বাঙালী সংস্কৃতি বর্জন করুন
মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন
একুশের মাসেই এমন আবেদন ! একুশে ফেব্রুয়ারী ভাষাদিবসের চেতনা হতে আমরা দিন দিন সরে যাচ্ছি বলেই এই আবেদন। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে একুশ এখন লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতার শিকার। এই উপলক্ষে স্বদেশে-প্রবাসে নেতানেত্রীদের তথাকথিত বাণী দেয়া, খালিপায়ে শহীদ মিনারে ফুল দেয়া, কিছু কিছু লোকের বরকতদের কবরের পাশে যাওয়া, একুশের গান গাওয়া, পত্রিকায় ক্রোড়পত্র বের করা ইত্যাদি রুটিনমাফিক রেওয়াজ। আন্তরিকতাহীন ভাষার জন্য দরদহীন এইসব অনুষ্ঠানিকতা একুশের চেতনার প্রতিনিধিত্ব করে না। আমরা একুশের চেতনাকে বাস্তব অর্থে ভুলে গেছি। সত্যিকার অর্থে একুশের চেতনার ধারে কাছেও আমারা নেই।
‘মাতৃভাষার বাইরে বিদেশী ভাষা মানি না’ এই চেতনা যেন মরে যাচ্ছে। আমাদের ঘরে ঘরে হিন্দির আগ্রাসন। হিন্দি ছবি দেখে আমরা অনেকেই একুশের অনুষ্ঠানে যাই। ঘরে ফিরে হিন্দি ছবি দেখি । ভারতীয় চ্যানেল না দেখলে আমাদের ঘুম হয় না। এরই প্রভাবে হিন্দি আমাদের ওপর শোয়ার হয়েছে। আমাদের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বিয়ের অনুষ্ঠানে বনভোজনে হিন্দি গান না হলে চলে না। হিন্দি গান শোনার জন্য ভারতের তৃতীয় শ্রেণীর গায়ক-গায়িকাদেরকে ভাড়া করে আনি। সরকারী উদ্যোগেও এদেরকে বিপুল টাকার বিনিমেয়ে ভাড়ায়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে একটি বাংলা গাওয়া হলে পাঁচটি হিন্দি গান শোনানো হয়। ভারতের গোপন প্রণোদনাপ্রাপ্ত অনেক বাংলাদেশী শিল্পী এখন হিন্দি গান গেয়ে হিন্দি ভাষাকে বাংলাদেশে জনপ্রিয় করার ঠিকাদারি করছেন।
হিন্দির এই উপদ্রব উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। হিন্দিপ্রীতি আর একুশের চেতনা ও একুশ উদযাপন পাশাপাশি চলতে পারে না। এই দুটি পরস্পরবিরোধী ও সাংঘর্ষিক। আমরা হিন্দি আগ্রাসনের মূল উদ্দেশ্য অনুধাবন করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের আক্কেল হয় না আমরা বুঝি না আমরা হিন্দি চ্যানেল তথা সিনেমা-সিয়িাল নাটক কীভাবে বাংলাকে ভুলিয়ে দিচ্ছে। ভারতের অনেক রাজ্যে হিন্দি চ্যানেল চলতে দেয়া হয় না, এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সিলেবাসে হিন্দি-বিবর্জিত। মোদি-গঙ্দের ‘একদেশ এক এক ভাষা’ নীতিকে এইসব রাজ্য অস্বীকার করেছে।
