উন্নয়নের জোয়ার ও দুর্নীতিশিল্প
মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন:
বাংলাদেশের চারদিকে উন্নয়নের বন্যা এবং এরই প্রভাবে দুর্নীতিশিল্পের উত্থান দ্রুত প্রসার দেখে আমি বিস্মিৃত। উন্নয়ন ও দুর্নীতিশিল্পের এমন সমান্তরাল যাত্রা আর কোথাও নেই। সত্যিই প্রশংসার যোগ্যতা রাখে। বাংলাদেশে যেদিকেই চোখ যায় সবদিকেই উন্নয়নের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। আমাদের বিভিন্ন কর্মকান্ডে এই বিষয়টির প্রতিফলন ঘটে। উন্œয়নের উপসর্গ হিসেবে আমরা দেদারসে দেশের টাকা উড়াচ্ছি।
আমাদের উন্নয়ন ও খ্যাতি বৃদ্ধির অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। আমাদের সরকার প্রধান কখনোই শতাধিক সঙ্গী ছাড়া জাতিসংঘ অধিবেশনে যান না। সারা দুনিয়ার তাকিয়ে থাকে । তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে বাংলাদেশ যে ইতোমধ্যেই উন্নয়নের রোলমডেলে পরিণতি হয়েছে এই বিশাল বহর তারই প্রমাণ। তার সফর সঙ্গীদের কেউ কেউ এখানে ঘরবাড়ি কিনেন । ব্যবসা কিনেন। আমোদ-স্ফূর্তি করেন।
পদ্মা সেতুর কথাই ধরুন । ঘোষিত সময়ের মধ্যে পদ্মা সেতুর নির্মাণ শেষ হবে কিনা সন্দেহ। ব্যয় বাড়ছে প্রতিদিনই। ইংরেজী দৈনিক ‘দ্য ডেইলি স্টার’ জানায় ১৯১৪ সালে ধরা ১,৪০০ কোটি টাকা থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনবার ব্যয় পুনর্নিধারিত হয়ে ৩০,১৯৩ কোটিতে ছিল। এরপরের ব্যয় বৃদ্ধি কোন কোথায় গিয়ে শেষ হবে তা বলা কঠিন। বাড়তি ব্যয় করতে আমরা মোটেই চিন্তিত নই। প্রতিটি প্রকল্পেই এই দশা। এতে আমরা মহাখুশী। উন্নয়নের রোল মডেল হতে হলে তো হরিলুট হবেই।
ভেবে দেখুন আমরা উন্নয়নের কোন উচ্চমার্গে পৌঁছেছি। জাতির জনকের জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে ১৬ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। এসবই উন্নয়নের প্রমাণ। সত্যিই ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমি—-’।
উন্নয়নের পরিমাণ কতো বেশি হলে একরাতেই আমলা নামক সরকারের সাথে জড়িত লড়াকু সৈনিকদের বেতন দ্বিগুণ যায়। কোন দেশই এমনটি পারে নি। এর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে সবার এমনকি সরকারী-বেসরকারী মাদ্রাসা-স্কুল শিক্ষকদের বেতন । বেতন প্লাস ঘুষ নামক উপরি আয়ও বাড়ে কয়েক গুণ। প্রত্যেক টেবিলে আগে ভানু’র ভাষায় ‘টিনের বাক্সে’ — অগ্রিম বাড়তি হারে বাধ্যতামূলক বকশিস। একই হারে বাড়ে সবকিছুর খরচ: যানবাহনের ভাড়া, শ্রমিক-মুজুর গৃহ-বুয়াদের বেতন, কবরের দাম সবকিছু। (শুধু খুন হতে তেমন পয়সা