।
বিশেষ করে কোট সংষ্কার ও কিশোর বিদ্রোহ আন্দোলনের ছেলে-মেয়েগুলো আগামীদিনের ভোটার এবং আগামী দিনের এই দেশের চালক। এই অংশটিকে আওয়ামীলীগের চরমতম ভক্ত বানাতে না পারার যে দায় ও পরিণামে সেটির ফলাফল, তার পুরোটাই আওয়ামীলীগকে নিতে হবে।
আওয়ামীলীগের যারা তরুন অংশ রয়েছে যেমন শেখ রেহানা পূত্র ববি কিংবা তার সি আর আই টিম, সজীব ওয়াজেদ জয়, মন্ত্রী পলক কিংবা শাহরিয়ার সাহেব তাঁরা কেউই কিন্তু এই প্রজন্মটিকে কাছে টেনে নিতে পারেননি।
এই অংশ বাদ দিয়েও ছাত্রলীগের যে শিক্ষিত অংশটি রয়েছে তারাও কি পেরেছে এই তরুনদের নিজের করে নিতে? তারাও কি পেরেছে এই ছেলেগুলোকে বুকে টেনে নিয়ে এই আন্দলোনগুলোকে সমাপ্ত করতে?
এই প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, “না পারেনি”
এই যে আওয়ামীলীগ পারলো না, এই যে সামগ্রিকভাবে ব্যর্থ হোলো একটি দল সেটির দায় উত্তর প্রজন্মে ও সময়ে কিন্তু আওয়ামীলীগকেই টানতে হবে।
খন্দকার মোশতাক, জিয়া কিংবা এরশাদ সময়কালীন তৎকালীন কিশোর-তরুনরা কিন্তু আজও আওয়ামীলীগকে ঘৃণা করে। কেননা ইতিহাসের ভুল পঠন, ব্রেন ওয়াশ সেই আমলে এমন করে করা হয়েছে যে ঐ প্রজন্মটি কিন্তু আওয়ামীলীগ সম্পর্কে একটা দুঃস্বপ্নময় ধারনা নিয়ে বড় হয়েছে।
৯৬ সাল কেন্দ্রিক একটা সময় গিয়েছে যখন সে সময়ের একটা প্রজন্ম আবার আওয়ামীভক্ত হয়েছে, বঙ্গবন্ধুকে ধারন করতে শিখেছিলো। আর শিখেছিলো বলেই ২০০৮ সালে ঐ ৯৬ প্রজন্মই ২০০৮ সালে আওয়ামীলীগকে ভোট দিয়ে মসনদে বসিয়েছিলো তুমুল আশা নিয়ে।
কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে আওয়ামীলীগ এই গত ১০ টি বছর ক্ষমতায় থেকে যেন থোরাই কেয়ার করছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে।
একটি দলকে তাদের ভোটার পাইপলাইন ক্রমাগত ঠিক রাখতে হয়। যেমনটা আমাদের ক্রিকেটার তৈরীর পাইপলাইন আছে বলেই একজন ফেইল করলে আরেকজনকে দ্রুত পেয়ে যাই।
এই যে এই প্রজন্মকে এমন আওয়ামী স্বরূপ দেখানো হচ্ছে, এতে করে কি দু’ পয়সার লাভ হয়েছে আওয়ামীলীগের? এতে করে কি একটি ভোটারও বেড়েছে আওয়ামীলীগের?
উত্তরে আমি বলব, ভোটার বাড়া তো দূরের কথা বরং ক্রমাগত ঘৃণা বাড়ছে। ক্রমাগত এই দলটির প্রতি তরুনদের দূরত্ব বাড়ছে। লক্ষ্য করলে দেখবেন এই তরুনদের মধ্যে ৯৫ পার্সেন্ট বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসে। প্রশ্ন আসতেই পারে যে বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসলে আওয়ামীলীগকে কেন ধারন করতে পারছে না তরুনেরা?
এর উত্তর হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুকে তারা এই দলটি থেকে আলাদা করে ফেলেছে। তারা বুঝে গেছে এবং শিখে ফেলেছে জাতির পিতাকে এই আওয়ামী দায়ের বাইরে রাখতে হবে।
কিন্তু এমন কি হবার কথা ছিলো? একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখবেন কি?
কথাতো এমন ছিলোনা। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা পড়া শেষ করে তরুনেরা যখন বের হয় তখন দেখে আওয়ামী লুটপাট আর সন্ত্রাস। যখন তারা শুধু চারিদিকে দেখে আওয়ামী মিথ্যে, আওয়ামী প্রোপাগান্ডা আর অত্যাচার, তাহলে কি করে তারা আর এই দলকে বিশ্বাস করবে? এই দলকে ভালোবাসবে?
আপনাদের কি ধারনা মুজিব কোট পরে দৌড়াদুড়ি করলেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারন করা যায়? বঙ্গবন্ধুর কোট পরে আপনারা যা করছেন, আপনাদের দেখে মনে হচ্ছে অনেকগুলো পেঙ্গুইন অথর্বের মত শহর জুড়ে প্যাঁ প্যাঁ করছেন আর ঝামেলা তৈরী করছেন।
যেই ছেলে মনে প্রাণে ডানপন্থা ঘৃণা করে, মনে প্রাণে জামাত কিংবা স্বাধীনতাবিরোধীদের ঘৃণা করে সেই ছেলেটিকে আপনি এক তুড়িতেই বানিয়ে দিচ্ছেন জামাত শিবির। সেই ছেলে আপনাকে কি করে শ্রদ্ধা করবে?
যে তরুন আর তরুনী বঙ্গবন্ধুকে পাঠ্য বইয়ে পড়ে নিজেকে বঙ্গবন্ধুর মত প্রতিবাদী ভেবে নিচ্ছে, আপনি সেই প্রতিবাদের তেজ সহ্য করতে পারছেন না। আপনি কেমন আওয়ামীলীগার হে? আপনি কেমন আওয়ামীলীগার যে মুড়ি আর মুরকির মত সবাইকে জামাত-শিবির বানাচ্ছেন? আপনি কোন দেশের তালেবর, বলুন তো?
যেই ছেলে চোখ আর কান খুল্লেই দেখতে পাচ্ছে শত শত জামাতের ছেলে পেলে এখন আওয়ামীলীগে ঢুকে পদ বাগিয়ে নিয়েছে আবার সেই লীগ-ই যখন সেই তরুনকে জামাত বলছে তখন সে ক্রোধে উন্মক্ত হবেই।
ফলে এই যে এই সময়ের তরুনেরা এসব লিখছে, বলছে আর আওয়ামীলীগ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তার প্রতিটি দায় আওয়ামীলীগের।
শুধু আওয়ামীলীগ একা এই দায়ের ফলে সাফার করলে কিছু বলতাম না। সাফার করবে পুরো দেশ।
মনে নেই? আহমদ ছফা বলে গিয়েছিলো, আওয়ামীলীগ জিতলে সে জয় একা আওয়ামীলীগের আর হারলে পুরো দেশকে নিয়ে সে হারে।
যারা ভেবে দেখার মত অবস্থায় রয়েছেন, তাঁরা আমার এই কথাগুলো ভেবে দেখবেন। এই আশা করি।
(লেখক ও ব্লগার নিঝুম মজুমদার এর ফেসবুক থেকে নেয়া)