শৈশবের এক ভয়ংকর স্মৃতি! >>সালাউদ্দিন চৌধুরী
স্বাধীন বাংলার প্রথম ক্রস ফায়ারের শিকার কমরেড সিরাজ সিকদারকে নিয়ে সাবেক এয়ারফোর্স অফিসার সালাউদ্দিন চৌধুরীর অবেকঘন স্মৃতিচারণ:
আমি তখন বেশ ছোট। বাড়ীর কাছে ঈদগাহ মাঠটি ছিল আমাদের সকল খেলাধুলা ও বিনোদনের মুল উৎস। মাঠ সংলগ্ন জামে মসজিদটি ছিল চারিদিকে দেয়াল এবং উপরে টিনের ছাদ বিশিষ্ট। বর্তমান মোহাম্মদপুর জামে মসজিদটি ছিল পুরনো মসজিদ সংলগ্ন কিয়দাংশ নির্মিত ও পরিত্যক্ত একটি অসমাপ্ত স্থাপনা। আমরা শুনেছি মসজিদটি নির্মানকালীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় সেটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে বহুদিন। পরবর্তীতে ৭৭/৭৮ সালের দিকে পুনরায় সেটার নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং তা বর্তমান রুপ ও আকার ধারন করে। সেদিন ছিল শুক্রবার। আমরা দল বেধে জুম্মার নামাজ শেষ করে বাসায় ফিরে দুপুরের খাবার শেষ করে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে একটি লাল রঙের বাস্কেটবলকে ফুটবল বানিয়ে নিত্যদিনের মত ঈদগাহ মাঠে গেলাম ফুটবল খেলতে। আমাদের চোখে তখন স্বপ্ন – কেউ সালাহউদ্দিন হব,কেউ মেজর হাফিজ হব কেউ বা এনায়েতে ভাইদের মত ফুটবলার হব।
খেলাধুলায় আমরা ছোট বেলা থেকে বেশ ভালোই ছিলাম। আমাদের গ্রুপ এবং সেই মাঠ থেকেই পরবর্তীতে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলে খেলেছে আমাদের বাল্যবন্ধু সাব্বির,আইয়াজ,ফয়েজ বাবু ও জিয়া বাবু। প্রথম বিভাগ ফুটবলের অনেক দলে খেলেছেন আইয়ুব ভাই,আসফাক ভাই,জ্যামিল আখতার ভাই। যাই হোক দুরন্ত শৈশব,কিশোর বেলার মুল আনন্দই ছিল ফুটবল খেলা। সেদিন বিকেল বেলা হুড়মুড় করে বিশাল বিশাল সাইজের পোশাক ধারী ট্রাক ভর্তি সশস্ত্র মানুষ এসে চারিদিকে আচমকা ধমকা ধমকি ও হই চই বাধিয়ে দিল। তারা সকলেই তখন পুরনো মসজিদের জানাজা পড়ার স্থলে একটি খাটিয়া ধরাধরি করে লাশ নামাচ্ছিল। মসজিদ ও পাশের কবরস্থানের এবং ঈদগাহ মাঠের মাঝখানে একটি দেয়াল প্রাচীর এবং সেই প্রাচীরের মাঝখানে একটি গ্রীলের তৈয়ারী গেট। সেই গেট দিয়ে আমরা ভীত সন্ত্রস্ত বিস্ময় নিয়ে সেদিকে কি হচ্ছে তা তাকিয়ে দেখছিলাম। দুই তিনজন পোশাকধারী সশস্ত্র লোক আমাদের দিকে তাকিয়ে হেড়ে গলায় বলল “ঐ পোলাপাইনের বাচ্চা,ভাগ এখান থেকে”। আমাদের গ্রুপের সবচেয়ে দুষ্ট বন্ধু লিটন ব্যংগ করে বলে উঠলো ” ওরে বাপরে, ভাগরে রক্ষী বাহিনী আইলরে”।
তখন মিলিটারি,পুলিশ কিংবা যে কোন পোশাকধারী লোককেই আমরা ভাবতাম রক্ষী বাহিনী কারন তারা তখন ভয়ভীতি নামক জিনিসটিকে কিংবদন্তির পর্যায়ে নিয়ে গেছে। আমরা সবাই দৌড়ে মাঠের দক্ষিন পশ্চিম কোনায় অবস্থিত মসজিদের ঈমাম সাহেবের ঘরের কোনায় লুকিয়ে থেকে ওখানে কি ঘটছে তা অবলোকন করতে লাগলাম। কৌতুহলী মন অতটুকুতে ভরে না যেন। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কিছু সংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে জানাজা শেষে লাশটি মসজিদের উত্তর পাশের কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা আবছা অন্ধকারে ঈদগাহের মিম্বরের পাশে পশ্চিম পাশের ভাংগা দেয়ালের ফাক ফোকর দিয়ে দেখলাম সেই লাশের দাফন কর্মের শেষ দৃশ্য। লাশ দাফন করে তড়িঘড়ি করে সকলেই চলে যায় তবে হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়ে প্রায় ৩/ ৪ জন সশস্ত্র প্রহরী সেখানে থেকে যায়। আমার বেশ ভয় করতে শুরু করল।আমাদের গ্রুপে আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই যিনি আমার ভালো বন্ধুও তিনি আমার ভয় দুর করার জন্য মজার মজার গল্প করতে লাগলেন। এরপর প্রায় মাসখানেক সেই কবর প্রহরাধীন দেখতে পেলাম। কিছুদিন পর উনার নাম সিরাজ সিকদার এটুকুই জানলাম।উনি কি করতেন,কিভাবে মারা গেলেন ঐ টুকু বয়সে আর জানারই বা কি ছিল? তবে লোকমুখে তার সম্পর্কে অনেক মিথ শুনতে লাগলাম যা আমাদের কাছে রুপকথার গল্পের মত মনে হত। আরও পরে জানলাম তিনি ছিলেন একজন বামপন্থী নেতা এবং বুয়েট গ্রাজুয়েট ইঞ্জিনিয়ার। তারও বহু বছর পর জানলাম তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ক্রস ফায়ারের শিকার। তাকে দাফন করার কয়েকমাস পর দেখলাম তার কবর পাকা করে হলুদ রঙের প্রলেপ দেয়া হয়েছে এবং কারা যেন তার কবরে মাঝে মাঝে ফুল দিয়ে যায় আর কালো রঙের ব্যানারে সাদা অক্ষরে “কমরেড” “লাল সালাম” এসব লিখে রেখে যায়। শৈশবের সেই ভয়ংকর স্মৃতি আজও মনকে ভীত করে তুলে মাঝে মাঝে। বারবার মনে হয় এমন দৃশ্য কেন দেখতে হয় আমাদের!!!