লাগে না। লড়াকু সৈনিকরা বিনা পয়সায় এই মহান কাজটি করে। এটা তাদের মহত্ব, যা এই যুগে পাওয়া ভার। তবে মানুষের জীবনের এখন আর কোন দাম নেই বলেই হয়তো এমন ফ্রি সার্ভিস।) ৩০০ টাকায় এককেজি পেঁয়াজ কিনতেও কোন কার্পণ্য নেই। জনগণ বেজায় খুশি। খুশি হবে না? দেশের প্রযুক্তি সারা দুনিয়াকে ছাড়িয়ে গেছে। আলহামদুলিল্লা আমাদের ঘরবাড়ি নির্মাণের ঠিকাদারগণ লোহার রডের পরিবর্তে বাঁশ-প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন ভবন, সেতু এমনকি রেল লাইনে। মন্ত্রী বাহাদুর গরুর খাবার কচুরিপেনা মানুষের খাওয়ার যোগ্য বলে মনে করেন। প্রতিভা ও প্রযুক্তির সংযোজনে কচুরিপেনাও মানুষের খাবার হয়ে যায ? দুনিয়ার কোন মহাবিজ্ঞানী এমন এই ধরনের আজগুবি চিন্তা কখনোই করেন নি। আজগুবি আবিষ্কারের জন্য সবগুলো নোবেল পুরস্কার আমাদের দেশেই আসবে। দুনিয়াবাসী দেখে যাও বিদ্যাবুদ্ধি, প্রযুক্তি আর উন্নয়নের বন্যা কী হারে মহাপ্লাবনে পরিণত হচ্ছে।
উন্নয়নের বন্যার কতো উদাহরণ দেবো। রাস্তা এতো ভালোভাবে পাকা করা হয় যে, পরের দিনই স্থানীয়রা রাস্তার কালো পিচ্ তথা রাস্তার চামড়া হাত দিয়ে তুলে ফেলেন। কোন পাকা রাস্তার চামড়ার বয়স বড়জোর ছয়মাসের। আবার নতুন বরাদ্দ হয়। আবার রাস্তা পাকা হয়। আবার চামড়া উঠে যায়। যতো চামড়া উঠবে ততো টাকা আসবে। টাকার অভাব নেই। টাকা বানানোর এই খেলা গত একযুগ ধরে চলছে। ঘরবাড়িতে একটা বালিশ তুলতে হাজার খানেক টাকা লাখে। মশারির দামও তেমনি। বই কিনতে একই দশা। নিজেদেরকে সহি-সালামতে রাখতে ভিসিরা ছাত্রদেরকে নজরানা দেয়। তাও এক-দুইলাখ টাকা নয়, কোটি টাকার ওপরে। ভিসি না ? নিজে অযোগ্য হলেও নজর তো অযোগ্য নয়, অনেক বড় । তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা দিয়ে লড়াকু সৈনিকদেরকে কিনতে ও পুষতে তথা ধনী করার জন্য কোটি টাকার বেশি নজরানা দেন। আরেকজন ভিসি ! তিনিও লড়াকু সৈনিক। তিনি ক্ষেপে গিয়ে বললেন: তাকে টাকা বানানোর মেশিন লড়াকু সৈনিকদের একটি শাখা সংগঠনের চেয়ারম্যান করলে তিনি ভিসি’র পদ থেকে সরে যাবেন। কারণ ভিসি’র বেতনের চেয়েও টাকার মেশিনে মালপানির পরিমাণের তুলনায় নস্যি। এরাই মহান ব্যক্তি। দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য কী ধান্ধায় টাকা বানানো যায় সেই ফন্দি-ফিকির তাদের তাদের জানা। এরা সাচ্ছা দেশপ্রেমিক । বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে এরা জান-কোরবান। অর্থ বানালেই দেশের উন্নতি হবে। ব্যক্তির উন্নতি হলে দেশের উন্নতি হবে। ব্যক্তি ফকির হলে দেশ চলবে না। তাই