বাপ বেটির এগার >> মুজিব থেকে হাসিনা ✍️শামসুল আলম
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর শেখ মুজিব আবির্ভূত হন একজন স্বৈরাচারী ফ্যাসিবাদী নেতা রূপে। শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসেই নয়, সমগ্র উপমহাদেশের ইতিহাসে তিনিই প্রথম নেতা, যিনি একদলীয় শাসনের ঘোষণা চালু করেন- আর এর জন্য তিনি সময় নেন মাত্র ১১ মিনিট। এর আগে স্বাধীন দেশে ফেরত আসার পর থেকে শেখ মুজিব তার প্রভাব ও সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে। তিনি রাষ্ট্রপতি থেকে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, দলের সর্বময় ক্ষমতা তার হাতে কেন্দ্রীভূত করেছেন. শেষে একদলীয় শাসন কায়েম করেন। জাঁকালো রাষ্ট্রপতি হয়ে দিনাজপুরের মহারাজার সিংহাসনটা আনিয়ে বসেছিলেন। পূর্বের ১৯ জেলা ভেঙে দিয়ে ৬১টি নতুন প্রশাসনিক এলাকা নির্ধারণের পরে একজন করে গভর্ণরও বসিয়ে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেছিলেন।
১৯৯৬ সালের ১২ জুনের মধ্যরাতে নির্বাচনী ক্যু করে ২১ বছর পরে আওয়ামী নেত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কব্জা করেন। অতঃপর বিরোধী পক্ষের উপর দমন পীড়ন চালাতে পিতার ঐতিহ্য ধরে রাখেন। ২০০৭ সালে ১/১১ কুশীলবদের সঙ্গে আঁতাত করে শুরু হয় তার দ্বিতীয় দফার ক্ষমতা। পরে জোর জুলুম ভোট ডাকাতি বিরোধী দলহীন নির্বাচন এবং পুলিশী নির্বাচন করে নানা কায়দায় তা প্রলম্বিত করতে থাকেন- গণতন্ত্রকে প্রতিস্থাপন করেন হত্যা গুম ও ভীতিকর পুলিশী স্টেট দিয়ে।
২) পকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আশায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিব বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা দেননি। যুদ্ধের ডাক না দিয়েই তিনি স্বেচ্ছায় ধরা দিয়ে জনগণের স্বাধীন দেশের চেতনায় কুঠারাঘাত করেছিলেন। যুদ্ধশেষে নতুন বানানো পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়ে দেশে ফেরত এসে তিনি মুক্তিযুদ্ধের মূল লোক তাজউদ্দীন, জিয়াউর রহমান, ওসমানী কারো কাছ থেকে কিছু না শুনেই ভাগ্নে শেখ মনির পরামর্শ এবং উস্কানিতে চলতে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধ তাকে ক্ষমতা এনে দিলেও মুক্তিযোদ্ধারা হতে থাকেন উপেক্ষিত।
শেখ হাসিনা এবং তার পরিবার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ না নিয়েও, এমনকি যুদ্ধকালে পাকিস্তানের ভাতায় ভরণ পোষণ চালিয়ে, পাকবাহিনী থেকে সুযোগ সুবিধা নিয়ে সন্তান উৎপাদন করলেও তিনি এখন মুক্তিযুদ্ধের সোল এজেন্সী নিয়ে বসেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করছেন বানিজ্যিকভাবে। তিনি এমন একটি মেশিন হাতে নিয়ে ঘোরেন, যেখানে মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকার বানান, আবার রাজকারকেও মুক্তিযোদ্ধা বানাতে দ্বিধা করেননা। এমনকি রাজাকার পরিবারে নিজের কন্যাকে বিয়ে দিয়ে আত্মীয়তা করেও অন্যদেরকে কথায় কথা রাজাকার গালি দিতে দ্বিধা করেন না।
৩) দেশ স্বাধীনের পর শেখ মুজিব এতটাই ভারত নির্ভর হয়ে পড়েন যে, বাংলাদেশের সংবিধানের খসড়া, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ইত্যাদি আগেই ভারত থেকে অনুমোদন করিয়ে আনেন। পূর্বে করা একটি গোপন চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের ফরেন পলিসি ভারতের সাথে পরামর্শ করে নেয়া বাধ্যতামূলক ছিল। যুদ্ধকালে করা ঐ অধীনতামূলক ৭ দফা গোপন চুক্তি বাতিল না করেই মুজিব নতুন একটি ২৫ সালা চুক্তি করে সেগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করেন। বন্ধুত্ব চুক্তির নামে ওটি ছিল আসলে দাসত্বের নিগড়ে বেঁধে ফেলা। এছাড়া বাংলাদেশের স্বার্থ হানিকর ফারাক্কা চুক্তিতে সই করে গঙ্গ-পদ্মার পানি ভারতকে একতরফা প্রত্যাহারের সুযোগ করে দেন মুজিব।
