ঈদে মিলাদুন্নবী (সা:)-এর তাৎপর্য >> মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক
আরবি মাসগুলোর মধ্যে একটি মাস রবিউল আউয়াল। এই মাসে সমুজ্জ্বল সূর্য ও রিসালাতের চমকিত চন্দ্র রাসুল (সা:) উদিত হয়ে স্বীয় আলোক রশ্মি দ্বারা সমগ্র বিশ্বকে আলোকিত করেছেন। মর্যাদা পূর্ণ বারোই রবিউল আউয়াল মাসে সোমবার দিবা-রাত্রির মিলন সন্ধিক্ষণে সুবহে সাদিকে পৃথিবীর বুকে আগমন করেন মানবতার মুক্তির দিশারি পিয়ারা নবী রাসুল (সা:)। রাসুল (সা:) হলেন ইব্রাহিম (আ:)-এর দু’আ ও ঈসা (আ:)-এর সুসংবাদের বরকত স্বরুপ পিতা আব্দুল্লাহ ও মাতা আমেনা কোল জুড়ে পৃথিবীর বুকে প্রকাশিত হয়েছিলেন। পৃথিবীতে তাঁর আবির্ভাবের সাথে সাথে কুফর এবং পথভ্রষ্টতার রাশি রাশি অন্ধকার অদৃশ্য হয়ে গেল, সৃষ্টিজগতের প্রতিটি অংশ আলোয় আলোকিত এবং বিশ্বের ঘুমন্ত শক্তিতে জাগরণ এসে স্বীয় কর্তব্য কাজে রত হল। যারা মনুষ্যত্ব হারিয়ে রক্ত পিপাসু পশুতে পরিণত হয়েছিল, তারাই পূর্ণ মানবতার সর্বোচ্চ শৃঙ্গে আরোহণ করে উন্নত চরিত্র ও সৎ কার্যাবলীর অতন্দ্র প্রহরী হবার গৌরব অর্জন করল। রাসুল (সা:)-এর আগমনের দিন অন্যান্য দিনের চেয়ে উত্তম ও সম্মানিত। দুনিয়ার মানুষের মধ্যে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ, তেমনি তাঁর আগমনের দিনটিও অন্যান্য দিনের চেয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যার উসিলায় সমস্ত মাখলুকাত সৃষ্টি, তাঁর আগমনে ত্রিভূবন আলোকিত। সৃষ্টিকর্তার অশেষ করুণা ও রহমত হিসেবে ধরণীর বুকে আগমণ করেছেন, তাঁর আগমনের দিনটি সর্বশ্রেষ্ঠ বরকতময়। এদিন আল্লাহর দিবসসমূহের অন্তর্ভুক্ত। এতে দ্বীমত ও সংশয়ের অবকাশ নেই।
সমস্ত দিন আল্লাহর তবে সে দিবসসমূহ যেগুলো বিশেষভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কোরআনে বর্ণিত- ‘আল্লাহর দিবসসমূহ তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দাও’। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, উবাই ইবনে কা’আব, মুজাহিদ ও কাতাদাহ (রা:) ও অন্যান্য মুফাস্সিরগণ অভিমত প্রকাশ করেছেন, উপরোক্ত বাণীর দ্বারা আল্লাহর দিবসসমূহ বলতে ঐ দিবস সমূহকে বুঝায় যে গুলোতে আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করেছেন (তাফসীর ইবনে জারির, খাযিন)।
রাসুল (সা:) সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত। সৃষ্টিকর্তার সমস্ত অনুগ্রহ তাঁরই মাধ্যমে বিশ্ববাসী লাভ করেছে। তিনি যদি সৃষ্টি না হতেন আল্লাহ কিছুই সৃষ্টি করতেন না। তাই যে দিবসে সর্ববৃহৎ অনুগ্রহ ধরাপৃষ্ঠে আর্বিভূত হন সে দিবসে স্মরণ করিয়ে দেয়া কি অযৌক্তিক হবে ? প্রকৃত পক্ষে এ দিবসটি পালন সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ শামিল। সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ পালন বিদআত হতে