২৫ জানুয়ারি বাকশাল প্রতিষ্ঠা দিবস।
মারুফ কামাল খান সোহেল : ১৯৭৫ সালের এই দিনে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান দেশে একদলীয় বাকশাল শাসন-পদ্ধতি কায়েম করেন। সংসদে কোনো আলোচনা বা বিতর্কের সুযোগ না দিয়ে মাত্র এগারো মিনিটে একটি বিল পাশের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সংবিধানের মৌলিক রদবদল করা হয়। এটি চতুর্থ সংশোধনী নামে পরিচিত। শেখ সাহেব এর নাম দিয়েছিলেন ‘দ্বিতীয় বিপ্লব।’ তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশে নিজস্ব ধাঁচের সমাজতন্ত্র বা শোষিতের গণতন্ত্র কায়েম হবে।
মারুফ কামাল খান সোহেল
এই পরিবর্তনে দেশে একটি মাত্র দল বাকশাল ছাড়া সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়। এই বাকশাল-কে জাতীয় দল বলে উল্লেখ করা হয়। আওয়ামী লীগকে চালকের আসনে রেখে স্বদেশী ধারার সমাজতন্ত্র কায়েমের এই প্রকল্পে তখনকার সোভিয়েত রাশিয়াপন্থী সিপিবি ও ন্যাপ-মোজাফফর সহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল শামিল হয়। তারা এই পরিবর্তিত ব্যবস্থাকে সমর্থন করেই এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়। অবশ্য এইসব দলের কাউকে নেতৃস্থানীয় কোনো ভূমিকা বা উল্লেখযোগ্য পদ-পদবি দেয়া হয়নি।
তবে সাম্প্রতিকালে সিপিবি থেকে বলা হয়েছে যে, তাদের দলের বা তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে একদল করায় প্রণোদনা দেয়া হয়নি বরং তাদের দলীয় একটি টিম শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা করে একদল না করার পরামর্শ দিয়েছিল, তিনি শোনেননি। তাই সিপিবি বাকশালে যোগ দিলেও দলের একটি ক্ষুদ্র কাঠামোর অস্তিত্ব গোপনে রেখে দিয়েছিল। এতদসত্বেও বাকশালে যোগ দেয়াটা সিপিবির ভুল হয়েছিল বলে পরবর্তীকালে তাদের দলীয় মূল্যায়ন।
যা-হোক, যে এমপিরা একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর বাকশালে যোগ দেননি তারা সংসদ সদস্যপদ হারান। এই পরিবর্তনের সঙ্গে যুগপৎ ভাবে সংসদ ও সরকারের মেয়াদ ভোট ছাড়াই বাড়ানো হয়। নির্বাচন ছাড়াই শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত করে বলা হয়, তিনি রাষ্ট্রপতি পদে এমন ভাবে অধিষ্ঠিত হবেন, যেন তিনি নির্বাচিত।
বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ অবাধ নির্বাচন ব্যবস্থা এবং নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের পদ্ধতিও বিলুপ্ত হয়ে যায়। মিলিটারি, পুলিশ, বিডিআর, আমলাতন্ত্রের লোকদেরও বাধ্যতামূলকভাবে বাকশাল সদস্য করা হয়। জেলায় জেলায় একদলীয় বাকশাল মনোনীত ব্যক্তিকে গভর্নর পদে বসিয়ে নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু হয়।
জনগণের নাগরিক স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রহিত করা হয়। সকল সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত কেবল চারটি মাত্র দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়। বাকশাল-এ যোগ দিতে অস্বীকৃত সাংবাদিকদের চাকরি চলে যায়। যোগদানকারী সাংবাদিকদের যাদের চার পত্রিকায় চাকরি দেয়া যায়নি তাদেরকে পেশাচ্যুত করে অন্য চাকরিতে পুনর্বাসন অথবা জীবিকাভাতা দেয়া হয়।
স্বাধীনতার পর থেকেই আওয়ামী লীগের ধ্বনি ছিল: ‘একনেতা একদেশ- বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ।’ তারা শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক ভাবনা ও কর্মসূচিকে ‘মুজিববাদ’ নাম দিয়ে প্রচার চালাতে থাকে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে বইপত্রও লেখানো হয়। মুজিববাদ-বিরোধী কোনো মতামত বাংলাদেশে চলতে দেয়া হবেনা বলে হুমকি আসতে থাকে। তারা দাবি তোলে, দেশে আইনের শাসন নয়, মুজিবের শাসন কায়েম করতে হবে। একনেতাকেন্দ্রিক এই ভাবনাই অনিবার্যভাবে আওয়ামী লীগকে একদলীয় চিন্তার দিকে ধাবিত করে।
একদল কায়েমের আগে রক্ষীবাহিনী ও দলীয় নানান সন্ত্রাসী বাহিনীর মাধ্যমে বিরোধীদলের ওপর চরম নির্যাতন চালানো হয়। ভিন্নমতের নেতাকর্মী বিশেষ করে চীনঘেঁষা বামপন্থী ও বিদ্রোহী আওয়ামী তরুণদের সমন্বয়ে গড়া জাসদের লোকজন ব্যাপকভাবে গুম, খুন, হামলা, মামলা, শারিরীক নির্যাতন ও বন্দীত্বের শিকার হন। ভিন্নমতের সংবাদপত্রের প্রকাশনা নিষিদ্ধ ও সাংবাদিকদের গ্রেফতার করা হয়। সব শেষে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেয়া হয় আনুষ্ঠানিকভাবে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে মুজিববাদ পুরোপুরি কায়েম করে। স্বাধীনতার পর আওয়ামী সরকার ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচন করলেও সেই নির্বাচনী ইশতেহারে একদলীয় পদ্ধতি প্রবর্তনের কোনো আভাস দেয়নি এবং এ ব্যাপারে জনগণের কোনো ম্যান্ডেট বা অনুমোদনও নেয়নি।
জনগণের সম্মতিহীন এই বাকশাল বা মুজিববাদ একবছরও টেকেনি। বাইরের কেউ নয়, বাকশালের অন্তর্ভুক্ত একটি নেতৃস্থানীয় অংশ সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদের একটি অংশের মাধ্যমে রক্তক্ষয়ী পরিবর্তন ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। এই পরিবর্তনে সংবিধান স্থগিত ও একদলীয় বাকশাল পদ্ধতি বাতিল ঘোষণা করা হয়। পরে আরো কিছু ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর পুনরুজ্জীবন ও বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার প্রবর্তনের ধারার পুনঃ প্রবর্তন করেন।
সময়ের পরিক্রমায় ফিরে আসা ২৫ জানুয়ারির এই বাকশাল প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আজ অনেক নাগরিকের মনে প্রশ্ন, ১৯৭৫ সালে সংবিধান বদল করে সংসদের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন কি এখনকার চেয়ে বেশি বিপজ্জনক ছিল? বিপন্ন নাগরিকদের মনে জ্বলন্ত জিজ্ঞাসা: ঘোষিত নাকি অঘোষিত বাকশাল বেশি ভয়ঙ্কর?✍