জহির রায়হান: হারিয়ে যাওয়া মানিক
মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন:
জহির রায়হান ও শহীদুল্লা কায়সার দুই সহোদর। পিতা-মাতার পাঁচ পুত্র আর তিন সন্তানের মধ্যে শহীদুল্লা কায়সার দ্বিতীয় । আর জহির রায়হান তৃতীয়। দুই ভাই’ই দেশবাসীর কাছে এতোই সম্মানিত ও দেদীপ্যমান যে, তাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই। বড়ভাই শহীদুল্লাহ কাওসার সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক ও লেখক। আর জহির রায়হান আরো বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী Ñ সাংবাদিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, ঔপনাসিক, চলচ্চিত্র অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক Ñ যার অবদান বড়ভাইকে ছাড়িয়ে গেছে, যার খ্যাতি বিশ্বময়।
জহির রায়হান ও শহীদুল্লা কায়সারদের পরিবারের ঘনিষ্ঠজনদের সাথে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপ করে জহির রায়হান সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছি। দুই ভাইয়ের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে তাদেরই একজন বলেন: জহির রায়হান হলেন জন্মগতভাবে জিনিয়াস Ñ ধীশক্তি/প্রতিভাসম্পন্ন। আর শহীদুল্লা কায়সার হলেন অর্জিত প্রতিভার অধিকারী।
তিনি বলেন, সাহিত্য, দেশ, সমাজ ও জীবনের উপর জহির রায়হানের যথেষ্ঠ সচেতনতা ও দখল ছিল। তাই দেশ, সমাজ ও জীবনের প্রয়োজনীয়তা ও অভাব তার সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে প্রতিফলিত হয়েছে।
ওই ঘনিষ্ঠজনদের সাথে আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছিল দিনের পর দিন মাসের পর মাস । প্রতি সপ্তাহে একদিন, কোন কোন সপ্তাহে দুই দিন ঘন্টার পর ঘন্টা। কথা হয়েছে হারানো মানিক জহির রায়হান সম্পর্কে তার উধাও হওয়া তথা হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কে। এটা আমার জন্য ছিল অনন্য সুযোগ। আমার সৌভাগ্য। বলতে বাধা নেই: আল্লাহর রহমত। কারণ অনেক অজানা তথ্য তারা আমাকে জানিয়েছেন যা আমাদের জাতির জন্য অতন্ত্য গুরুত্বপূর্ণ অনন্য দলিল। তবে ওইসব তথ্য সবিস্তার তুলে ধরা চলমান লেখার উদ্দেশ্য নয়। আল্লাহ’র রহমতে একই শিরোনামে একটি বই প্রকাশের ইরাদা আছে।
দুই ভাই’ই ১৯৭১ সালে জীবন দিয়েছেন। শহীদুল্লাহ কায়সারকে ঘর থেকে তুলে নেয়া হয় ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে । তিনি আর ফিরে আসেন নি। তিনি শহীদ বুদ্ধিজীবীদেরই একজন। আর জহির রায়হান স্বদেশেই দেশী-বিদেশী চক্রান্তের শিকার। তাকে উধাও করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশে Ñ ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারী। আমাদের দুর্ভাগ্য ওই সময়ে ৩৬ বছর বয়সী জহির রায়হানের ভাগ্যে কী হয়েছে তা কেউ জানে না। তাকে কি মেরে ফেলেছে, নাকি তিনি আজো জীবিত?। তাকে খুন করা হলে কারা কখন কোথায় কীভাবে কেমন নির্যাতন চালিয়ে তাকে খুন করা হয়– তাও অজানা । বলা হচ্ছে ৩০ জানুয়ারী তিনি মিরপুরে বিহারী-রাজাকারদের সাথে সংঘর্ষে তিনি মারা গেছেন। এই প্রচারনা যে ডাহা মিথ্যা তার প্রমাণ ওই সংঘর্ষে তিনি শহীদ হলে তার লাশ কোথায় গেল? তাকে কোথায় কবর দেয়া হয়েছে? তার মৃত্যুখবর কেন টিভি-রেডিও, কিংবা সংবাদপত্রে আসে নি?