পারে না বরং অনুগ্রহ লাভের শ্রেষ্ঠ পন্থা। সৃষ্টিকর্তা ইরশাদ করেন- হে আমার হাবীব আপনি ঘোষণা করুন, আল্লাহর অনুগ্রহ এবং তাঁর করুণা প্রাপ্তিতে তাদের (মানব জাতি) খুশি উদ্যাপন করা উচিত। অতএব সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ লাভ করলে বা প্রাপ্তিতে খুশি প্রকাশ সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ রয়েছে। রাসুল (সা:) মানবজাতীর জন্য রহমত যা আল্লাহ অনুগ্রহ শামিল, তাঁর আগমনে যথাবিহীত খুশি উদ্যাপন নির্দেশ পালনে নামান্তর। রাসুল (সা:)-এর শত্রু যারা তারা আনন্দিত হতে পারে না; বরং তাদের অন্তরে আহত হতে দেখা যায়, যেমনি রাসুল (সা:)-এর আগমনের দিন শয়তান অত্যন্ত বিচলিত ও ব্যতীত হয়েছিল। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:)-উল্লেখ করেন- যখন রাসুল (সা:) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন, তখন ইহুদীদেরকে আশুরার দিন সাওম পালন করতে দেখা যায়। রাসুল (সা:) তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি কারণে এই দিন রোযা রাখছ? উত্তরে বলল এ দিনটি অত্যন্ত পবিত্র ও বরকতময়।
এই দিনটিতে আল্লাহ মূসা (আ:)-কে শত্রু ফিরআউনের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। তাই এই দিবসের সম্মানার্থে রোযা রাখি। রাসুল (সা:) ইরশাদ করলেন- আমরাই মূসা (আ:)-এর তোমাদের চাইতে (বিজয় দিবস পালনের জন্য) এ দিবস উদ্যাপন এবং সম্মান প্রদর্শনের অধিক হকদার। তাই এ দিনে রাসুল (সা:) রোযা রাখলেন। সাহাবাদের রোযা রাখার নির্দেশ দিলেন (বুখারী ও মুসলিম)। আল্লাহ বনী ইসরাঈলকে ফিরাউনের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন বলে দিনটি বরকতময়, রাসুল (সা:)-এর কাছেও বরকতময় হিসেবে স্বীকৃত। রাসুল (সা:) সমস্ত পৃথিবীর জন্য রহমত স্বরূপ, তাঁর আগমনে সৃষ্টিজগতের কুফর, শিরক, বিদআত, যুলুম, নির্যাতন, অত্যাচার, মূর্খতা এবং পথভ্রষ্টতা থেকে মানব জাতি মুক্তি লাভ করেছিল।
ইমাম সুয়ুতী (রহ:) বলেন- রাসুল (সা:)-এর আগমনে শুকরিয়া আদায় করা মুস্তাহাব। শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ:) উল্লেখ করেন- আমি মক্কায় রাসুল (সা:)-এর আগমন দিবসে মৌলুদ শরীফ পাঠরত ছিলাম। উপস্থিত লোকজনও দুরূদ পাঠ করছিলেন এবং তাঁর আগমন দিনের অলৌকিক ঘটনা বর্ণনায় মশগুল ছিলেন, যা তাঁর জন্মের সময় প্রকাশিত হয়েছিল। সে মাহফিলে আমি নূর এবং বরকত অবতীর্ণ হতে দেখেছি। অত:পর আমি গভীরভাবে চিন্তা করলাম ও উপলব্ধি করতে পারলাম, এ নূর ঐসব ফেরেশতার, যারা এ ধরনের মাহফিলে বা উল্লেখিত স্থানসমূহে নিয়োজিত থাকেন। আমি আরও উপলব্ধি করলাম, ফেরেশতাদের নূর ও রহমতের নূর পরস্পর মিলিত রয়েছে। অন্যত্রে শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ:) তাঁর আদদুররুস ছামীনে উল্লেখ করেছেন- আমার পিতা আমার উদ্দেশ্যে বর্ণনা