অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে স্বদেশ!!-মাহফুজুর রহমান
এ যেনো তুঘলকি কান্ড ! আইইউসিতে রোগীকে ঘিরে রাখার পর্দার দাম ৩৭ লাখ টাকা। ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা মূল্যের একটি হেডকার্ডিয়াক স্টেথিসকোপের দাম দেখানো হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ ধরণের ১১৬টি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৪১ কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার টাকার অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে হাইকোর্ট। ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে এমন রগরগে দূর্নীতির ঘটনা ঘটে। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠে ২০১৪ সালে। তদন্ত শেষে রিপোর্ট দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছে আদালত। তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। তবে দুদক বলছে তারা এখনো আদেশনামা পায়নি।
দেশের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে এটি একটি মামুলি দূর্নীতি মাত্র। ২০১৬ সালের ০৫ ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ফান্ডের ৮১০ কোটি টাকা, শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারি, হলমার্ক, ডেস্টেনি, প্রায় প্রতিটি সরকারি বেসরকারি ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটের সাথে তুলনা করলে ৪১ কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার টাকার দূর্নীতিকে মামুলিই বলতে হবে। দূর্নীতি এখন দেশে একটি সাধারণ বিষয়ে পরিনত হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা দূর্নীতির মাধ্যমে ধনী থেকে আরো ধনীতে পরিনত হচ্ছে। আর দেশের সাধারণ জনগণ সর্বক্ষেত্রেই উপেক্ষিত হচ্ছে ।
উন্নয়নের নানা গালগল্প শোনা গেলেও উন্নয়নের সুবাতাস দেশের সাধারণ জনগণকে স্পর্শ করে না। সাধারণ জনগণের জীবনেরই যেখানে নিরাপত্তা নেই। সেখানে জীবন মানের উন্নয়ন, রূপকথার গল্পের মতো। পদ্মা সেতু, ফ্লাইওভার সহ যোগাযোগ খাতে নানা উন্নয়নের কথা শোনা গেলেও, বাস্তবে এই সব উন্ন্য়ন দেশের জনগণের জীবনমানের উন্নয়নের কাজে আসছে না। এই সব বড় বড় স্থাপনা নির্মাণের আড়ালে দূর্ণীতির মহোৎসব চলছে। চীন, ভারত, মালয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়া এমনকি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বড় আকারের সেতু নির্মানে যেখানে ব্যয় হয় কিলোমিটার প্রতি ৪০০-৬০০ কোটি টাকা। সেখানে বাংলাদেশে সেতু নির্মানে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় হয় ৩ হাজার কোটি টাকা। যদিও বাংলাদেশে জমির দাম এবং শ্রমীকের মজুরী তুলনামূলক ভাবে অনেক কম। মহাসড়ক নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি গড় ব্যয় হয় ইউরোপে ২৯ কোটি, ভারতে ১০ কোটি, চীনে ১০ কোটি। আর বাংলাদেশে ৫৪ কোটি। রেলপথ নির্মাণেও বাংলাদেশে ব্যয় সর্বোচ্চ। রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি চীনে ব্যয় হয় ১২.৫ কোটি টাকা, ভারতে ১২ কোটি টাকা। বিশ্বের আদর্শ রেলপথ নির্মাণ ব্যয় কিলোমিটার প্রতি ২৩-৩১ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশে রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি ব্যয়, ঢাকা-পায়রা রেলপথ ২৫০ কোটি টাকা, ঢাকা- যশোর রেল সংযোগ ২০৩ কোটি টাকা। সড়ক অবকাঠামো মানের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১০৯তম।
উপরন্তু এই সব অপরিকল্পিত মেগা প্রজেক্ট দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার কার্যকর উন্নয়ন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। সড়ক, মহাসড়ক, ফ্লাইওভার ও সেতু নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য জীবনের নিরাপত্তা সহ নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা হলেও। বাংলাদেশে সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যুর হার অনেক বেশী। শুধুমাত্র ঈদুল আযহার যাত্রায় ২৪৪টি সড়ক দূর্ঘটনায় ২৫৩ জন নিহত এবং ৯০৮ জন আহত হয়েছেন। ২০১৯ সালের ১৮ আগস্ট ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি এই তথ্য জানিয়েছে। আর ঈদুল ফিতরের ছুটিতে সারাদেশে সড়ক দূর্ঘটনায় ১৪২ জন নিহত ও ৩২৪ জন আহত হয়েছিলেন। ২০১৯ সালের ১০ জুন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এই তথ্য দেয়া হয়েছে। ২০১৮ সালে দূর্ঘটনায় দেশে ৭ হাজার ৭৯৬ জন নিহত হয়েছিলো। প্রতিবছরই দূর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কিন্তু সরকার নির্বিকার। ২০১৮ সালে ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত স্কুল শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়ক আন্দোলন করে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশ, র্যাব, ছাত্রলীগ, যুবলীগের হামলায় ২১৭ জন আহত ০৩ জন নিহত হয় এবং কয়েকশত শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবায়ন করেনি একটিও। বার বার ঘাতক চালকদের পক্ষই নিয়েছে সরকার । প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রীরা দুর্ঘটনায় মৃত্যুর জন্য সাধারণ জনগণকেই দায়ি করেছে। যত দোষ যেনো সাধারণ জনগণেরই।
