শহীদ জিয়া ছিলেন সৎ, যোগ্য ও মেধাবী সফল রাষ্ট্রনায়ক
১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়ার গাবতলী উপজেলার বাগবাড়ী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জিয়াউর রহমান। তার ডাকনাম ছিল ‘কমল’। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাকে বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরিক্রমায় ক্ষমতার রাজনীতির কেন্দ্রে চলে আসেন জিয়া। পরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে ১৯৮১ সালে ৩০ মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজে একদল বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে নিহত হন।
দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। একজন ঈমানদার মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম থাকা অপরিহার্য। দেশপ্রেম ও সততা শব্দ দুটি একে অন্যের পরিপূরক। যে দেশপ্রেমিক সে অবশ্যই সত্। আবার যে ব্যক্তি সত্ তার মধ্যে অবশ্যই দেশপ্রেম আছে। একজন প্রকৃত নেতার মধ্যে অনেক গুণাবলী থাকা আবশ্যক। তার মধ্যে দেশপ্রেম ও সততা অন্যতম।
সততা ও দেশপ্রেমের কারণেই শহীদ জিয়া আমাদের প্রিয় নেতা ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। আমাদের বিশ্বাস, জিয়াউর রহমানের যে কট্টর সমালোচক, সেও জিয়াউর রহমানের সততা ও দেশপ্রেম নিয়ে কটূক্তি করতে পারবে না। সততা ও দেশপ্রেমের প্রশ্নে আপসহীন এই মহান নেতা দেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় অবস্থান করে নিয়েছেন। জিয়াউর রহমানের স্কুলজীবন শুরু হয় কলকাতায় ‘হেয়ার স্কুলে’। ১৯৫২ সালে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন করাচিতে ‘করাচি একাডেমি স্কুল’ (বর্তমানে, তাইয়েব আলী আলভী একাডেমী) থেকে।
ম্যাট্রিক পাসের পর তিনি ভর্তি হন করাচির ‘ডি জে কলেজে’। ১৯৫৩ সালে ‘পাকিস্তান সামরিক একাডেমি’তে একজন অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি ছিলেন ‘খেমকারান’ রণাঙ্গনের ‘বেদীয়ান’-এ যুদ্ধরত ‘ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’-এর একটি ব্যাটালিয়নের কোম্পানি কমান্ডার। তার কোম্পানির নাম ছিল ‘আলফা কোম্পানি’। এই ব্যাটালিয়নে এবং জিয়ার আলফা কোম্পানির যুদ্ধে প্রচুর বীরত্ব দেখায়। অর্জন করে প্রভূত সুনাম। ১৯৬৯ সালের এপ্রিলে জিয়াউর রহমান ঢাকার অদূরে জয়দেবপুর সাব-ক্যান্টনমেন্টে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দ্বিতীয় ব্যাটালিয়নে সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে যোগদান করেন।
একই বছর উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তিনি চার মাসের মেয়াদে পশ্চিম জার্মানি যান। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বরে জিয়াউর রহমানকে চট্টগ্রাম বদলি করা হয়। নিযুক্ত হন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটালিয়নের সেকেন্ড ইন কমান্ড। এর ঘাঁটি ছিল ষোলশহর বাজারে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কাল রাতে যখন পাকিস্তান হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তখন জিয়াউর রহমান জীবন বাজি রেখে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন।পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যদি যুদ্ধে জয়লাভ করত তাহলে জিয়াউর রহমানকে ফাঁসিতে ঝুলতে হতো। জিয়াউর রহমান এমন একজন নেতা ছিলেন যিনি দেশের সব দুর্যোগ ও সঙ্কটময় মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতা বিপ্লবের মাধ্যমে দেশ ও জাতির সঙ্কটময় মুহূর্তে জিয়াউর রহমান দেশের গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন।
স্বাধীনতার স্বপ্ন ছিল গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মানুষের মৌলিক চাহিদার বাস্তবায়ন। কিন্তু স্বাধীনতার পর যখন দেশবাসী দেখতে পেল, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ১৯৭৫ সালে ২৫ জানুয়ারি সোনার হরিণ নামের গণতন্ত্রকে হত্যা করে বাকশাল কায়েম করা হয়েছে, তখন জিয়াউর রহমানের হাতেই ১৯৭৬ সালে রাজনৈতিক দলবিধির অধীনে আওয়ামী লীগ, জাসদ, ন্যাপ (ভাসানী), ন্যাপ (মোজাফফর), জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ (কমরেড মণি সিংহ) বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতি করার সুযোগ পেল। সেই কারণেই জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতির কথা বিবেচনা করে তিনি সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজন করেছিলেন। এই জিয়াউর রহমানই প্রথম আমাদের স্বাধীন জাতিসত্তার পরিচয়ে বিশ্বে পরিচিত করেছিলেন তার ঐতিহাসিক দর্শন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে। আমরা জাতি হিসেবে বাঙালি নয়, বাংলাদেশী। পশ্চিম বাংলার জনগোষ্ঠীও তো বাঙালি। জাতীয়তা যদি বাঙালি হয় তাহলে বাংলাদেশ যে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ তা বিশ্ববাসী বুঝতে অক্ষম হবে।
