পাকিস্তানের মাটিতে বেজে উঠল ‘আমার সোনার বাংলা’
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে ফিরলেন স্বাধীন বাংলাদেশে। ব্রিটিশ এয়ার ফোর্সের বিশেষ বিমানে বঙ্গবন্ধুর সহযাত্রী হয়েছিলেন তৎকালীন ভারতীয় কূটনীতিক শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি। তার স্মৃতিচারণেই উঠে এসেছে কীভাবে রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা কালজয়ী গান আমার সোনার বাংলা হয়েছিল রক্তস্নাত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত।
বঙ্গবন্ধু জানালা দিয়ে শ্বেতশুভ্র সাদা মেঘের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর দাঁড়িয়ে গাইতে লাগলেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’। তাঁর চোখ ভরে উঠেছে জলে। শশাঙ্ককে অবাক করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘এ গানটি হবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। কেমন হবে বলেন তো?’ শশাঙ্ক জবাব দিলেন, ‘ইতিহাসে তাহলে প্রথমবারের মতো দুটি দেশের জাতীয় সংগীতের লেখক হবেন একই ব্যক্তি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’
পাকিস্তানের লাহোরে আজ বেজে উঠলো বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত আমার সোনার বাংলা। নিরাপত্তা ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান সফরে যাওয়া বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জন্যই আজ গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে এমন দৃশ্যের অবতারণা হলো। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতকে শ্রদ্ধা জানাতে গ্যালারি ভর্তি দর্শক দাঁড়ালো উঠে; যেন অলক্ষ্যে থেকে বিজয়ের হাসিতে ভরে উঠলো অগণিত শহীদের আত্মা। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী এবং মুজিববর্ষের আবহে এই ঘটনায় রোমাঞ্চিত গোটা বাংলাদেশের মানুষ।
ইতিহাসের প্রতিশোধ বড়ই নির্মম হয়, এ কথাই যেন আজকের এই ঘটনা আরও একবার আঙুল তুলে সবাইকে দেখিয়ে দিলো। দীর্ঘ ৯ মাস ধরে চলা মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের মিয়ানওয়ালী কারাগারে নির্জন প্রকোষ্ঠে বন্দী অবস্থায় ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই ৩৩৭ কিলোমিটার দূরে পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে বেজে উঠল আমার সোনার বাংলা। নিয়তির নির্মম পরিহাস, লিবিয়ার ক্ষমতাচ্যুত শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির অর্থায়নে যে স্টেডিয়াম, যার নামকরণে এই স্টেডিয়াম, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেয়া ইতিহাসের এক খলনায়ক।
অথচ বাঙালি জাতীয়তাবাদকে মাথা তুলে না দাঁড়াতে দেয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথের লেখা ও গানকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য কত চেষ্টাই না করেছিল পাকিস্তান আমলের শাসক শ্রেণি। ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করা হলো আইয়ুব খান সরকার ও তার দোসররা।
১৯৬৫ ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের সময় রেডিও পাকিস্তান থেকে রবীন্দ্র সংগীতের প্রচার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন যেন শত্রু দেশের এক কবি। ১৯৬৭ সালের ২৩ জুন পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী ঢাকার নওয়াব বংশোদ্ভূত খাজা শাহাবুদ্দিন বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্র সংগীত প্রচার নিষিদ্ধ করে ঘোষণা দিল, ‘রবীন্দ্র সংগীত আমাদের সংস্কৃতি নয়। ভবিষ্যতে রেডিও পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পরিপন্থী রবীন্দ্র সংগীতের প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং এই ধরনের অন্যান্য গানের প্রচার কমিয়ে দেয়া হবে। ঢাকার দৈনিক পকিস্তান পত্রিকায় এই খবর প্রকাশিত হয়।
১৯৭০ সালের গোড়ার দিকে বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী জাহিদুর রহিমকে দায়িত্ব দেন ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের রেকর্ড প্রকাশের জন্য। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের রেকর্ড প্রকাশে ছায়ানটের শিল্পীরাও এগিয়ে আসেন। কলিম শরাফীর ব্যবস্থাপনায়, আবদুল আহাদের পরিচালনায়, সনজীদা খাতুনের বাসায় তারই যত্ম-আত্তিতে খাটুনিতে তৈরি হয় গানটি। সম্মেলক কণ্ঠে ছিলেন, জাহিদুর রহিম, অজিত রায়, ইকবাল আহমদ, ফাহমিদা খাতুন,জাহানারা ইসলাম, হামিদা আতিক, নাসরীন আহমদ প্রমুখ। সর্বত্র বাজতে থাকে এই রেকর্ড। অসহযোগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধকালে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের কণ্ঠে এই গান ধ্বনিত হতো। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে শিল্পী কলিম শরাফী রমনা রেসকোর্সে লাখো লাখো জনতার উপস্থিতিতে আমার সোনার বাংলাসহ রবীন্দ্র সংগীতের এক সেট গানের রেকর্ড উপহার দিয়েছিলেন সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিজয়ী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে।
১৯৭০ সালে জহির রায়হান তার ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি ব্যবহার করেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় দিকে দিকে বেজে ওঠে ‘আমার সোনার বাংলা’। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই ভবিতব্য বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে জনগণ ‘আমার সোনার বাংলা’কে নির্বাচন করেছিল।