করেছেন, আমি রাসুল (সা:)-এর জন্মের খুশি উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন করতাম। একবার দুর্ভিক্ষের কারণে ভোজনের আয়োজন করতে পারিনি, তবে সামান্য ভাজা ছোলা ব্যতীত অন্য কিছুর আয়োজন করতে সামর্থ্য ছিল না। তবুও তা লোকজনের মধ্যে বিতরণ করেছি। অত:পর আমি রাসুল (সা:) কে স্বপ্নে খেলাম, সেই ছোলা তাঁর সম্মুখে রয়েছে। আর তিনি অত্যন্ত উৎফুল্ল। হাজি ইমদাদ উল্লাহ মুহাজিরে মক্কি (রহ:) উল্লেখ করেছেন- আমার তরিকা আমি মিলাদ মাহফিলে অংশগ্রহণ করি। এমনকি বরকত ও সৌভাগ্য অর্জনের অন্যতম মাধ্যম মনে করি। প্রতিবছর মিলাদ অনুষ্ঠানের আয়োজন করি এবং কিয়াম করে মনে তৃপ্তি উপলব্ধি করি (ফয়সালা-ই-হাপ্ত মাসআলা )।
রাসুল (সা:)-এর আগমনের পর আবূ লাহাবের ক্রীতদাসী সুয়াইবিয়াহ তাকে সু-সংবাদ দিল, তোমার ভাই আব্দুল্লাহর ঔরসে একটা পুত্রসন্তানের জন্ম হয়েছে। আবূ লাহাব তা শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং তার আঙুলের ইঙ্গিত সহকারে বললেন সুয়াইবিয়াহ ! যাও তুমি আজ থেকে মুক্ত। আবূ লাহাব রাসুল (সা:)-এর চাচা, তিনি ছিলেন একজন কট্টর কাফির। কোরআনের পূর্ণ একটি সূরা লাহাব তার দুস্ককর্ম ও অশুভ বর্ণিত রয়েছে। রাসুল (সা:)-এর জন্মের খুশি প্রকাশের কারণে যে লাভমান হয়েছে তা হলো- আবূ লাহাবের মৃত্যু হলে আব্বাস (রা:) স্বপ্নে তাকে অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থায় দেখতে পান। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কি ঘটেছে ? উত্তরে আবূ লাহাব বললেন, তোমাদের নিকট থেকে পৃথক হয়ে কোন প্রকার শান্তি আমার ভাগ্যে জোটেনি, তবে আমার এ আঙুল থেকে সামান্য পানি পাওয়া যায়। আমি আঙুলের ইঙ্গিত দ্বারা আমার ক্রীতদাসী সুরাইবিয়াহকে আযাদ করেছিলাম (বুখারী)। ইসলামের প্রকাশ্য শত্রু আবূ লাহাব স্বীয় ভ্রাতুস্পুত্রের জন্মে খুশি প্রকাশ করেছিল রাসুল হিসেবে নয় বরং ভ্রাতুস্পুত্র হিসেবে। আবুল খায়র শামসুদ্দিন মুহাম্মদ আল জযরী দামেকী (রহ:) আবূ লাহাব সম্পর্কে বলেন- যখন আবূ লাহাব রাসুল (সা:)-এর জন্মের জন্য খুশি প্রকাশ করে এরূপ উপকৃত হয়েছে, তখন সেই ঈমানদার মুসলমানদের প্রতিদানের কি অবস্থা হবে, যারা রাসুল (সা:)-এর জন্মের খুশিতে স্বীয় সামর্থানুসারে অর্থ ব্যয় করে, আমার জীবনের শপথ, আল্লাহর পক্ষ থেকে এর প্রতিদান হবে, প্রভু তাকে স্বীয় রহমত ও বরকত দ্বারা সুখময় চিরস্থায়ী জান্নাতে প্রদান করবেন (যুরকানী, শরহে মাওয়াহিব)। কোরআন ও হাদিসের আলোকে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা:) পালন যথাযথ মর্যাদা ও খুশি প্রকাশ করা সকল মুমিন মুসলমানের অবশ্যই দায়িত্ব ও কর্তব্য। যার জন্য পরকালে নাযাতের উছিলা হতে পারে। সৃষ্টিকর্তা রাসুল (সা:)-এর শান-মান, আদর্শ বুঝার ও আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক