বাফেলোতে আর থাকা যাবে না! >>এইচ. এম. মুশফিক
বাফেলো! নামটা প্রথম শুনেছিলাম ২০০৯ সালে। যা শুনেছিলাম তাতে মনের কল্পনায় এমন একটা সিটির দৃশ্য ভেসে উঠেছিলো যেখানে দিনের আলোয় ওড়ে বেড়াতো কালো কাক, আর রাতের আঁধারে কিছু শকুনের কলকী টানা। কালো কাক আর কলকী টানা শকুনদের তাড়াতে সিটি মরিয়া হয়ে পরিত্যক্ত বাড়িগুলোর ব্যবহার করতে শুরু করে টোপ হিসেবে। সময়টা হবে হয়তো ২০০০ সাল বা দু’এক বছর আগে পরে। দু’হাজার টাকায় সতেরোটা বাড়ি কেনার মত লোকের কথা যেমন শুনেছি- তেমনি বাড়ি দিয়েছে ফ্রী এবং সাথে পাঁচ হাজার ডলার রিপেয়ারিং ব্যয় পরিশোধের কথাও শুনেছি। আমাদেরই ভাইবোনদের কাছ থেকে যারা প্রথম দিকে এসেছেন। ২০১০ সালে যখন প্রথম আমি বাফেলো দেখতে এলাম তখনও বাফেলো মুক্ত হতে পারেনি শকুনের থাবা কলকী গ্রুপ থেকে।
রাস্তাগুলো ফাঁকা। এক কোণে দাঁড়ালে অন্য কোনের শেষ চৌরাস্তার ধার ঘেঁষে হয়ত দু-চার ঘন্টা পর সাঁই করে একটা গাড়ি চলে যাবার শব্দ শোনা যেতো। ভূতুড়ে রাস্তা, জনমানবহীন, দিনের আলোতে হাঁটতে যেখানে গা ছমছম করতো, সেখানে রাতের আঁধারে বাইরে হাঁটা বা বাইরে গাড়ি নিয়ে ঘুরতে কোথাও যাওয়াটা ছিলো এক ধরনের আত্মহত্যার পরিকল্পনা করা। বাফেলো সম্পর্কে আউট স্টেটের বা সিটির লোকদের কেমন ধারণা ছিলো দু’চারটা প্রশ্ন যা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মানুষ জানতে চেয়ে সামনে নিয়ে এসেছে তা এখন স্মৃতির পর্দায় ফ্ল্যাশব্যাক করলে হাসি চেপে রাখতেও কষ্ট হয়। এক ভাই একদিন নিউইয়র্ক সিটি থেকে কল দিয়ে জানতে চাইলেন,- আচ্ছা ভাই! শুনেছি বাফেলোতে অনেক সস্তায় বাড়ি পাওয়া যায়, আমিও একটা কিনতে চাই। কিন্তু – ওখানে কি ভাই কারেন্ট আছে?
আরেকজনের প্রশ্ন:- আচ্ছা- ভাই যান! বাফেলোতে কি স্যানেটারি টয়লেট না-কী কাঁচা টয়লেট?
অন্যজনের প্রশ্ন: বাফেলোতে কি ভাই খাবার-দাবার কিনতে পাওয়া যায়, নাকী সিটি থেকে নিয়ে যেতে হয়?
আচ্ছা- শুনেছি- বাফেলোতে নাকি সারা রাত স্নো পড়ে আর সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠে ঘরের দরজা খোলা যায়না স্নোর কারণে?
আচ্ছা ভাই! বাফেলোতে কী সুয়ারেজ লাইন আছে?
কিসের পানি খান আপনারা? নদীর পানি? না-কী টিউবয়েল দিয়ে নিতে হয়?
এই হলো বাফেলো। যা ছিল আউট অব বাফেলোর সকল মানুষের কাল্পনিক ভাবনার এক বিরক্তিকর আজব এবং নিশ্চিত অদ্ভুত একটি এলাকা।
এই কাপড়হীন উলঙ্গ বাফেলোকে মানুষ বানিয়েছি আমরা। এই সেই বাফেলো যার বাড়িগুলোর দিকে তাকালে বমি আসতো ঘৃণায়, সেই বাফেলোর বাড়িগুলোর সামনে ফুলের বাগান করেছি আমরা। আমাদের ঘামে ঝরা পরিশ্রমের অর্থ তিল তিল করে জমিয়ে সততার সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একটি মানবিক মূল্যবোধের সুন্দর সমাজ গড়ে তোলার প্রত্যয়ে এসেছি বাফেলোতে।
আমরা প্রায় প্রতিটি স্ট্রীট থেকে কাক তাড়–য়া তাড়িয়েছি, শকুন তাড়িয়েছি। প্রতিটি জনপদ ড্রাগ মুক্ত করেছি। পুলিশ যা পারেনি আমরা তা করেছি। এ যেন অতি যত্নে লালিত-পালিত একটি সপ্নের বীজ। যা থেকে হয়েছে চারা, চারা থেকে একটু একটু করে বৃক্ষ। শাখা প্রশাখা পত্র পল্লবে সুসজ্জিত। ফুল ধরেছে- আসছে ফল। এমনই ঘাম ও রক্তঝরা অর্থে কেনা বাফেলোর প্রতিটি বাড়ির মালিক অবাক বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে যখন সে দেখে তার শ্রমে ঘামে রক্তে ভেজা সুসজ্জিত বাড়ির ঈেয়নে সিটি কর্তৃপক্ষ লেলিয়ে দিয়েছে ইনসপেক্টর নামের এক ঝাঁক নেকড়েকে। যাদের হাতে সিটি দিয়েছে টিকিট নামের মস্ত এক মুগুর – যে মুগুর নাড়া দিলেই বাড়িওয়ালার পকেট ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে ডলার।