টাকা ছাড়া কোন কথা নেই। টাকার বিনিময়ে মস্তানি ও মানুষ খুন সব কাজেই শিল্পী পাওয়া যায়। ঘর থেকে রাস্তা থেকে মানুষকে উধাও করে কিংবা ঘরের ভিতরেই এরা ঠান্ডা মাথায় মানুষকে চিরদিনের জন্য ঘুম পাড়িয়ে দেয়। তারপর জায়গা হয় আজিমপুরে কিংবা নিজ নিজ গ্রামের একই ধরনের জায়গায়। সাগর-রুনি থেকে শুরু করে কতো অজানা-অচেনা হাজার হাজার মানুষ হারিয়ে গেছেন টাকা প্রাপ্তির, প্রমোশন প্রাপ্তির অন্যান্য সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তির বিনিময়ে। লড়াকু সৈনিকরা কখনো বিভিন্ন লীগ-মঞ্চের নামে, কখনো পুলিশ, কখনো র্যাব, কখনো সাদা পোশাকপরা পরিচয়হীন লোক সেজে মানুষের জান-কবজ করার জন্য আসে। এটা ওদের পবিত্র দায়িত্ব। গণতন্ত্র ও উন্নয়নের জোয়ার অব্যাহত রাখতে হলে দেশের জনসংখ্যা কমাতে হবে। এতো ছোট দেশে এতোবেশি লোক থাকলে উন্নয়নের জোয়ার আটকে যাবে। তাই লড়াকু সৈনিকরা প্রায়ই যখন তখন মানুষ ছাঁটাই করার অভিযানে নামে। এটাও তাদের টাকা বানানোর অন্যতম তরিকা। টাকা পেলেই হলো কাজ যতোই নিষ্ঠুর হোক।
ঢাকার একটি দৈনিকে ১৫ ফেব্রুয়ারী বিমল সরকার নামক জনৈক অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক সম্পূর্ণ ভুল পথে হেঁটে লিখেছেন: “একশ্রেণির লোক একেবারে উন্মাদ হয়ে পড়েছেন। টাকার দরকার তাদের; তা যে কোনো উপায়েই হোক। ছুটে চলা। হন্যে হয়ে ছুটে চলা। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে টাকা ও খ্যাতির পেছনে ধাবিত হওয়া। টাকা হলেই খ্যাতি হবে।”
প্রভু সম্প্রদায়ের এই শিক্ষক এমন ক্ষেপলেন কেন ? তার কী চাকরির মেয়াদ বাড়ানো হয় নি ? না কী অবসরে যাবার পরেও অন্যকোন জায়গায় বসানো হয় নি ? তা নাহলে তিনি ¯্রােতের বিপরীতে হাঁটছেন কেন ? প্রভু সম্প্রদায়ের লোক হিসেবে তার তো তালিয়া বাজানোর কথা । চিৎকার দিয়ে বলার কথা: বেশ হচ্ছে বেশ হচ্ছে Ñ দেশের উন্œয়নের জোয়ার বইছে।
তিনি কী বলতে চাচ্ছেন লড়াকু সৈনিকারা মালপানি না বানিয়ে চুপচুপ বসে থাকবে ? তারা কী রাজপথ কাঁপাবে না ? আবরারকে প্রভুদেশের বিপক্ষে লেখার জন্য পিটিয়ে হত্যা করবে না ? কিংবা ‘দিল্লী না ঢাকা Ñ ঢাকা ঢাকা’ বলে চিৎকারকারীদের মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার মতো অপরাধ করার জন্য ভিপি নুরকে পিটিয়ে তক্তা করবে না ? রিমান্ডে নিয়ে উন্নয়নবিরোধী নির্দোষ ব্যক্তিদেরকে নেঙ্টা করে পিটাবে না ? বিএনপি-ছাত্রদলের মিটিং’এ হামলা চালাবে না ? শিবির কর্মী সন্দেহে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকে হল থেকে পিটিয়ে বের করবে না?