বিনাভোটে বার বার ক্ষমতায় থেকে হাসিনা ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে তুলে দিয়েছেন ভারতের হাতে। বিশেষ করে ২০০৯-১৯ এই দশকে বাংলাদেশের রাজনীতি, ক্ষমতায় কে থাকবে না থাকবে, সশস্ত্র বাহিনী, পররাষ্ট্র নীতি, সিভিল প্রশাসন থেকে শুরু করে ব্যবসা বানিজ্য সবকিছুই এখন ভারতের হাতে। এতে করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি কার্যত সার্বভৌমত্ব হারিয়েছে। এখন আর বাংলাদেশের স্বাধীন কোনো পররাষ্ট্র নীতি নাই, পুরোটাই ভারত নির্ভর। জনগনের অমতে দেশের সবে ধন দু’টি সমুদ্রবন্দর ভারতকে ব্যবহার করতে দেয়া হয়েছে। কৌশলে সড়কপথও দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের উপকুল জুড়ে রাডার স্থাপন করতে ভারতকে অনুমতি দিয়ে চুক্তিতে সই করেছেন, ফলে সার্বভৌমত্ব বলতে আর কিছু অবশিষ্ট নাই। প্রতিরক্ষা চুক্তি ও দরকার হলে বাহিনী ঢোকানোর গোপণ চুক্তির কথা শোনা যাচ্ছে। প্রায় দেড় মিলিয়ন ভারতীয়দেরকে এদেশে কাজ করতে সুযোগ দিয়েছেন হাসিনা, যারা বছরে ১০ বিলিয়নেরও বেশি ডলার ভারতে বৈধভাবে নিয়ে যায়, অবৈধভাবে আরও অনেক। বাস্তবে, শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ভারতের বাজার ও আয়ের উর্বর ভূমিতে পরিণত করে দিয়েছেন। এভাবে চললে, সুব্রামানিয়াম ঘোষিত দিল্লির শাসন কায়েম করতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
৪) শেখ মুজিব নিজের কতৃত্ববাদী শাসন কায়েম করতে গিয়ে বিরোধী দলের ৩০ হাজার যুবক হত্যা করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। বিশেষ ক্ষমতা আইন ও জরুরী অবস্থা জারী করে বিরোধী মত দমন করেছিলেন। শেষে সকল রাজনৈতিক দল ও পত্রিকা নিষিদ্ধ করে একদলীয় বাকশাল কায়েম করেছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল আজীবনের ক্ষমতা কায়েম করা।
শেখ হাসিনা তার নিজের একক শাসন ও কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বাপের মতই বিরোধী রাজনীতিকে নির্মমভাবে দমন করেছেন। খুন, গুম, নিবর্তন, রাজনীতিকদের পাইকারী হারে চোর ছেচ্চরদের মত রিমান্ডে নেয়া, নির্বাচন ব্যবস্থা ধংস করার মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসন কায়েম করেছেন, যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি তিনি পেয়েছেন গত বছর। বাংলাদেশ এখন আর গণতান্ত্রিক দেশের তালিকায় নেই।
৫) যত বড়ই নেতা হন না কেনো, শেখ মুজিবেরও ভয় ছিল সুষ্ঠু নির্বাচনে। ভোট হলে ক্ষমতা নিশ্চিত ছিল না জেনেই তিনি ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচন সুষ্ঠু হতে দেননি। স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ মুজিব কখনও জনগনের ভোটে নির্বাচিত নেতা হননি, ক্ষমতায় বসেননি। গায়ের জোরে বিরোধীদের দমন করেই নিজকে নির্বাচিত ঘোষণা করেছিলেন। ঐ নির্বাচনে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতে ভোটকেন্দ্র দখল করেই ক্ষান্ত হননি, মুজিববাদী গুন্ডারা তান্ডব করে ১১টি আসনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীকে নমিনেশন পেপার দাখিলই করতে দেয়নি। আর এভাবেই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান, শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ত্রাণ ও পূনর্বাসনমন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান, মৎস্য, বন ও পশুসম্পদমন্ত্রী মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ, এম ওবায়দুর রহমান, মনোরঞ্জন ধর, রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া এবং মোতাহার উদ্দিনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। অন্যত্র অস্ত্রের মুখে কেন্দ্র দখল করে ব্যাপকভাবে ভোট ডাকাতি করা হয়। এমনকি মুজিবের নির্দেশে ব্যালট বাক্স হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় এনে ফলাফল বদলে ফেলা হয়। তারপরও কাঙ্খিত ব্যক্তিরা পাশ না করায় ফেলকে পাশ, আর পাশকে ফেল দেখিয়ে তিনি বিরোধীপক্ষকে মাত্র ৮টি আসন দিয়েছিলেন!