জহির রায়হানের ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন মুুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতে অবস্থানকারী জহির রায়হান চিত্রনির্মাতা হিসেবে সারাক্ষণ ওই সময়ের ওপর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্রসহ বেশ কিছু কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যস্ত ছিলেন। তারা জানান ১৭ কলিকাতায় ছবি নির্মাণে ব্যস্ত জহির রায়হানকে লোকেশন থেকেই, বলতে দ্বিধা নেই জোর করেই, বিমানে তুলে দেয়া হয়। তাকে তার স্ত্রী-পুত্রদের সাথেও দেখা করতে বাসায় যাবার সুযোগ দেয়া হয় নি। তাকে চলচ্চিত্রের ক্যানগুলোও আনতে দেয়া হয় নি। একেবারে ধারণার বাইরে আচমকা ঢাকায় চলে যেতে বাধ্য করার মধ্যেই তার উধাও হবার রহস্য জড়িত। তাকে উধাও করার জন্যই মূলত অদৃশ্য শক্তির ইশারায় তড়িগড়ি ঢাকায় আনা হয়।
ঢাকায় আসার পরেই মূল নাটক শুরু হয়। তার বড়ভাই শহীদুল্লা এখনো জীবিত এমন একটি বার্তা তাদের পরিবারের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়। ভাইয়ের খোঁজে জহির রায়হান অস্থির হয়ে পড়েন। তার মনে আশা ছিল তার ভাই বেঁচে আছেন। কারণ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অনেকের পোশাক রায়ের বাজার ও মিরপুরে পাওয়া গেেেলও শহীদুল্লা কায়সারের পোশাক পাওয়া যায় নি। তাকে শুনানো হয় তার বড়ভাই মিরপুরে পাকিস্তানী সৈন্য ও আলবদর-রাজকারদের কাছে আটক রয়েছেন এবং ওইখানে সেনাবাহিনী উদ্ধার অভিযান চালাবে। ভারতে জহির রায়হানের কোন ধরনের সামকির প্রশিক্ষণ না থাকা সত্বে তাকে মিরপুর থানায় যাবার জন্য দায়িত্বশীলমহল, এমনকি ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাও প্রলুব্ধ করেন। বারবার তাকে ফোন করেন অরোরা। এমনকি অরোরা নিজে জহির রায়হানকে মিরপুর নিয়ে যাবার কথাও বলেন। অরোরাই ঠিক করেন ৩০ জানুয়ারী তাকে মিরপুর নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু ২৯ জানুয়ারী রাতে অরোরা ফোন করে জানালেন তিনি জরুরী কাজে ওই রাতেই তিনি ভারত যাচ্ছেন। সুতরাং অন্যকেউ তাকে মিরপুর নিয়ে যাবে।
১৪ ডিসেম্বর এতোসব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হলো কিন্তু কারো স্বজনদেরকেই বলা হলো না তাদের অপহৃত স্বজন কোথায় আছেন, কিংবা অপহৃত হবার দেড় মাস পরেও মিরপুরে জীবিত বা আটক আছেন আটক আছেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জগজিৎ সিং অরোরা কেন জহির রায়হানকে জানালেন যে তার বড়ভাই শহীদুল্লা কায়সারকে এখনো হত্যা করা হয় নি। অরোরা কীভাবে কোন সূত্রে এমন খবর ফেলেন? অরোরা তার সাক্ষাৎকারে অথবা আলাপচারিতায় জহির রায়হান সম্পর্কে আর কখনোই কোন কথা বলেন নি, যা রহস্যময় এবং সন্দেহদোষেদুষ্টু।
জহির রায়হানের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা জানালেন ৩০ জানুয়ারী সকালে জহির রায়হানদের কাহিকটুলি বাসা থেকে শাহরিয়ার কবির এবং শাহরিয়ারের ছোটভাই জহির রায়হানের গাড়ি নিয়ে মিরপুর থানায় যান। তাদের সাথে তৎকালীন লেপ্টেনেন্ট ইব্রাহিমও (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম) ছিলেন। জহির রায়হানকে থানার ভিতর নেয়া হলেও শাহরিয়ার কবিরদেরকে থানার ভিতর না যেতে দেয়া হয় নি। তাদেরকে গাড়ি রেখে চলে যাবার জন্য বলা হলো।
ওই ঘনিষ্ঠজনরা জানান জহির রায়হানকে থানায় রেখে শাহরিয়ার তার ছোটভাইকে নিয়ে বাসায় পৌঁছলে পরিবারের সদস্যরা তাদেরকে বকাবকি করেন এবং তাদেরকে তাৎক্ষণিক মিরপুর থানায় ফিরে যাবার জন্য বলেন। তারা দ্ইুভাই পুনরায় মিরপুর থানায় গিয়ে জহির রায়হানকেও পান নি। তার গাড়িও সেখানে দেখেন নি। জহির রায়হান ও তার গাড়ি কোথায় জানতে চাইলে থানার লোকজন কোন খবর দিতে পারেন নি। (উল্লেখ্য, মাতৃহীন হওয়ায় শাহরিয়ার কবির ও তার ছোট ভাই জহির রায়হানদের চাচাতো ভাই এবং তারা দুইজনই শিশুকাল থেকেই ওই বাসায় বড় হন।)
পরে বলা হয়েছে জহির বিহারী রাজাকার-আলবদরদের সাথে সংঘর্ষে নিহত হন। তাহলে জহির রায়হানের গাড়ি কোথায় গেল ?
