‘ছাত্রলীগের’ দেশে র্যাব-পুলিশের কী দরকার!
আমাদের সরকার শুধু শুধু পুলিশ-র্যাব-আর্মির পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ করে। এত টাকা অকারণে নষ্ট না করে ছাত্রলীগের পেছনে ঢাললেই হয়। পুলিশ কি শিবির ধরতে পারে? অভিযান চালিয়ে এ পর্যন্ত কয়জন শিবির কর্মীকে গ্রেফতার করেছে র্যাব? অথচ ছাত্রলীগকে দেখুন, দেশ ও সমাজকে শিবিরের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে গভীর রাত জেগে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে অভিযান চালায়, কাউকে সন্দেহ হলেই জিজ্ঞাসাবাদ করে, গেস্টরুমকে টর্চার সেল বানিয়ে ফেলে। পুলিশের ইনফর্মার তো সব দুই নাম্বার, ছাত্রলীগের ইনফরমেশনে কোন ভুল থাকে না। মাঝেমধ্যে বুয়েটের আবরারের মতো দুয়েকটা ঘটনা ঘটে যায়, তাতে কী! বৃহৎ স্বার্থে এরকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বলিদান দিতে হয়, এটাকে ইস্যু বানানোর কিছু নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে শিবির সন্দেহে চার ছাত্রকে বেধড়ক পিটিয়েছে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। তারপর তাদের পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে, কয়েক ঘন্টা আটক রাখার পরে শিবির সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায় পুলিশ তাদের ছেড়েও দিয়েছে। ছেলেগুলোর কপাল খারাপ, মার খেয়ে তারা প্রাণে বেঁচে আছে, তাই এই খবরটা নিয়ে শোরগোল নেই কোথাও, নেই প্রতিবাদের ঝড়। আবরারের মতো মরে গেলে হয়তী খানিকটা সিম্প্যাথি পাওয়া যেতো, টক-শো’র আলোচ্য বিষয়বস্তু হয়ে উঠতে পারতো ঘটনাটা।
বিবিসি বাংলায় পড়লাম, শিবিরকর্মী সন্দেহে রাত ১১টার দিকে দ্বিতীয় বর্ষের দুইজন ছাত্র মুকিম চৌধুরী এবং আফসার উদ্দীনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গেস্টরুমে ডেকে নেয় হল শাখা ছাত্রলীগের দু’জন নেতা। পরে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র সানোয়ার হোসেন এবং মিনহাজউদ্দীনকেও ডেকে নেয়া হয়। তাদেরকে হলের বর্ধিত ভবনে নিয়ে গিয়ে প্রথমে চড়-থাপ্পড় মারা হয়, পরে রড ও ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে পেটানো হয়। এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের অন্য নেতৃবৃন্দ এবং হলের আবাসিক শিক্ষকেরা এসে পৌঁছালে ছাত্রদের শাহবাগ থানায় হস্তান্তর করা হয়।
কয়েকটা প্রশ্ন করি এবার। এই চার ছাত্রকে যারা যারা পিটিয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল্লাহ আব্বাসী অনন্ত। তিনি গণমাধ্যমের কাছে দাবী করেছেন, এই ছাত্রদের শিবির সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ তারা পেয়েছিলেন বলেই পুলিশের তাদের কাছে হস্তান্তর করেছেন তারা। প্রমাণগুলোও নাকি পুলিশের কাছে দিয়েছেন তারা। তাহলে প্রমাণ থাকা স্বত্বেও পুলিশ সেই ছাত্রদের ছেড়ে দিলো কেন? শিবির সন্দেহে কাউকে রড, লাঠি এবং হাতুড়ি দিয়ে পেটানোর অধিকার সাইফুল্লাহ আব্বাসী অনন্তকে কে দিয়েছে? কোন ক্ষমতার বলে ছাত্রলীগ নেতারা ধরাকে সরা জ্ঞান করে সাধারণ ছাত্রের গায়ে হাত তোলেন?