এই ধরনের পবিত্র দায়িত্ব লড়াকু সৈনিকরা নিষ্ঠার সাথে পালন করেন। দায়িত্ব পালন করার আগেই অগ্রিম টাকা । টাকা ফ্ল্যাট গাড়ি বাড়ি ব্যবসা করার ঁিসড়ি। এছাড়া এরা দেশের জনগণের চাহিদা মেটানোর জন্য অস্ত্র, চোরাচালান, ইয়াবাহা, হেরোইন, বায়াগ্রা আমদানি করে। এরা জনগণের মহান সেবক। অথচ আমরা এদেরকে চিনলাম না। এদেরকে বুঝার মতো মেধা ও যোগ্যতা আমাদের নেই। বিমল সরকার হয়তো এই কিছিমেরই হবেন। অথবা তিনি অবশ্যই স্বাধীনতা-বিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তির চর এবং তার ওপর জামায়াত-শিবির আছর করেছে। তাই তিনি উল্টা পথে হাঁটছেন।
বিমল সরকারের মন্তব্যের সাথে আমি মোটেই একমত নই। লড়াকু সৈনিকরা সঠিক কাজটিই করছে। এমনটিই হওয়া উচিত। এদের অবাধ তৎপরতার কারণেই তো হাতে প্রচুর পয়সা এসেছে। দেশের উন্নয়ন এমন উঁচু পর্যায়ে পৌঁছেছে । গত ১২ বছরের দেশের সর্বক্ষেত্রে এমন জোয়ার চলছে যে দেশে টাকা রাখার আর জায়গা হয় না। আর ব্যাংকওয়ালাতে শেয়ারবাজারে চুর/ডাকু/দরবেশরা রয়েছে। তাই ব্যাংক-শেয়ারবাজার থেকে টাকা গায়েব হয়ে যায় । টাকা তো কোথাও রাখতে হবে। দেশে নিরাপদ নয়, তাই টাকা নেয়া হয় বিদেশে। অভাজনরা বলে এটা নাকি দুর্নীতি। টাকা পাচারকারী। এটা দুর্নীতি নয় এখন এটা শিল্প। লড়াকু সৈনিকরা মেহনত করে এই শিল্পের কায়দা-কানুন ও কৌশল ভালোভাবে রপ্ত করেছে। এরা এমনি এমনি টাকার জাহাজ হয় নি। এরা জানে না এদের কতো কোটি টাকা কোথায় আছে। এতো সংখ্যাও কম নয়। ভোটারবিহীন নির্বাচনের এরা ২০ শতাংশ।
কোটি কোটি লড়াকু সৈনিক Ñ গ্রামের মেম্বার থেকে শুরু করে মন্ত্রী, এমপি, কেরাণী থেকে সচিব, পুলিশ, ব্যবসায়ী, কোন কোন সাংবাদিক, নট-নটী, চাঁদাবাজ খুনি অর্থাৎ সর্বপেশার লড়াকু সৈনিকরা নিরাপত্তার জন্য বিদেশ টাকা পাঠান। ঘরবাড়ি কেনেন । এইভাবে টাকা বানানো নাকি দুর্নীতি। চুরি। ডাকাতি। জালিয়াতি। ছোটকালে শুনেছি ‘চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা’। লড়াকু সৈনিকরা এই মহাবিদ্যা আয়ত্ব করেছে। তাই তাদের টাকা বানানোর এই বিশেষ বিদ্যা ও পারদর্শিতাকে অবশ্যই শিল্প হিসেবেই স্বীকৃতি দেয়া জরুরী। আর প্রক্রিয়াকে শুধু দুর্নীতি বলে দুর্নীতিশিল্প বলা উচিত। এর সাথে জড়িত কলা-কুশলীরা উঁচুমানের শিল্পী হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কৃত হবার দাবি রাখেন। খুন, চুরি, ডাকাতি, ব্যাংক লুট, ছিনতাই, শেয়ারবাজার খাওয়া ইত্যাদি অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য প্রত্যেক শাখার শ্রেষ্ঠেেদরকে পুরস্কৃত করতে কার্পণ্য করা উচিত নয়।
লজ্জার ব্যাপার হলো তথাকথিত দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন)’এর চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, অর্থ পাচারের সাথে জড়িত দুর্নীতিশিল্পীদের বিভিন্ন দেশ থেকে ধরে আনার ব্যাপারে পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোলের সহায়তা চাইবেন। এটা খুবই বেঅন্যায় কথা। সম্মানিত ব্যক্তিবর্গদেরকে বিদেশী পুলিশ ধরে আনলে দেশের মান-ইজ্জত যাবে কোথায় ?