জিয়াউর রহমান মূলত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী দর্শনের ভিত্তিতে সব ধর্মের, সব বর্ণের, সব মতের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে বাংলাদেশকে একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর বিশ্বে বাংলাদেশ যে তলাবিহীন ঝুড়ির খেতাব পেয়েছিল, তার দুর্নাম ঘোচাতে তিনি শক্তহাতে দেশের হাল ধরেছিলেন। সামরিক উর্দি খুলে জনগণের কাছাকাছি পৌঁছতে পেরেছিলেন। বন্যা ও খরা থেকে বাঁচার জন্য এবং জমিতে সেচ প্রদানের জন্য তিনি খাল খনন কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। ফারাক্কার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তিনি এন্টি ফারাক্কার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।তার সময়ে সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে প্রকট খাদ্য ঘাটতির দেশ হয়ে ওঠে খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশ। জিয়াউর রহমানের সময়ই এদেশ থেকে চাল রফতানি করা হয়েছিল বিদেশে। তার সময় বন্ধ কল-কারখানা সচল হয়। কল-কারখানা, অফিস-আদালত ও ক্ষেত-খামারে সর্বক্ষেত্রেই প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসে। দেশের জনগণ সত্যিকারের স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করতে শুরু করে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ গড়ার জন্য। নিজে হাতে খাল কেটেছেন, গাছ লাগিয়েছেন, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে এমন দৃষ্টান্ত বিশ্বে বিরল। শিক্ষা বিস্তারে তার অবদান অতুলনীয়। দেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকীকরণ করেছেন। মেধার স্বীকৃতি, লালন ও বিকাশের জন্য তার পদক্ষেপ ছিল প্রশংসনীয়।
বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জনকারীদের নিয়ে নৌবিহার করেছেন, তাদের সঙ্গ দিয়েছেন ও দেশের জন্য তাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। পররাষ্ট্রনীতিতেও জিয়াউর রহমান সফল ছিলেন। সব বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা ও মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা ছিল তার পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য। ১৯৮১ সালে তৃতীয় ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে ৩ সদস্যবিশিষ্ট আলকুদস কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয় বাংলাদেশ। ইরাক-ইরান যুদ্ধাবসানের উদ্দেশ্যে গঠিত নয় সদস্যবিশিষ্ট ইসলামী শান্তি মিশনে তিনি ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তিনি শুধু বাংলাদেশের নেতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন মুসলিম বিশ্বের একজন জনপ্রিয় নেতা। তার সময়েই বাংলাদেশ ১৯৭৮ সালে জাপানের মতো শক্তিধর দেশকে পরাজিত করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য পদ লাভ করে। তিনি বাংলাদেশের মানুষের মহামুক্তির সনদ ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং এই ১৯ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য বিএনপি গঠন করেন। দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য যে সময়ের প্রয়োজন ছিল, তিনি সেই সময়টুকু পাননি।যারা এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে অপছন্দ করত, জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তাকে ঈর্ষা করত, এদেশ বিশ্বের মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক যারা তা চাইত না, সেই দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠীর ইশারায় কিছু বিপথগামী সেনা কর্মকর্তারা এদেশের জনপ্রিয় প্রাণপ্রিয় নেতা জিয়াউর রহমানকে হত্যা করল।
১৯৮১ সালের ৩০ মে ঘাতকের তপ্ত বুলেট তার হৃদস্পন্দন স্তব্ধ করে দিল। সাদামাটা প্রকৃতির মানুষ ছিলেন তিনি। পোশাক-পরিচ্ছেদ ও আহারে তার কোনো বিলাসিতা ছিল না। তিনি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, দুই পুত্র, আত্মীয়স্বজনকে এদেশের মানুষ খুব একটা চিনতেন বলে মনে হয় না। তার দুই পুত্র লেখাপড়া করতো সাধারণ মানের স্কুলে। তার মৃত্যুর পর নিজস্ব সম্পদ হিসেবে তার পরিবার-পরিজনের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারেননি। এমন কি তার পরিবারের মাথা গোঁজার কোনো ঠাঁই ছিল না। তত্কালীন সরকার মানবিক কারণে বর্তমান ক্যান্টনমেন্টের মইনুল রোডের বাসভবনটি বেগম খালেদা জিয়াকে বরাদ্দ দেয়। যে বাড়ি থেকে জিয়া পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে সততার এই উদাহরণ বর্তমান বিশ্বে বিরল। আসলে জিয়াউর রহমান সততা ও দেশপ্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এক কালজয়ী মহান নেতা।
একটি জাতি গঠন ও দেশকে উন্নয়নের চরম শিখরে নিয়ে যাওয়ার জন্য একজন সত্ ও দেশপ্রেমিক নেতাই যথেষ্ট। আমরা মনে করি জীবিত জিয়ার চেয়ে মৃত জিয়া অনেক বেশি শক্তিশালী। জিয়াউর রহমান আজ বেঁচে নেই, কিন্তু আছে তার রেখে যাওয়া ১৯ দফা কর্মসূচি, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন, তার সততা, দেশপ্রেম, জনগণের ভালোবাসা, তার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপি। আরও আছে তার যোগ্য উত্তরসূরি ও তার সহধর্মিণী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপার্সন, জনগণের আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বেই আগামী দিনে দেশপ্রেমিক জিয়ার সব আদর্শ, ভাবনা, চিন্তা ও উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন হবে। বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে যা শহীদ জিয়ার স্বপ্ন ছিল।সাথে করে এনেছিলে মৃত্যহীন প্রাণ মরনে তাই তুমি করে গেলে দান।