বুয়েটে আবরারকে নির্মমভাবে পেটানো হয়েছিল শিবির সন্দেহে। আবরার মারা গিয়েছিল বলে ঘটনাটা সবার নজরে এসেছিল। নইলে বুয়েট বলুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বলুন, কিংবা দেশের অন্য কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়- ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের অত্যাচারের গল্পটা সব জায়গাতেই একই। কাউকে পেটাতে ইচ্ছে হলেই এরা শিবির তকমা দিয়ে মারধর করে, তাহলেই পুরো ঘটনাটাকে অন্যরকম একটা রঙ দেয়া যায়। সব ক্রসফায়ার আর এনকাউন্টারের গল্প যেমন একরকম, শিবির সন্দেহে ছাত্র নির্যাতনের সব গল্পও একই, কোন নতুনত্ব নেই সেখানে।
এই প্রশ্নটা বারবার ওঠে, শিবির হলেই কি কাউকে বেধড়ক পেটানোটা জায়েজ? তাকে রড, স্ট্যাম্প আর লাঠি দিয়ে মারধর করা জায়েজ? এই অধিকার ছাত্রলীগ কোথায় পেয়েছে? দেশে আইন আছে, আদালত আছে, আইনের প্রয়োগ করার জন্যে পুলিশ আছে। কেউ শিবির করে বা কেউ জঙ্গী কার্যক্রমে যুক্ত, এমন সন্দেহ হলে তাকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করা যায়, তারা তদন্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে। ছাত্রলীগকে আইন হাতে তুলে নেয়ার ভার কে দিয়েছে? ছাত্রলীগই যদি সব করে, র্যাব-পুলিশ দেশে আছে কিজন্যে? এসব প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায় না শুধু…
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর কিংবা সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের প্রাধ্যক্ষ- কেউই জানেন না ছাত্র নির্যাতনের কথা! তাদের নাকের ডগায় তিন ঘন্টার বেশি সময় ধরে চার জন ছাত্রকে মারধর করা হলো, মিডিয়া জানলো, দেশের মানুষ জানলো, তারা জানতে পারলেন না সেটা! পদের নেশায় মেরুদণ্ড বর্গা দিয়ে রাখলে যা হয় আরকি, উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে ‘কিচ্ছু হয়নি’ বলে চিৎকার করলেই কি আর ঝড় থামে? আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে এরকম মেরুদণ্ডহীন মানুষেরা শীর্ষ পদগুলো আঁকড়ে বসে আছে, এটা ভাবতেও লজ্জা লাগে!
আরও মজার ব্যাপার শুনবেন? এই ঘটনার পরে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান বলেছেন, তিনি জানতে পেরেছেন যে শিবিরসংশ্লিষ্টতা থাকায় চার ছাত্রকে থানায় দেওয়া হয়েছে। তবে তাদের মারধর করা হয়েছে কি না, সেটা তার জানা নেই। তিনি বলেন, কারও ওপর শারীরিক আঘাত কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই আল নাহিয়ান খান জয়ের বিরুদ্ধেই ‘শিবির সন্দেহে’ চার ছাত্রকে হলের ছাদে নিয়ে পেটানোর অভিযোগ আছে। ঘটনাস্থল একই, সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, নাহিয়ান তখন ছিলেন হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। রড ও স্ট্যাম্প দিয়ে সেই ছাত্রদের এমন বর্বরের মতো মারা হয়, যে সেই শিক্ষার্থীদের আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি করতে হয়েছিল।
যে ছাত্র সংগঠনের সভাপতির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ থাকে, তার সংগঠনের নেতা-কর্মীরা শিবির তকমা দিয়ে যাকে তাকে পেটাবেন, তাতে আর অবাক হবার কী আছে! আবু বকর-হাফিজুর-এহসানেরা বিচার পায়নি, ভিপি নূরের ওপর হামলার সিসিটিভি ফুটেজ হারিয়ে গেছে, এভাবেই চলবে সব। এসব মারধর তো আর বন্ধ হবে না, আবরারের মতো দুয়েকজন মারা না গেলে প্রতিবাদ হবে না, আলোচনার ঝড় উঠবে না। দু’দিন পরে আবারও ‘শিবির সন্দেহে’ নির্যাতনের ঘটনা ঘটবে, চাপা পড়ে যাবে, আবার ঘটবে, চাপা পড়ে যাবে, এটাই বুঝি এই ঘটনার জীবনচক্র!