বাপের মতই শেখ হাসিনার আতঙ্ক হলো ভোট। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তিনি কখনই ক্ষমতায় আসতে পারবেন না, এটা জেনেই তিনি গণতন্ত্র হত্যা কতে গিয়ে ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্খার বিলুপ্তি ঘটিয়েছেন। কেন্দ্র দখল ও বিরোধী দলের লোকদের বলপ্রয়োগে কেন্দ্র থেকে তাড়িয়ে দিয়ে জালভোটে বিজয়ী হওয়া, তারপরে ২০১৪ সালে একদলীয় ভোট করেছেন, শেষে ২০১৮ সালের নির্বেচনে আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে আছেন। বাপের হিসাব মতই বিরোধী পক্ষকে ৮টি সিটে আটকে দিয়েছেন!
৬) শেখ মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশের একটি মরা সেনাবাহিনী রেখেছিলেন, যাদের ঠিকমত খেতে দেয়া হতো না, পায়ে ছিলনা বুট, অস্ত্র, গাড়ি, যন্ত্রপাতির সরবরাহ ছিল না। অন্যদিকে রক্ষীবাহিনীকে পোষাক অস্ত্র ভাতায় সুসজ্জিত করে তাদেরকে জনগনের অধিকার হরণের কাজে ব্যবহার করাতেন।
হাসিনার রাজত্বে পিলখানায় ৫৭ সেনা হত্যাকান্ডে বিডিআর ধংস করা হয়। সেনাবাহিনীর কোমড় ভেঙে দেয়া হয়। শুদ্ধি অভিযানের নামে প্রায় সহস্রাধিক সেনা অফিসারেকে চাকরিচ্যুত করে ভিন্নমতের অনেককে জেলে পাঠানো হয়। এখনও অনেককে গুম করে রাখা হয়েছে ব্লাকে হোলে।
৭) ৭২ থেকে ৭৫ মুজিবের আমলে দেশ চলেছে মুজিবের একক কতৃত্বে এবং হুকুমে। তখন মুজিবের কথা মানেই ছিল আইন, সেখানে সংবিধান ও আইন কানুনও অচল হয়ে পড়ত। সংসদ ছিল তার আজ্ঞাবহ, মুজিবপুত্র কামালের বাহিনী ছিল মুর্তিমান ত্রাস। স্বাধীনের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ মুজিববাদী ছাত্রলীগের যাবতীয় দুর্নীতি ও গুন্ডামির আখড়াতে পরিণত হয়েছিল। বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের যোগ দিয়ে সরাসরি বিধিবদ্ধভাবে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিলেন। সমস্ত সরকারি বেসরকারি দফতর স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পত্রিকার সাংবাদিক, লেখক, কবি, সাহিত্যিক এবং বুদ্ধিজীবীদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে সবাইকে বাকশালে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। বাংলাদেশে বাস করে চাকুরি-বাকরি, ব্যবসা-বানিজ্য করে বেঁচে-বর্তে থাকতে চাইলে মুজিবের বাকশালে যোগ দেয়া ছাড়া বিকল্প ছিল না।
পিতার পথ ধরে কন্যা হাসিনার আমলে তার ইচ্ছা অনুসারেই চালাচ্ছেন দেশ। এখানে সংবিধান এবং আইন কানুন সবই তার ইচ্ছার কাছে পদানত। আদালতগুলিতে স্বাধীন বিচারের কোনো সুযোগ নাই, সরকারের হুকুমে চলে সব। কথাবার্তা না শোনায় প্রধান বিচারপতি সিনহাকে অপমান অপদস্ত করে দেশান্তরী করা হয়েছে। অফিস আদালতে চলছে চরম দলীয়করণ। রাজনৈতিক ভিন্ন মতাদর্শের কারণে চাকরি হয় না সাধারণের। যারা আগে থেকে চাকরিতে আছেন তারা পদোন্নতি বঞ্ছিত, চাকুরিচ্যুতি সহ নিবর্তনের ঘটনা ঘটছে অহরহ। চরম রাজনৈতিক দুবৃত্তায়নের নিগড়ে বাঁধা পড়েছে দেশের সামরিক বেসামরিক প্রশাসন।