অন্যদিকে কথিত দুর্নীতি বিরোধী বেসরকারি সংস্থা টিআইবি বলেছে, বাংলাদেশ থেকে বছরে ১৫০০ কোটি ডলার পাচার হচ্ছে। এটাতো আমাদের সাফল্য। টাকা আছে বলেই টাকা পাচার হচ্ছে। তবে এটা টাকা পাচার নয়, টাকা জমানো হচ্ছে। দেশটা তাদের। দেশের যা কিছু সবটার মালিক লড়াকু সৈনিকরা । তাদের সম্পদ তারা কোথায় রাখবে স্বদেশে না বিদেশে তা তারাই ঠিক করবে। এটা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। লড়াকু সৈনিকরা গণতন্ত্রকে সুরক্ষার কাজেই তো খুন-খাবার নামে উন্œয়নবিরোধী শক্তিকে নির্মূল করছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরছে। আর দুদক চেয়ারম্যান বিদেশে মহাসুখে থাকা লড়াকু সৈনিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ধরে আনবেন, এমনটা অসম্ভব। এমন পরিস্থিতিতে লড়াকু সৈনিকরা কিছুতেই চুপ থাকবে না। এর বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হবে। দুদুকের ভিতরে তো প্রায় সবাই লড়াকু সৈনিক । তাদের অনেকেই দুর্নীতিশিল্পী। তাই দুদকের কোন অধিকার নেই বিদেশে অবস্থানকারী অবসরে যাওয়া কিংবা প্রমোদ ভ্রমণে থাকা দুনীতিশিল্পীদের ছায়া মাড়ানো।
দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি সংস্থা টিআইবি বলেছে, বাংলাদেশ থেকে বছরে ১৫০০ কোটি ডলার পাচার হচ্ছে। এটা তো চাই। এটাই উন্নয়নের মডেল। উন্নয়নের জোয়ার বইছে বলেই তো লড়াকু সৈনিকরা টাকার মালিক হয়েছে। তাদের টাকা তারা বিদেশে নিয়ে যান। এটাকে পাচার বলা যায় না। এটা কোন অপরাধ নয়।
এরাই তো বিদেশে দেশের নাম বাড়াচ্ছেন। বিশেষ করে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, দুবাই, ভারত, ব্রুনাইসহ বিভিন্নদেশে ঘরবাড়ি কিনেছেন। ব্যবসা চালাচ্ছেন। বেগমপাড়াসহ কতো দেশে কতো পাড়া কতো সেকেন্ড হোম করেছেন। দুর্নীতিশিল্পের সাথে জড়িত সম্মানিত সোনার ছেলেরা পালিয়ে যান নি, তারা মহা আরাম-আয়েশে দিন গুজরান করছেন।
এরা সবাই পীর-আউলিয়ার পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া হযরতের মুরিদ। মহাশক্তিধর ‘দরবেশ’-সাবও হযরতের মুরিদ। ম. গা., সাবেক নৌ-ডাকুও একই কাতারে। পীর-আউলিয়ার সুনজরে থাকলে সব গুনাহ মাফ হয়ে যায়। খুন-খারাবি হয় উত্তম কাজ। তাদের পোলারা জেলখানায় বাসরঘর করার সুযোগ পায়। ফাঁসিতে লটকানো হবে এমন লড়াকু সৈনিকরা মুক্তি পায়। সবই আউলিয়াদের কারসাজি কারসাজি। তার দোয়ায় মালপানি লড়াকু সৈনিকদের পায়ের কাছে আছড়ে পড়ে, ঘরে চলে আসে। এমন ধরনের মহাসম্মানিত ও ক্ষমতার মালিক দুর্নীতিশিল্পীদের ধরে আনা দুর্নীতিশিল্পকে উচ্ছেদ করার পাঁয়তারা। দুদক কেন দুর্নীতিশিল্পীদের স্বীকার করছে না ? তাদেরকে দুর্নীতিবাজ বলার কোন অধিকার নেই দুদুকের। যিনি নাচেন তাকে যদি নৃত্যশিল্পী বলা যায়, গায়ক-গায়িকাকে কন্ঠশিল্পী বলা যায়, তবে মহাসম্মানিত বিপুল ধনসম্পদের বানোনোর কৌশল আয়ত্বকারী দুর্নীতিশিল্পের সাথে সাথে জড়িত নেতা-নেত্রী-সদস্য লড়াকু সৈনিকদেরকে কেন দুর্নীতিবাজ বলে তাদেরকে খাটো করা হবে ? তাদেরকে অবশ্যই দুর্নীতিশিল্পী বলতে হবে। এটা তাদের প্রাপ্য। এটা এখন সময়ের দাবি।