এই প্রসঙ্গে জহির রায়হানের প্রথম স্ত্রী সুমিতা দেবী বলেন: মিরপুরে জহির যে তাঁর প্রিয় মরিস অক্সফোর্ড গাড়িটি নিজেই ড্রাইভ করে বড় ভাইকে আনতে গিয়েছিলো, সেই গাড়িটি জহির অন্তর্ধানের এক সপ্তাহ পর ঢাকা বিশববিধ্যালয়ের টিএসসির সামনে এবং হাইকোর্টের আসে পাশে ঘুরতে দেখা গেছে।খবর নিয়ে জানা গেছে সেটি নাকি কোন প্রভাবশালী আওয়ামীলীগ নেতা’র ছেলে চালাচ্ছে! ভয়ে আর কোনো খবর নেইনি! ” (সুমিতা দেবীর সাক্ষাৎকার, দৈনিক আজকের কাগজ – ৮ ডিসেম্বর, ১৯৯৩)
অপ্রকাশিত নেতার ছেলে জহির রায়হানের গাড়ি কীভাবে পেলেন, ওই নেতার নাম কী তা জানা গেলে জহির রায়হানের নিখোঁজ কিংবা নিহত হবার রহস্য অনেকটাই বেরিয়ে আসতো । কিন্তু এই বিষয়ে সঠিক তদন্ত কখনোই হয় নি। তাই সবকিছু অজানাই থেকে গেল।
জহির রায়হান মিরপুর কথিত সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন তার পরিবার এই খবর বিশ্বাস করেন নি। এখানে শাহারিয়ার কবিরের সাথে চলচ্চিত্রকার ও সাহিত্যিক সত্যজিত রায়ের সাক্ষাৎটি তার প্রমাণ। ওই সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ:
– সত্যজিত রায় : জহিরের ব্যাপারটা কিছু জেনেছো?
– শাহরিয়ার কবির : তাকে সরিয়ে ফেলার পেছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আমরা ব্যক্তিগতভাবে তদন্ত করে যা বুঝতে পেরেছি তাতে বলা যায় ৩০ জানুয়ারি দূর্ঘটনায় তিনি হয়তো মারা যাননি। তারপরও দীর্ঘদিন তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন।
– সত্যজিত রায় : স্ট্রেঞ্জ ! জহিরকে বাঁচিয়ে রাখার পেছনে কারণ কি?