৮) মুজিব তার বিরোধীদের দমন করতে তৈরি করেছিলেন বিশেষ ক্ষমতা আইন। যারাই তার কুশাসন ও লুটপাটের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে, এই আইন প্রয়োগ করে কন্ঠ স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে। এমনকি নিয়মতান্ত্রিক বিরোধী রাজনীতিকদেরও কারাগারে পাঠানো হয় দেদারছে। আবদুল মতিন, আলাউদ্দিন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি মেজর জলিল, সম্পাদক আ.স.ম. আবদুর রব সহ অসংখ্য নেতা এবং কর্মী, জাতীয় লীগের অলি আহাদ সহ অনেককেই তিনি কারাগারে প্রেরণ করেছিলেন। সর্বহারা পার্টির প্রধান সিরাজ সিকদারকে ধরার পরে তারই নিদের্শে হত্যা করে তিনি পার্লামেন্টে দাড়িয়ে সদম্ভে উপহাস করেছিলেন- কোথায় আজ সিরাজ সিকদার? বিপ্লবী মতাদর্শী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীদের কথা বাদ দিয়েও তিনি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিকবোধ আস্থাশীল রাজনৈতিক দলগুলোর উপস্থিতিও বরদাশত করতে পারতেন না। গুলি চালিয়ে সমাবেশ ভেঙে দেয়া, পুলিশ ও রক্ষী বাহিনী দিয়ে রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নিয়ে শেষে বিশেষ ক্ষমতা আইনে বন্দী করা, এমনকি গুপ্তহত্যাও করা হতো। বাকশাল আইন জারী করে রাজনৈতিক দল ও বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেন, পত্রপত্রিকা নিষিদ্ধ করেন।
অন্যদিকে কন্যা শেখ হাসিনার অবৈধ শাসন, লুটপাট ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে কেউ যেনো কথা বলতে না পারে, সেজন্য তিনি তৈরি করেন তথ্য প্রযুক্তি আইন। এতে বাক স্বাধীনতা এমনভাবে কন্ট্রোল করা হয়েছে, যা বাকশাল আমলেও ছিল না। পত্রিকায় বা সামাজিক মাধ্যমে সরকার বিরোধী কিছু লিখলেই তাকে ঢোকানো হয় ডিজিটাল আইনে মামলা বা ভূতুড়ে মামলায়। গুম খুন মিথ্যা মামলায় বিরোধী মতাবলম্বীদের জর্জরিত করা হয়েছে। বিএনপির বহু নেতাদের নামে ৩’শ/ ৪’শ মামলা। চার বারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় কারাগারে আটকে রেখেছে। বিরোধীদলের ৩৫ লক্ষাধিক মানুষ হয়রাণীমূলক মামলায় পড়ে হাঁসফাস করছে। হাসিনার আমলে এদেশে ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এখনকার বাংলাদেশে স্বাধীনভাবে ইসলাম ধর্মচর্চা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষা সংকুচিত করা হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে, কওমী মাদ্রাসায় সরকারী অনুদান বন্ধ করা হয়েছে, দাড়ি টুপির উপর হামলা হচ্ছে দলীয়ভাবে, ওয়াজ মাহফিল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে প্রশাসন দিয়ে, ইসলামী জঙ্গির নামে আলেমদেরকে ভয়ভীতির উপরে রাখা হয়েছে। শাপলা চত্তরে আলেম ওলামা হত্যাকান্ডের ইতিহাস তো রইলই। পক্ষান্তরে, এদের আমলে হিন্দু জনসংখ্যা বেড়েছে ৩-৪ ভাগ। এরা ভারত থেকে এসে এদেশে বসবাস শুরু করেছে। সংখ্যাগুরু মুসলমানদেরকে মাইনরিটি ট্রিটমেন্ট করা হচ্ছে।