অথচ বাংলাদেশ সরকার এমনকি জনগণ হিন্দি-বাংলা চ্যানেল বিনা পয়সায় চলতে দিচ্ছে। আমাদের দেশে ভারতে শত শত টিভি চ্যানেল চলে। কিন্তুঅথচ ভারত সরকার ভারতে বাংলাদেশের কোন চ্যানেল চলতে দেয় না এই অবস্থায় আমরা কেন ভারতীয় চ্যানেল দেখবো Ñ এমন অতি সাধারণ প্রশ্ন করার ক্ষমতা ও চেতনা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আমরা দিশেহারা জাতিতে পরিণত হচ্ছি। এই জন্যই একুশ উদ্যাপনকে আমি প্রতারণা বলে মনে করি।
একুশে জীবনদান একুশের চেতনা কেবল উর্দুকে হটিয়ে বাংলাকে স্বমহিমায় অভিষিক্তই করে নি, আমাদের মনস্তত্বে রোপিত করেছে আমাদের স্বাতন্ত্র্য সক্রিয়তাবোধ জাতীয়তাবাদী চেনতার বীজ যা পরে স্বদেশের স্বার্থরক্ষা ও স্বাধীনতা অর্জনে আমাদেরকে নতুনরূপে জেগে ওঠার প্রেরণা যুগিয়েছে। একুশের পথ ধরেই আমরা সামনে এগিয়েছি। স্বাধীনতার পথে হেঁটেছি। রক্ত দিয়েছি Ñ যা এনে দিয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম স্বদেশ।
কিন্তু স্বাধীনতার ৪৯টি বছর পেরিয়ে আমরা এখন হতবাক হয়ে দেখি আমরা যেন আমাদের পথ হারিয়ে ফেলছি। দিন দিন আমাদের জাতীয় স্বাতন্ত্র্যবোধ, সক্রিয়তা, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ব্যক্তিস্বার্থের চোরবালিতে ডুবে যাচ্ছে। ব্যক্তিস্বার্থ এবং ক্ষমতাই এখন দেশের অস্তিত্ব ও স্বাধীনতার চেয়ে যেন বেশি গুরুত্ববহ। এটাই আমাদের বড় বিপদ। যে উর্দুকে হটিয়ে আমরা বাংলাকে রক্ষা করেছি, বাংলাদেশ বানিয়েছি সেই ভাষাকে হারালে সেই চেতনাকে হারালে আমাদের দেশও যে হারিয়ে যাবে তা আমাদের মনে কিংবা মুখে আসে না।
স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় আমরা আদৌ সুদৃঢ় অবস্থানে আছি বলে মনে হয় না। আমাদের ভাষার আকাশে হিন্দির যে থাবা তা রোধে কোন চেষ্টা নেই। আমাদের সাংস্কৃতিক সীমান্ত ভেদ করে ধেয়ে আসছে বিজাতীয় তথা প্রভুদেশের হিন্দু সংস্কৃতি। যেকোন জাতি সাংস্কৃতিক যুদ্ধে পরাজিত হলে তাদের দেশ এমনিতেই হারিয়ে যায়, সামরিক যুদ্ধ করেও যা ঠেকানো যায় না। ভারতীয় সিনেমা-সিরিয়াল-নাটক সেটা হিন্দিই হোক কিংবা বাংলাই হোক সেগুলো আমাদের ভাষা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য, দেশের অস্তিত্ব-স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য বিষের চেয়েও ভয়ঙ্কর।
হিন্দি ছবির কথা বাদ দিয়ে ভারতীয় বাংলা ছবি, এমনকি সিরিয়ালগুলোও সমধিক বিপদজনক। কলিকাতার বাংলা সিরিয়াল ‘রানু পেলো লটারী’, ‘কী করে বলবো তোমায়’, ‘নকশী কাঁথা’, ‘বকুল কথা’, ‘সিতার্থ’, ‘সদামনির সংসার’, ‘করুণাময়ী রানী রাশমনি’, ‘ত্রিনয়নী’, ‘বাঘবন্দি খেলা’, ‘আলাদীন’ ইত্যাদি আমাদের সংসার, সন্তান, সংস্কৃতি সমাজকে কোথায় নিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে ? হঠাৎ আমাদের দেশে ধর্ষণ, বয়ফেন্ড-গার্লফেন্ড চর্চা, পরকীয়া, বিবাহ-বর্হিভূত শারীরিক সম্পর্ক, খুন, প্রতারণা, মিথ্যাচারিতা, নির্মমতা গৃহ-বিবাদ, মারামারি, সন্ত্রাস ইত্যাদি বেড়ে যাবার জন্য সমাজবিজ্ঞানীরা ভারতীয় বাংলা-হিন্দির চ্যানেলের কুফলবলে মত প্রকাশ করেন। এছাড়াও ভারতীয় সিনেমা, সিরিয়াল, নাটক হিন্দুধর্ম-কেন্দ্রিক সংস্কৃতি, দেব-দেবী, মন্দির-গমন, পূজা-অর্চনার গুরুত্ব তুলে ধরে যা বাংলাদেশী জনগণের ধর্ম-বিশ্বাস ও সংস্কতির বিপরীত। এইসব দেখে শিশুরা হিন্দুধর্মীয় সংস্কৃতির সাথেই পরিচিতি হয়। এর প্রভাব শিশুদের মনে কতো মারাত্মক ফেলছে অভিভাকরা তা একবারও ভেবে দেখেন না। কারণ অভিভাকরাই ভারতীয় টিভি চ্যানেলের প্রতি আসক্ত। এই উপদ্রব বন্ধে প্রয়োজন পারিবারিক ও সরকারী পদক্ষেপ, যা কখনোই দেখা যায় না। এ ব্যাপারে সরকার একেবারেই নীরব প্রশ্রয়দাতা। সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের লোকেরাও এই ব্যাপারে উদাসীন । হিন্দি ও হিন্দু সংস্কৃতির আগ্রাসন রোধে কোন ভূমিকা রাখছেন বলে মনে হয় না।
অন্যদিকে ভারত বাংলাদেশে এমন সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গ তৈরি করেছে যারা শুধু প্রচুর টাকা, তথাথিত পদ্মভূষণসহ নানাবিধ পুরস্কার এবং বাংলাদেশে উপরে উঠার জন্য চর ও দলের ভূমিকা নিয়ে বাঙালী সংস্কৃতির নামে হিন্দু সংস্কৃতি ঢুকিয়ে দেয়ার কাজে নিয়োজিত। এইসব দাস-দাসীরা জেনেও জানেন না যে, বাঙালী সংস্কৃতি বলতে বাস্তব অর্থে কিছুই নেই। ভাষা এক ( একেবারেই অভীন্ন নয়, ভিন্নতা আছে) হলেও হিন্দু-মুসলমানদের সংস্কৃতি পরস্পরবিরোধী। উভয়ের সংস্কৃতিই ধর্মকেন্দ্রিক।
এখানে মনে রাখতে হবে হিন্দুরা মুসলমানদেরকে কখনোই বাঙালী হিসেবে স্বীকার করে নি। তারা কেবল বাংলাভাষী হিন্দুদেরকেই বাঙালী বলতো। যেদিন কোন বাঙালী হিন্দু ইসলাম গ্রহণ করেছে সেদিনই তার বাঙালী পরিচিতিরও ইতি ঘটেছে। হিন্দুদের কাছে ওই বাংলাভাষী নওমুসলিম কিংবা তার সন্তানরা বাঙালী নয়, মুসলমান। ঘৃণার্থে ম্লেছ, ন্যাড়া Ñ কোনভাবেই বাঙালী নয়। যে মুহূর্তে একজন হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন সাথে সাথে কেবল তিনি ৩৩ কোট দেবদেবীর পরিবর্তে এক আল্লাহ’র একত্বে বিশ্বাসী হন। রাসুলে বিশ্বাস করেন । আখিরাতে বিশ্বাস করেন। পুনর্জ্জন্মে বিশ্বাস পরিত্যাগ করেন। শুধু ধর্ম-বিশ্বাসই নয়, তার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড তথা নাম, পোশাক, ইবাদত ও ইবাদতের প্রক্রিয়া, খাবারের তালিকা, খাবার রান্না ও খাওয়ার