– শাহরিয়ার কবির : সেটাই ষড়যন্ত্রের মূলসূত্র বলে ধরছি। মিরপুর দূর্ঘটনায় তার মৃত্যু হলে গভীর ষড়যন্ত্র মনে করার কারণ ছিল না। আমি যতদূর জানি, বুদ্ধিজীবিদের হত্যার তদন্ত করতে গিয়ে তিনি এমন কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন যা অনেক রথী-মহারথীর জন্যই বিপজ্জনক ছিল, সেজন্য তাকে সরিয়ে ফেলার প্রয়োজন ছিল।
(সত্যজিত রায়-এর সাক্ষাৎকার / সাপ্তাহিক বিচিত্রা – ০১ মে, ১৯৯২)
জহির রায়হানদের অত্যন্ত কাছের এক আত্মীয় ঢাকা থেকে জানিয়েছেন ৩০ জানুয়ারী দুপুরের দিকে রাজারবাগে বসবাসকারী জহির রায়হানের জনৈকা আত্মীয়া তাদের গলি দিয়ে যাওয়া ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি জীপে জহির রায়হানকে দেখেছেন। ওই আত্মীয়া সাথে সাথে এই খবর তাদের পরিবারের সদস্যদেরকে জানান। ওটাই ছিল জহির রায়হানকে দেখা আত্মীয়-স্বজনদের শেষ দেখা। তার প্রশ্ন জহির রায়হান যদি মিরপুর যুদ্ধে মারা গিয়ে থাকেন তবে তাকে দুপুরের পর কীভাবে রাজারবাগের গলিতে ভারতীয় বাহিনীর জীপে দেখা গেল? তিনি আরো জানান ওই সময় রাজারবাগের পাশেই রেলওয়ের একটি বিশ্রামাগার ছিল। তার ধারণা হয়তো জহির রায়হানকে সাময়িকভাবে ওই রেস্টহাইজে রেখে পরে তাকে সরিয়ে ফেলা হয়। আমি এখনও বিশ্বাস করি ভারতই জহির রায়হানকে উধাও করে দুনিয়া হতে সরিয়ে দেয়।
জহির রায়হান হারিয়ে যাবার বেশ ক’মাস পরে তৎকালীনকালীন দৈনিক বাংলা’য় একটি খবর আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। ওই খবরে বলা হয়: জহির রায়হন মাদ্রাজের একটি কারাগারে আটক আছেন। জহিরকে কেন ভারত কিংবা অন্যকোন পক্ষ উধাও করবে তার বেশ কিছু কারণ আছে।
জহির রায়হানকে কেন সরিয়ে ফেলা হলো এই প্রসঙ্গে ৯নং সেক্টর কমান্ডার মরহুম মেজর এম.এ. জলিল লিখেছেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের আওয়ামীলীগ নেতাদের কুকীর্তি ফাঁস করে দিতে চাওয়ায় নিখোঁজ হন সাংবাদিক জহির রায়হান। ভারত অবস্থানকালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অনেক কিছুই জানতে চেয়েছিলেন স্বনামধন্য সাহিত্যিক এবং চিত্র নির্মাতা কাজী জহির রায়হান। তিনি জেনেছিলেন অনেক কিছু, চিত্রায়িতও করেছিলেন অনেক দুর্লভ দৃশ্যের। কিন্তু অতসব জানতে বুঝতে গিয়ে তিনি বেজায় অপরাধ করে ফেলেছিলেন। স্বাধীনতার ঊষালগ্নেই তাকে সেই অনেক কিছু জানার অপরাধেই প্রাণ দিতে হয়েছে। ভারতের মাটিতে অবস্থান কালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের চুরি, দুর্নীতি, অবৈধ ব্যবসা, যৌন কেলেংকারী, বিভিন্ন রূপ ভোগ-বিলাস সহ তাদের বিভিন্নমূখী অপকর্র্মের প্রমাণ্য দলীল ছিল- ছিল সচিত্র দৃশ্য। আওয়ামী লীগের অতি সাধের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কাজী জহির রায়হানের এতবড় অপরাধকে স্বার্থান্বেষী মহল কোন যুক্তিতে ক্ষমা করতে পারে? তাই বেঁচে থেকে স্বাধীনতার পরবর্তী রূপ দেখে যাওয়ার সুযোগ আর হয়নি জহির রায়হানের। (মেজর (অব:) এম এ জলিল, অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা, পৃ: ৩৯-৪০ )