দুর্ঘটনায় মরে, ডেঙ্গুতে মরে, গুম, খুন সহ সব মৃত্যুর জন্য দায়ি যেনো তারা নিজেরাই। সরকারের যেনো কিছুই করার নেই। নেই কোন দায় দায়িত্ব। সাধারণ জনগণের সুচিকিৎসা নিশ্চিত না হলেও প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাজ্যে তার কথিত চোখের চিকিৎসার জন্য গত কয়েক মাস যাবৎ প্রায় প্রতিমাসেই সফর করছেন। এতে ব্যয় করছেন শত শত কোটি টাকা। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসার বিষয়ে কোন কিছুই স্পষ্ট করে বলা হচ্ছে না।
শুধু তাই নয় জাতীয় গুরুত্বপূর্ন বিষয় গুলোতেও বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের অবস্থান দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট নয়। খুলনা থেকে সিলেট পর্যন্ত জমি ভারতকে ছেড়ে দেয়ার দাবি করেছেন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) অন্যতম শীর্ষ নেতা সুব্রামানিয়াম স্বামী। ২০১৯ সালের ১৮ আগস্ট আসামের শীলচর থেকে প্রকাশিত বাংলা দৈনিক “সাময়িক প্রসঙ্গ” নামের একটি বাংলা পত্রিকার প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে। পত্রিকাটি জানিয়েছে ২০১৯ সালের ১৭ আগস্ট গোহাটীতে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে সুব্রামানিয়াম বলেন “ খুলনা থেকে সিলেট পর্যন্ত সমান্তরাল রেখা টেনে এই অংশ ভারতকে ছেড়ে দিতে হবে বাংলাদেশকে”। সুব্রামানিয়ান স্বামীর এই অযৌক্তিক দাবির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। এমনকি মুক্তিযুদ্ধকে পুঁজি করে রাজনীতি করা আওয়ামী লীগের কোন নেতাও এ নিয়ে কোন বক্তব্য মন্তব্য করেনি। এটিই প্রথম নয় ২০১৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আগরতলার ত্রিপুরা সরকারি অতিথিশালায় সংবাদ সম্মেলনে এই সুব্রামানিয়ম স্বামী বাংলাদেশ দখল করার হুমকী দিয়েছিলেন। সেই সাথে তিনি বলেছিলেন শেখ হাসিনার প্রতি ভারতের সমর্থন আছে।
সম্প্রতি আগরতলা বিমানবন্দর সম্প্রসারণের জন্য বাংলাদেশের কাছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কিছু ভূমি প্রয়োজন বলে দাবি জানিয়েছে ভারত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ২০১৯ সালের ২৯ জুলাই “নিউ এজ” পত্রিকাকে নিশ্চিত করে বলেন, ভারতের কাছ থেকে এ ধরনের একটি প্রস্তাব এসেছে। আর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানিয়েছেন, বাংলাদেশ অংশ ভারত আগরতলা বিমানবন্দরের কিছু লাইট বসাতে চেয়েছে মাত্র। উল্লেখ্য আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ভারতের দাবি অনুযায়ী ট্রানজিট ও ট্রেন্সশিপমেন্ট সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু বিনিময়ে বাংলাদেশ আজ পর্যন্ত কোন সুবিধা ভারতের কাছ থেকে আদায় করতে পারেনি। বাংলাদেশ এবং নেপালের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ৭ বিঘা জমি (৭ বিঘা করিডোর) প্রায় কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ আজ পর্যন্ত বাংলাদেশকে তা দেয়নি। এই ৭ বিঘা করিডোর ভারত দিলে, বাংলাদেশ এবং নেপালের মধ্যে ব্যবসায়িক সহ সব ধরনের যোগাযোগ বৃদ্ধি পেতো এবং দুই দেশই লাভবান হতো। নেপাল বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করতে পারতো। বাংলাদেশ শুল্ক পেতো।
বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার যতই ভারত বাংলাদেশ বন্ধুত্বের কথা বলুক না কেনো। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে, ভারত কিন্তু বন্ধুত্বের প্রমাণ দেয় না। গত দশ বছরে ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) প্রায় ১ হাজারেও অধিক বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। যা পাকিস্তান-ভারত এমনকি ইসরাইল-ফিলিস্তিন সীমান্তে হত্যার চেয়ে অনেক বেশী। সীমান্তে বাংলাদেশীদের হত্যা নিয়ে সরকারকে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায় না। এমনকি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর কোন তৎপরতা দেখা যায় না। অস্ত্র হাতে সীমান্তে বিজিবি যেনো কাঠের পুতুল। সীমান্তে বিজিবি কেনো নিষ্কৃয় ? কেনোই বা সরকারের এই নিষ্কৃয়তা ? আওয়ামী লীগ সরকার এবং ভারতের মধ্যে কি কোন চুক্তি রয়েছে ? যার কারণে বাংলাদেশ সরকার নির্দ্বিধায় ভারতের সব আবদার মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ সরকারের এই নিষ্কৃয়তা এবং অস্পষ্টতা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করছে। বিপন্ন হচ্ছে রাষ্ট্র। অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে ধাবিত হচ্ছে বাংলাদেশ।