দুদক কিংবা টিআইবি’র ছাঁইরা মনে হয় দুর্নীতিশিল্পীদের ক্ষমতা ও দক্ষতা সম্পর্কে অবগত নন। এদের ক্ষমতা এতো ব্যাপক যে তারা চাওয়ামাত্র মানুষ দুনিয়া থেকে হারিয়ে যায় কিংবা চিরতরে ঘুমের দেশে চলে যায় । এই শিল্পের সাথে জড়িতদেকে শুধু দুর্নীতিবাজ না বলে দুর্নীতিশিল্পী বলা আপনাদের নিরাপত্তার জন্যই উত্তম। তাদেরকে ধরে আনার চেষ্টা করলে পাপ হবে এবং সেই পাপের শাস্তি দুনিয়াতেই পেতে। চড়্-থাপ্পড়, কিল-খুশি তো আছেই, চূড়ান্ত পর্যায়ে বাড়তি উপহার হিসেবে অজ্ঞাত হিসেবে ডোবা-নালায়, রাস্তার পাশে কিংবা রেল লাইনে শুয়ে থাকার ব্যবস্থাও আছে। তাই দুনীর্তিশিল্পীদের কাছে যাওয়া মানেই তাদের তাজাল্লিতে পুড়ে ছাঁই হয়ে যাওয়া। সেটা দুদকই হোক কিংবা অন্যকেউ।
এরা অনুমোদিত লড়াকু সৈনিক। রাজপথ কাঁপানো লড়াকু সৈনিক টাকাওয়ালা সম্মানিত ব্যক্তিবর্গদেরকে কেন শিল্পী না বলে দুর্নীতিবাজ বলবেন? এদেরকে ছোট করবেন না। এদের দিকে সম্মান আর সমীহের দৃষ্টিতে তাকান। এদের মাধ্যমেই তো দেশের নাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। এদের একেক শিল্পী পুরো দুদককে গিলে ফেলতে পারে। দুদকের মতো দুইনম্বরীদের সবগুলোকে টাকা দিয়ে ঢেকে রাখলেও একজন দুর্নীতিশিল্পীর টাকা শেষ হবে না। দুর্নীতিশিল্পী লড়াকু সৈনিকদের এতো টাকা রয়েছে তা শুনে তো বাংলাদেশের মানুষ তো গর্বিত। আনন্দে তাদের বুক ভরে যায়। এদের মাধ্যমেই তো বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা তৈরি হবে। আমাদের সরকার সেই দিকেই এগুচ্ছে।
অথচ কোন কোন বেয়াকুব এই লড়াকু সৈনিকদেরকে ভুল বুঝছে। কিছু রাজাকার দেশদ্রোহী লড়াকু সৈনিকদেরকে চোর-চোট্টা, লুটেরা, ডাকাত নামে ডাকে। আ. স. ম. আবদুর রবও এদেরকে দেখলে ‘চোর যায় চোর যায়’ বলতে দেশবাসীকে উপদেশ দিয়েছেন। তোবাসতিল্লা ! কখনো ভুলেও এদেরকে চোর-ডাকাত-খুনি বলবেন না। এরা যা-ই করে সবই আইনসিদ্ধ। দেশের প্রয়োজেনই এরা কতো দেশদরদী। এরা দেশপ্রেমিক । দেশের সুনাম বাড়ানোর জন্য এই ধরনের দেশপ্রেমিকদের আমানত সুইসব্যাঙ্কে সর্বাধিক। অন্তত একটি বিষয়ে আমরা আমেরিকার মতো দুনিয়ার সেরাধনীকেও পিছনে ফেলে দিয়েছি। এই সাফল্যের জন্যও দুর্নীতিশিল্পীরা হাততালি পাবার দাবিদার। ওরা কতো ভালো । কতো জনমুখী। ওরা আমাদের ভোটটি পর্যন্ত দিয়ে দেয়। কষ্ট করে আমাদেরকে ভোট কেন্দ্রে যেতে হয় না। ভোটের সময় হলে আমাদের ঘরে ঘরে এসে সালাম দেয়। অতীব নমনীয় ভাষায় ভদ্রভাবে কথা বলে। মাথায় টুপি লাগায়। মসজিদে ঢুকে দান-ছদকা করে। ওয়াজ-নসিয়ত করে। এমন মহান দুর্নীতিশিল্পীরা ইতোমধ্যে ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকে দেশকে উন্নত বিশ্বের কাতারে নিয়ে যাবার ইরাদা করেছেন। এরচেয়ে বড় খবর কি হতে পারে? দুর্নীতিশিল্পীরা জিন্দাবাদ Ñ না না প্রভুদের জবানীতেই বলি: যুগ যুগ জিয়ো।*
রচনাকাল: ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১০