জহির রায়হানের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে তার সহধর্মীনি চিত্রনায়িকা সুচন্দা বলেন, “জহির বেঁচে থাকা অবস্থায় সর্বশেষ প্রেসক্লাবে দাঁড়িয়ে এক বক্তব্যে বলেছিলেন, যারা এখন বড় বড় কথা বলেন, নিজেদের বড় বড় নেতা মনে করেন, তাদের কীর্তি কাহিনী, কলকাতায় কে কী করেছিলেন, তার ডকুমেন্ট আমার কাছে রয়েছে। তাদের মুখোশ আমি খুলে দেবো।’ এই কথা তিনি মুখ দিয়ে প্রকাশ্যে বলে ফেলার পরই তার উপর বিপদ নেমে আসে। এই বলাটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো।” দৈনিক আজকের কাগজ – ৮ ডিসেম্বর, ১৯৯৩)
পরবর্তী সময়ে জহির রায়হান নিরুদ্দেশ হওয়া নিয়ে নতুন তথ্য শোনা গেছে। বলা হয়েছে Ñ পাকিস্তানী হানাদার বা অবাঙালিরা নয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে ছিলেন এমন কেউ কিংবা তাদের পৃষ্ঠপোষক ভারত জহির রায়হানকে গুম ও খুন করেছে। প্রথম মহলের লক্ষ্য ছিল – বাংলাদেশকে স্বাধীন করা এবং সঙ্গে সঙ্গে বামপন্থী বুদ্ধিজীবিসহ সামগ্রিকভাবে বামপন্থী শক্তিকে নিঃশেষ করে দেয়া। এরা নাকি বামপন্থী বুদ্ধিজীবিদের হত্যার একটা তালিকা প্রণয়ন করেছিল। এদের ধারণা এ তালিকাটি জহির রায়হানের হাতে পড়েছিল। অনেকেই মনে করেন এটাও তার হারিয়ে যাবার অন্যতম কারণ হতে পারে। এদের মতে জহির রায়হান দ্বিমুখী শক্তির কোপানলে পড়েই হারিয়ে যান। একটি অজ্ঞাত আরেকটি অরোরায় তথা ভারত। কারণ তিনি ১৬ ডিসেম্বরের পর ভারতীয় বাহিনীর বাংলাদেশ লুটের বহর ক্যামেরাবন্দী করেছিলেন। ভারতের লোকেরাই মিরপুর নিয়ে যায়, যদিও তিনি মিরপুরে শহীদও হন নি। তাকে পরে খুন করা হয়েছে।
জহির রায়হানের বোন নাসিমা কবির নিখোঁজ জহির রায়হানের খোঁজে বড় বড় নেতাদের কাছে রাত-দিন পাগলের মত ছুটে গেছেন। ১৯৭২ সালে পত্রিকাগুলোতে বেশ লেখালেখি শুরু হয়। যে রফিকের ফোন পেয়ে জহির রায়হান ঘর থেকে বের হয়ে যেন, সেই রফিককে একদিন হঠাৎ করে সপরিবারে আমেরিকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। জহির রায়হানের বড় বোন নাসিমা কবিরকে ডেকে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান সরাসরি বললেন – “জহিরকে নিয়ে বেশি চিৎকার করলে তুমিও নিখোঁজ হয়ে যাবে” (নাসিমা কবিরের সাক্ষাতকার, দৈনিক আজকের কাগজ, ৮ ডিসেম্বর ১৯৯৩)।
তার ঘনিষ্ঠজনদের একজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন: স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরেও জহির রায়হানের ব্যাপারে কোন মহলেরই নিস্পৃহ আচরণ। কেউ যেন তার খোঁজ রাখল না। আমরা ঘাতক দালাল নির্মূলের কথা বলি, গণআদালত করে গোলাম আযমের ফাঁসি দাবি করেছি। অথচ জহির রায়হানের নামটি চলচ্চিত্র জগৎ ছাড়া আর কোথাও উচ্চারিত হয় না। কেন হয় না, সে প্রশ্নের জবাব দেয়ার মতো কেউ এদেশে নেই। আজকাল তো চলচ্চিত্রের সাথে জড়িতরাও তাকে নিয়ে ভাবেন বলে মনে হয় না।
জহির রায়হানের উধাও ও হারিয়ে যাওয়া তথা খুন হওয়া সম্পর্কে কথা বলেছিলেন প্রয়াত সাংবাদিক নির্মল সেন। তিনি মনে করেন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীরা, আল বদর, আল শামস্, না রাজাকার নয় বুদ্ধিজীবী এমনকি জহির রায়হান নিখোঁজ তথা নিহত হবার জন্য মুক্তিবাহিনীর এ অংশটি মুজিব বাহিনী জন্য।