প্রক্রিয়া-পদ্ধতি, পরিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক ও বিয়ে, মৃত্যু পরবর্তী দাফন-কাফন ইত্যাদিই শতশত প্রকারের ভিন্নতা রয়েছে। মুসলমানদের কোন সহমরণ নেই। মা কালিকে খুৃশি করার জন্য তার পায়ের নিচে আপন সন্তানকে বলি দেয়ার মতো পশুত্ব নেই। নেই কন্যা সন্তানকে গঙ্গায় ফেলে দিয়ে ডুবিয়ে মারা কিংবা গঙ্গানদীতে গোসল করলেই পাপ মোছন হবে এমন আজগুবি বিশ্বাসও নেই। নেই জাতিভেদ বর্ণভেদ নেই। সব মুসলমানই ভাই ভাই। এই ধরনের আরো শত শত কারণে বাংলাভাষী মুসলমান ও হিন্দুদের সংস্কৃতি এক ও অভিন্ন নয়, পরস্পরেিবাধী ও সাংঘর্ষিক।
এই কারণেই আমাদের পূর্বপুরুষরা বাংলাভাষীরা বাঙালী সংস্কৃতিকে তাদের সংস্কৃতি হিসেবে কখনোই অনুশীলন করেন নি। তারা ইসলাম ধর্মকেন্দ্রিক সংস্কৃতিচর্চা করেছেন। বাংলাভাষী হিন্দু-মুসলিমের ভাষা এক হলেও উভয় সংস্কৃতির সমন্বয়ে এক ও অভিন্ন তথা তথাকথিত বাঙালী সংস্কৃতি গড়ে ওঠে নি। এই ধর্মকেন্দ্রিক ভিন্নতার পরিচয়েই মুসলমানদের জন্য ১৯৪৭ সনে পৃথক আবাসভূমি পাকিস্তান দাবি তোলে এবং পাকিস্তান হয়েছে বলেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের আবির্ভাব হয়।
এখন বাংলাদেশীদের সেই ভিন্œতা ভিন্ন সাংস্কৃতিক দেয়াল ভেঙে বাঙালী সংস্কৃতির নামে হিন্দু সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে ফেলতে জোর তদবির চলছে। সেই ভিন্নতা তথা মুসলিম সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য অর্থাৎ মুসলিম পরিচিতি মুছে দেয়ার জন্য বিলিয়ন বিলয়ন ডলার ব্যয় করে দালাল তৈরি হচ্ছে । ভারতের তৈরি করা হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ চর-দালাল হয়েছে যারা বিভিন্ন নামে বিভিন্নভাবে প্রকাশ্যে-গোপনে আমাদের ওপর শিকড় কাটছে।
অন্যদিকে সাংস্কৃতিক ও বিভিন্ন ধরনের বিনিময় চুক্তির নামে আমাদের পুলিশ, র্যাব, বিজেবি, সেনাসদস্য, আমলা, বিচারক, শিক্ষক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, শিক্ষার্থীদেরকে তথাকথিত প্রশিক্ষণ ও সৌজন্য সফরের অজুহাতে দলে দলে বিভিন্ন ভারতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাদের মগজ ধোলাই করে তাদেরকে বুঝানো হচ্ছে: ভারত কতো বড়, কতো শক্তিশালী। বাংলাদেশ ভারতের অংশ হলে বাংলাদেশের জনগণই হবে। তারা চাকরি এবং বিলাসী জীবনের সুযোগ পাবো। কীভাবে উপকৃত হবে সেই মিথ্যা কল্প-কাহিনীও শোনানো হয়। ভারতগামীদেরকে সামনে অনেককেই রঙিন ভবিষ্যতের লোভ দেখিয়ে টাকার বিনিময়ে চর হিসেবে নিয়োগ করা হয়। তাদেরকে বুঝানো হয় এক সময় ভারত ও বাংলাদেশ এক ছিল। আবার এক হলেও বাংলাদেশের জনগণ কিছুই হারাবে না, কিন্তু পাবে অনেক কিছু। কিন্তু ওরা কখনোই বলে না, হিন্দুদের কেমন অত্যাচার থেকে মুক্তি পাবার জন্য আমাদের পূর্ব-পুরুষরা হাজার মাইল দূরের অজানা অচেনা মানুষকে নিয়ে পাকিস্তান বানিয়েছেন। আবার পাকিস্তানের অন্যায় আচরণ ও শোষণ থেকে মুক্তির জন্য আমরা পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসেছি। এখন আমাদেরকে ভারতের খাঁচায় ঢুকানোর নানা ধরনের প্রকাশ্য ও গোপন পাঁয়তারা চলছে।
আমাদেরকে ভারতের সুদূরপ্রসারী দূরভিসন্ধি বুঝতে হবে। যেকোন মূল্যে ভারতের বাইরে থাকতে হবে। আমাদেরকে কাশ্মীর-আসাম-উত্তরপ্রদেশসহ সারা ভারতের মুসলমানদের করুণ দশা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। জানতে হবে কেমন দুর্দিশা-দুর্বিপাকে পড়ে আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রতিবেশী ভারতে যোগ না দিয়ে ১০০০ মাইল দূরের অজানা মানুষকে নিয়ে পাকিস্তান বানিয়েছিলেন। ভারতের খাঁচায় ঢুকার জন্য আমরা পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে আসি নি। এই ধরনের জঘন্য চক্রান্তে পা দিয়ে আমরা আবার ভারতের অংশ হয়ে গেলে আমাদের অস্তিত্ব চিরতরে হারিয়ে যাবে। আমাদের সন্তানরা হিন্দুদের ঝি-চাকর হবে। মুটে-মজুর হবে। রিকসা টানবে। মেয়েরা হিন্দুদের ভোগের শিকার হবে। এক সময় বলবে: মুসলিম পরিচিতি চেড়ে দাও। গরু খাওয়া বন্ধ কর। কপালে তিলক-সিঁদুর লাগাও। দাড়ি-টুপি-নামায-কোরবানি-মসজিদ ছাড়। হিন্দু হয়ে হও অথবা মরার জন্য প্রস্তুত হও। অধিকৃত কাশ্মীরসহ সারা ভারতের মুসলমানদের দুর্বিসহ জীবন, মুসলমানবিরোধী হাজার হাজার দাঙার শিকার লাখ লাখ ভারতীয় মুসলমানদের মৃত্যু- যন্ত্রণা ও স্বজন-হারানো সব-হারানোদের আত্মনাদের আওয়াজ কী আমরা অনুভব করি না ? আমাদের এমন কিছু গোলাম রয়েছে যার কাশ্মীরকে, এনআরসি, এনএএ’কে ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে ফতুয়া দেয়। ভারতের ছায়ার নিচে থেকেই এরা সামনে এসেছে। তাই এদের কথায় লেখায় ও কাজে ভারতের চাওয়া-পাওয়ার প্রতিফলন ঘটবে। এটা না বুঝলে আমাদের অবস্থা চরম ভয়াবহ হবে। তাই চর-দালালদেরকে সর্বক্ষেত্রে বর্জন করতে হবে।
এই বিপদ মুকাবেলা করার জন্য আমাদেরকে একুশের চেতনাকে ধারন করতে হবে। কথায় ও কাজে এই চেতনার বহির্প্রকাশ থাকতে হবে। উর্দুকে তালাক দেয়া জাতি হিন্দিকে লাথি না মারলে আমাদের সব অর্জন আর স্বাধীনতা বিলুপ্ত হবে। আমাদের স্বদেশের সুরক্ষা করতে ভাষা আন্দোলন এবং স্বাধীন যুদ্ধের শহীদের জীবনদানকে সামনে আনতে হবে। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বদেশকে আমরা মুসলিম অস্তিত্ববিরোধী হিন্দুদের মিষ্টি কথা শুনে, জামাই-আদর দেখে, অর্থ-সুনাম-পদ্মভূষণ পুরষ্কারের পেয়ে, এমনকি এমপি মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, সেনাপ্রধান, সচিব বানানোর আশ্বাসে বিমোহিত বিভ্রান্ত বিচ্যুত হয়ে স্বাধীনতাকে বিলিয়ে দিতে পারি না।
সরকারী উদ্যোগ না আসলে সাধারণ মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। সরকার না থাকা অবস্থাতেই এই ভূখন্ডের ভাষা রক্ষিত হয়েছে। এই ভূখন্ড স্বাধীন হয়েছে। সাধারণ মানুষের সন্তানরাই জীবন দিয়ে অসাধারণ কাজ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। মানব ইতিহাসে সাধারণ মানুষের সন্তানরাই অন্যায়ের শিকার হয়েছেন। অন্যায়কে প্রতিহত করেছেন । বিজয়ী হয়েছেন। বাহান্ন কিংবা একাত্তর আমাদেরকে এটাই শিখিয়েছে। আমরা শিখেছি যে ভাষায় (হিন্দি) আমাদের পূর্বপুরুষরা কথা বলেন নি, যে (হিন্দু) সংস্কৃতি তারা অনুশীলন অনুসরণ করেন নি, সেই ভাষা সেই সংস্কৃতি আমাদের নয়। কুর্নিশ-মাথা নোয়ানো, আদাব-নমষ্কার, হিন্দুদের পুজার উপাদান মঙ্গল প্রদীপ আমাদের নয়। তথাকথিত মঙ্গল শোভাযাত্রা আমাদের নয়। ভুত, প্রেত, পেঁচা, ময়ুর, মনসা (সাপ), রাধা-শ্রীকৃঞ্চ, রাম-সীতা, লক্ষী, গান্ধী-নেহেরু-প্যাটেল, মোদি-জঙ্গী অমিত শাহরা আমাদের প্রভু নয়।
ধুতি, গলার দুইপাশে গামছা ঝুলানো, রাখি বন্ধন, গায়ে হলুদের নামে যুবক-যুবতী গায়ে হলুদ রং ও পানি ছিটিয়ে কাপড়-শরীর ভিজিয়ে দেয়া নাচানাচি করা, বিয়ের সময় মেহমানদের কিংবা বর-কনের কপালে লাল রং লাগানো সবই হিন্দু সংস্কৃতি এইগুলো মুসলমানদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে একদল ছদ্মবেশী মুসলিম ভারতীয় চর এবং ভারতীয় নাকট, সিরিয়াল, সিনেমার মাধ্যমে।
আমাদেরকে তাই বাঙালী সংস্কৃতির নামে হিন্দু-সংস্কৃতির আগ্রাসন প্রতিরোধ করে আমাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আমাদের ধর্মকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য হিন্দু সংস্কৃতির থাবা হতে মুক্ত থাকলেই আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব টিকে থাকবে। এখানে ব্যর্থ হবার কোন সুযোগ নেই। ব্যর্থ হওয়া মানেই ভারতের গোলাম হওয়া হিন্দু হবার রাস্তা তৈরি করা, যা আমাদের সব চেতনার সব অর্জনের বিরোধী। একুশ আমাদেরকে এটা শেখায় নি। একুশ মানেই টিকে থাকার লড়াই। টিকে থাকা। মাথা নত না করা। আগ্রাসী শক্তির মুখোমুখি হওয়া Ñ সেটা পাকিস্তান হোক আর হিন্দুস্থানই হোক।*
রচনাকাল: ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২০