৯) দেশ স্বাধীনের পরে মুজিবের আমলে প্রতিদিনই ব্যাংক ডাকাতি এবং লুট হতো। ৭৯টি ব্যাংক লুটের খবর ছাপা হয়েছিল একটি কাগজে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর পুত্র কামাল নিজে ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। মুজিবের অতি আদরের ভাগ্নে শেখ মনি শূন্য থেকে তিনটি পত্রিকার মালিক হয়েছিলেন, অল্প সময়ে অনেক সহায় সম্পদ করেছিলেন, ভাই শেখ নাসের লুটপাট করতেন খুলনা অঞ্চল, অন্যদিকে বরিশাল অঞ্চলের মালিক হয়ে করে খাচ্ছিলেন ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাদ এবং তার ছেলেরা। এর বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলেই টুটি চেপে ধরত প্রাইভেট ও সরকারী কিলার বাহিনী।
অন্যদিকে হাসিনার আমলে রাষ্ট্রীয় রিজার্ভ লুট করা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের বেশিরভাগ ব্যাংক লুটপাট করে অচল করে ফেলেছে সরকারী দলের লোকেরা। সেই সাথে কয়েক বছর পর পর শেয়ার মার্কেট লুট করা হয়। লুটেরাদেরকেই সরকারের বড় বড় দায়িত্বে বসিয়ে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। বিভিন্ন প্রকল্পের খরচ ৫/১০ গুণ দেখিয়ে ব্যাপকভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট করে বিদেশে পাচার করছে ক্ষমতাসীনরা, এতে করে রাষ্ট্রীয় বাজেটের অর্ধেকেরও বেশি তাদের পেটে। তাদের নিজেদের হিসাবেই দেশের ৯ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। দেশের মানুষ জানে বাংলাদেশের সকল দুর্নীতি ও লুটপাটের সাথে জড়িত শেখ পরিবার ও দলীয় নেতারা। ক্যাসিনো ধরে টান দিলে বেরিয়ে আসে মারাত্মক দুর্গন্ধ। মন্ত্রী ও পদাধিকারী ছাড়াও লীগ নেতারা শত কোটি থেকে হাজার কোটি টাকা মালিক। সবচেয়ে যে কম কামিয়েছে সেও শতকোটি টাকার মালিক হয়েছে। ২০০৬ সালের শেষে দেশের বৈদেশিক ঋণ ছিল যেখানে ২১ বিলিয়ন ডলার, হাসিনা রাজত্বে সেটা বানিয়েছে ১২৫ বিলিয়ন ডলারে। এরা বাংলাদেশকে দেউলিয়ার খাতায় নাম ঢুকিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়েছে।
১০) শেখ মুজিবের সময়ে বিরোধী রাজনীতি দমনের কাজে নামানো হয়েছিল লাল বাহিনী নীল বাহিনী। বাংলাদেশের প্রতিটি ভোর হতো শ’খানেক লতুন লাশ দিয়ে। আহমদ ছফা সেকথা প্রকাশ করেছিলেন এভাবে___“বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী দমন করার নামে সরল মানুষদের পাখির মত গুলি করে, গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। শেখ মুজিব বিরোধী কোন কিছুর আভাস পাওয়ামাত্রই রক্ষীবাহিনী আগ্নেয়াস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে ছুটে গেছে। সবকিছু জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে, ভেংগে-চুড়ে তছনছ লন্ড-ভন্ড করে দিয়েছে।”
অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকতে গিয়ে গুম, খুণ ও মামলার দ্বারা বিরোধী রাজনীতিকে পঙ্গু করে ফেলেছেন হাসিনা। কার্যত দেশটি এখন পুলিশী রাষ্ট্র, যেখানে নাগরিকরা ডাকাতের ভয় করেনা, কিন্তু মাঝরাতে সাদা পোষাকী সরকারী বাহিনীর ঠক ঠকে ভয় পায়। কাকে কখন ধরে নিয়ে যায়, কে কখন লাশ হয় বা গুম হয়, তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। এখন সরকার যেনো একটি হিংস্র জানোয়ারের নাম। ক্ষমতা ধরে রাখতে কৃত্রিম জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করে তা আবার দমনের নামে বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদের দেশ হিসাবে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত করিয়েছেন শেখ হাসিনা।