তার যুক্তি: ১৯৭১ সালে প্রবাসী স্বাধীন বাংলা সরকারের অজান্তে গড়ে ওঠা মুজিব বাহিনী সম্পর্কে অনেক পরস্পরবিরোধী তথ্য আছে। বিভিন্ন মহল থেকে বারবার বলা হয়েছে, এ বাহিনী গড়ে উঠেছিল ভারতের সামরিক বাহিনীর জেনারেল ওবান-এর নেতৃত্বে। এদের দায়িত্ব ছিল – রাজাকার, শান্তি কমিটিসহ বাংলাদেশের সকল বামপন্থীদের নিঃশেষ করে ফেলা। মুজিব বাহিনী সম্পর্কে এ কথাগুলো বারবার লেখা হচ্ছে। কোন মহল থেকেই এ বক্তব্যের প্রতিবাদ আসেনি। অথচ দেশে মুজিব বাহিনীর অনেক নেতা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে আছেন। তারা কোন ব্যাপারেই উচ্চবাচ্চ্য করছেন না। তাদের নীরবতা তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত বক্তব্যই প্রতিষ্ঠিত করছে এবং সর্বশেষ জহির রায়হানের নিখোঁজ হবার ব্যাপারেও মুজিব বাহিনীকেই দায়ী করা হচ্ছে । ( নির্মল সেন, আমার জবানবন্দি, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ – ফেব্রুয়ারি, ২০১২ । পৃ: ৪০৫-৪০৬)
এই ব্যাপারে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক । শহীদুল্লাহ কায়সার বেঁচে আছেন অরোরা কেন উদ্যোগী হয়ে জহির রায়হান বারবার ফোন করে তাকে মিরপুরে যেতে প্ররোচিত করেন? কোন কোন বুদ্ধিজীবী যদি বেঁচেই থাকেন তবে অরোরা দেড় মাস কেন বুদ্ধিজীবীদের উদ্ধার করতে ভারতীয় বাহিনীকে ব্যবহার করেন নি? কথিত বিহারীদের নির্মূল করেন নি? বেসামরিক ব্যক্তি জহির রায়হানকে Ñ যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় সামান্য ট্রেনিংও গ্রহণ করেন নি Ñ (চলমান ভাষ্যমতে) মিরপুর যেতে বললেন। মিরপুর থানা হতে তিনি কোথায় গেলেন? যদি তিনি মিরপুর যুদ্ধেই মারা গিয়ে থাকেন তবে তার লাশ কোথায় গেল? অন্যান্য সবার লাশ পাওয়া গেল, জহির রায়হানের লাশ কোথায়? জহির রায়হানকে সাথে স্বয়ং মিরপুর যাবার ওয়াদা দিয়ে অরোরা রাত ১২টার ভারতে যাবার কথা জানিয়ে আসলে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন?
জহির রায়হান নিখোঁজ হবার পর কিংবা অরোরার অন্য কেউ জহির রায়হানের আত্মীয়-স্বজনদের সাথে একবারও যোগাযোগ করেন নি কেন? যদি তিনি স্বচ্ছ হতেন তা হলে অবশ্যই তাদের পরিবারের কারো না কারো সাথে যোগাযোগ করতেন। বরং এমন নিন্দনীয় ঘটনা হবে নিশ্চিত হবার পরই নিজেকে দূরে রাখার উদ্দেশ্যেই তিনি ঢাকা থাকবেন না বলে জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ সেনবাহিনীর তৎকালীন সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী তো জহির রায়হানকে তো একবারও ফোন করেন নি, কিংবা জহির রায়হানকে তার সাথে দেখা করার দাওয়াতও দেন নি। অন্তত তার তো জানা থাকার কথা যে শহীদুল্লা কায়সার এবং অন্যান্য বুদ্ধিজীবীরা মিরপুরে বিহারীদের কাছে জিম্মি হয়ে আছেন। একজন বুদ্ধিজীবীকেই তো মিরপুর থেকে জীবিত কিংবা মৃত উদ্ধার করা হয় নি। তাই আমাদের বুঝতে কষ্ট হয় না, অরোরা তথা ভারতই জহির রায়হানকে উধাও, গুম ও খুন করার জন্য দায়ী।