কোন কারণে সেই অযৌক্তিক ফাইন বা টিকিটের দাবিকৃত অর্থ পরিশোধে বিন্দুমাত্র বিলম্ব হলে ; আপনাকে গুণতে হবে দু-রকমের শাস্তি, একটার নাম জরিমানা আরেকটার নাম লেট-ফি। একটা হলো সময় মত দিলেনা কেন? দ্বিতীয়টা হলো দেরি করলেন কেন? টিকিট এর খোঁচা মানি যদি হয় ৫০ ডলার তবে জরিমানা হয় ৫০ ডলার এবং লেট ফী হয় ৭৫ ডলার। মোদ্দাকথা, আপনি হয়ত টিকিটটি যথাসময়ে হাতে পাননি অথবা যে কোন অসুবিধার কারণে ৫০ ডলার দিতে দেরি হলো তাহলে আপনাকে এর জন্য অতিরিক্ত সর্বসাকুল্যে ১৭৫ ডলার। আপনি অনুমান করতে পারেন? কতটা জালেম হলে এরা এ ধরনের আইন করতে পারে। ইনসপেক্টর নামের লাঠিয়াল বাহিনী। ওদের একমাত্র প্রতিপক্ষ হলো ইমিগ্র্যান্ট বাড়িওয়ালা, ভাড়াটের কল পেলেই হলো। লাঠিয়াল বাহিনী বাড়ির ভেতর ঢুকে এমন সব টিকিট বা ভায়োলেশান ইস্যু করে, দেখলে মনে হয় ওরা চায় ইমিগ্র্যান্ট বাড়িওয়ালারা শত বছরের পুরানো বাড়িগুলো ভেঙ্গে কেনো একেবারে নূতন করে তৈরি করছে না? ব্যাপারটা এমন যেন নব্বই বছর একশ বছর বয়সের বুড়ীগুলোকে তরুণ যুবকদের গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে কাবিন হাঁকাচ্ছে আশি লাখ!!!
সিটি কর্তৃপক্ষের ভেতর এক ধরনের দম্ভ বা অহমিকাবোধ ঢুকে গেছে, যা সিটি হলে গিয়ে যে কোন কর্মকর্তা কর্মচারীর মুখোমুখি হলেই টের পাওয়া যায়। আগে যাদের ব্যবহার ছিল মধুময় এখন তা হয়েছে বিষময়।
সিটি আমাদের, কাউন্টি ট্যাক্স, সিটি ট্যাক্স, ইউজার ফি, রেন্টাল রেজিস্ট্রেশান ফি, ট্রাশ ফি, গার্বেজ পিক এন্ড পে, ঘাসের টিকেট- স্নোর টিকেট বাড়ির ভেতর বাইর কোন অসামাঞ্জস্য পেলে তার টিকিট বা ভায়োলেশন- লিড হেযার্ড- এসবেস্টজ হেযার্ড- গার্বেজ কেন যথাস্থানে না রাখার টিকেট, উল্টা পাল্টা গার্বেজের টিকেট, আরো যে কত না জানা ভায়োলেশন – বা টিকিট আছে তার জন্য বাড়িওয়ালাকে নোটিশ করে। অথচ এই সিটি কর্তৃপক্ষ কি কখনও ভেবেছে একজন বাড়িওয়ালা যদি তার টেনেন্ট থাকে তাহলে সে যদি নিয়মিত ভাড়া পায় তবে সে এগুলো নিয়মিতি করতে পারে- বা পরিশোধ করতে পারে। কিন্তু আমরা দেখি উল্টোটা। একজন ভাড়াটে তার রেন্ট না দেয়ার অজুহাতে স্বেচ্ছায় সে তার এপার্টমেন্টের উইন্ডো ভাঙ্গে- ইলেকট্রিসিটির আউটলেট ভাঙ্গে, প্লাম্বিংয়ের পাইপ ভাঙ্গে, এসব করে যখন হেলথে কল করে, তখন একজন ইন্সপেক্টর এসে ভাড়াটে যেভাবে যা দেখিয়ে দেয়, সে সেভাবেই বিশ পঁচিশটা ভায়োলেশন দিয়ে তৃপ্তচিত্তে অফিসে গিয়ে গান গায়। আর বাড়িওয়ালা যখন ভাড়াটের কাছে রেন্ট চাইতে যায় তখন ভাড়াটে দাঁত কেলিয়ে হাসে আর কয়: হেলথ ডিপার্টমেন্ট থেকে তোমাকে চেক পাঠাবে, ওয়েট এন্ড সি!!
কর্তৃপক্ষ বা ইন্সপেক্টরদের কাজ কি শুধু ভাড়াটেদের নালিশ শোনা? আর বাড়িওয়ালাকে বাঁশ দেয়া? কারণ সিটির দৃষ্টিতে আর ইন্সপেক্টরদের দৃষ্টিতে ভাড়াটেরা সব হিউম্যান আর বাড়িওয়ালারা সব অমানুষ আর অ্যানিমেলস!!!
-নিউ ইয়র্ক।