দেশের প্রায় প্রতিটি সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান ধংস করে দেয়া হয়েছে। প্রধান বিচারপতিকে মারধর করে দেশান্তরী করে বিচার ব্যবস্থা পুরোপুরি দখলে নিয়েছেন, নির্বাচন ব্যবস্খা ধংস করেছেন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে শুরু করে সরকারের সকল নিয়োগ দলীয়করণ করেছেন, পুলিশ র্যাবের চুড়ান্ত রাজনৈতিক অপব্যবহার দেশটাকে ধংসের মুখোমুখি দাড় করিয়েছে।
১১) পিতা শেখ মুজিবের আমলে লাগামহীন লুটপাট, পারমিটবাজির ফলে দেশে জুড়ে দুর্ভিক্ষে ১ মিলিয়নের মত মানুষ মারা যায়। আন্তার্জাতিকভাবে বাংলাদেশ পরিচিতি পায় তলাবিহীন ঝুড়ি এবং বাসন্তীর জালের দেশে। নাগরিক জীবনের সর্বত্র বিরাজ করত আতঙ্ক। গ্রাম-বাংলার মানুষ পৌছেছিল দুর্দশার শেষ প্রান্তে, যেখানে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের দাম প্রতিদিন হু হু করে বাড়ছিল; অভাব, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ক্ষুধার তাড়নায় মা সন্তান বিক্রি করেছে, স্বামী স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেছে, বিনা কাফনে লাশ কবরে নেমেছে, সৎকারবিহীন অবস্থায় লাশ শৃগাল-কুকুরের আহার্য হওয়ার জন্য পথে পথে পড়ে থেকেছে। চারদিকে জ্বলন্ত বিভীষিকা, চারদিকে হা-অন্ন, হা-অন্ন রব। এই অন্নহীন বস্ত্রহীন মানুষের দংগল একমুঠো ভাত, এক ফোটা ফেনের আশায় ঢাকা শহরে এসে শহরের ফুটপাতে চিৎ হয়ে মরে থেকেছে।
একদিকে উদ্ধত উলংগ স্বৈরাচার, অন্যদিকে নির্মম দারিদ্র, বুভুক্ষা এই দুইয়ের মাঝখানে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে অতি কষ্টে, অতি সন্তর্পণে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হচ্ছিল। অর্থনৈতিক অন্তর্দাহের আঁচ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতেও লেগেছিল, বেশিরভাগ পরিবার মাছ-মাংস ভুলে গিয়েছিল। কোনো কোনো পরিবারের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অথচ শেখ মুজিবুর রহমানের শাসন ক্ষমতার সংগে যাঁরা যুক্ত, তাদের সুযোগ-সুবিধের অন্ত নেই- তাঁদের হাতে টাকা, ক্ষমতা সবকিছু যেন স্বাভাবিক নিয়মে কেন্দ্রীভূত হচ্ছিল। আইন তাদের ধন-সম্পদ বৃদ্ধির সহায়, সরকারি আমলারা আজ্ঞাবহ মাত্র, সামাজিক সুনীতি, ন্যায়-অন্যায়, নিয়ম-কানুন কোন কিছুর পরোয়া না-করলেও তাঁদের চলে (ছফা)। যার পরিসমাপ্তি ঘটে ১৫ আগষ্টের বিপ্লবের মধ্য দিয়ে।
টানা এক দশকের বেশি ক্ষমতায় থেকে দেশের অর্থনীতির সর্বনাশের শেষ সীমায় নিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা। ব্যাংকে টাকা নাই, বিনিয়োগ বন্ধ, লুটপাটকারীরা পাচার করে দেশ খালি করে বিদেশে ভারী করেছে ব্যাংক হিসাব। একদিকে কৃষকরা ধানের দাম না পেয়ে ক্ষেতে আগুণ দেয়, অন্যদিকে পেঁয়াজের কেজি খেতে হয় ৩০০ টাকায়। মাছ তরকারী সহ নিত্যপণ্যের দাম এবং যানবাহনের ভাড়া বেড়েছে ১০ গুণ। মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে চরমে। কৃত্রিমভাবে মাথাপিছু আয়ের ফিগার বাড়িয়ে মধ্যম আয়ের দেশের গল্প শোনানো হলেও সংখ্যাগরিষ্ট জনগন কাটাচ্ছে নিরব দুর্ভিক্ষের মধ্যে।