আসলে মিরপুরে আমাদের সেনাসদস্যদের অজান্তেই যুদ্ধের নাটক হয়েছে। অনেকেই মনে করেন কথিত ওই যুদ্ধে ভারতীয় সেনারাই বিহারী সেজে যুদ্ধ করেছে। রাজাকার কিংবা আলবদর আল-সামসদের হাতে মেশিনগান থাকার কথা নয় কিংবা মেশিনগান চালানের মতো প্রশিক্ষণও তাদের ছিল না। যদি বিহারীদের কাছে মেশিনগান থাকতো, তবে যুদ্ধ শেষে ঐসব মেশিনগান কোথায় গেল? আর ৩০ জানুয়ারীর পরে তো মিরপুরে কোন যুদ্ধই হয় নি, যুদ্ধ ছাড়াই বিহারীরা বিভিন্ন শিবিরে অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিল । মিরপুর থেকে কখনোই মেশিনগান কিংবা ভারী অস্ত্র উদ্ধার করা হয় নি। ঐ মেশিন কোন সূত্র থেকে আসলো এবং কোথায় গেল? সুতরাং এ যুদ্ধ ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর যুদ্ধ। ওই যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কেউ মারা গিয়েছে, এমন কারো নাম পত্রিকায় আসে নি।
১৭ ডিসেম্বর জহির রায়হানকে ঢাকায় নিয়ে আসাও ছিল রহস্যজনক। অরোরাদের লক্ষ্য ছিল জহির রায়হানকে সরিয়ে ফেলা । আর তাই মিরপুর যুদ্ধের নাটক। স্বাধীন বাংলাদেশ লুটের যে দৃশ্য এবং ভারতের আশীর্বাদপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নানা ধরনের অপকর্মের যেসব ছবি জহির রায়হান ক্যামেরাবন্দী করেছিলেন তা ছিল ভারতের দুশ্চিন্তার মূল কারণ। তাই জহির রায়হানকে দ্রুত সরিয়ে ফেলাই ছিল ভারতের উদ্দেশ্য।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কলিকাতায় ছিলেন এমন বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একমাত্র জহির রায়হান ছাড়া আমাদের জানা এবং পরিচিত অন্যকেউ ১৬ ডিসেম্বরের পরের দিনই ঢাকায় আসেন নি। জহির রায়হানকে কে কারা কেন এতো দ্রুত ১৭ জানুয়ারী ঢাকায় চলে আসতে বাধ্য করা হয়? তাকে তার কলিকাতাস্থ বাসায় যেতে দেয়া হয় নি? তাকে সুটিং লোকেশন থেকে আচমকা সরাসরি ঢাকায় আনা হলো। ওইদিন তার দুই শিশু ছেলেই জ্বরে আক্রান্ত ছিল। স্ত্রী সুচন্দার শরীরও ভালো ছিল না। এই পরিস্থিতিতে অস্বাভাবিকভাবেই তাকে ঢাকায় আসতে হয়। এতে প্রমাণ হয় তিনি স্বেচ্ছায় ঢাকায় এসেছেন তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ওই সময়ে তার সাথে থাকা তার অন্যকোন সহকারী/সহযোগীকেও আনা হয় নি। কেবল একটি ক্যামেরা ছাড়া তাকে আর কিছুই ঢাকায় আনতে দেয়া হয় নি। বলা হয়েছিল সুচন্দা, তার দুই ছেলে এবং ক্যানসহ তার সমস্ত মালামাল পরবর্তী দিন ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া হবে। সেইসব ক্যান আর কখনোই ঢাকায় আসে নি। সেইগুলো কোথাও গেল তাও ভারত সরকার কিংবা বাংলাদেশ সরকার আজ পর্যন্ত জানায় নি।
তবে সত্য নদীর স্রোতের চেয়ে শক্তিশালী এবং চিরপ্রবাহমান। বাঁধ দিয়ে পানিপ্রবাহ বন্ধ করা যায়, হয়তো নদীকেও মেরে ফেলা যায়, যেমনটি ভারত আমাদের নদীগুলোর ক্ষেত্রে করছে। কিন্তু সত্যকে সাময়িকভাবে লুকানো যায়, শক্তি প্রয়োগ করে চেপে রাখা যায়, চিরতরে মুছে ফেলা যায় না। সত্য তার পথ খুঁজে একদিন কোন না কোনভাবে বেরিয়ে আসবেই । তখন হয়তো অনুঘটকরা থাকবেন না, হয়তো ইতোমধ্যেই ওপারে চলে গেছেন, তাদের বংশধরাও চলে যাবেন। কিন্তু তাদের কুকৃর্তি তাদের মৃত্যুর পরেও তাদেরকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে, দাঁড় করাবে। এটাই ইতিহাসের বিচার। ইতিহাস আয়ু পৃথিবীর মতোই দীর্ঘ। (’জহির রায়হান: হারিয়ে যাওয়া মানিক’ শীর্ষক আমার অপ্রকাশিত বই থেকে)
রচনাকাল: ২৭ জানুয়ারী, ২০২০