রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বরা চিহ্নিত হওয়া উচিত
মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন: ৭ মে (২০২০) ঢাকার দৈনিক ‘যুগান্তর’এর অনলাইন ভার্সানে “সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘গুরুত্ব¡পূর্ণ’ ব্যক্তিদের নিয়ে ‘বিরূপ মন্তব্য করলেই ব্যবস্থা” শীর্ষক প্রতিবেদনটি আমার মতো অনেকেরই মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।
দৈনিকটি জানায়, “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য সম্বলিত পোস্ট, ছবি, অডিও বা ভিডিও আপলোড, কমেন্ট, লাইক ও শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে সরকারি চাকরিজীবীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
‘সরকারি প্রতিষ্ঠানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার নির্দেশিকা, ২০১৯ (পরিমার্জিত সংস্করণ)’ অনুসরণ করা নিয়ে বৃহস্পতিবার (৭ মে) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এক পরিপত্র জারি করেছে।
এতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ‘অপব্যবহার’ বা নিজ অ্যাকাউন্টে কেউ “তিকারক কনটেন্ট’ দিলে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীকে দায়ী করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানানো হয়েছে।”
এই পরিপত্রে উল্লেখিত কয়েকটি বিষয় জনমনে বিভ্রান্তিমূলক প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে: ১. ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ’ কারা? ২. কেন তাদের প্রসঙ্গে ‘বিরূপ’ মন্তব্য করতে কেউ বাধ্য হয়? ৩. ‘অন্যকোন রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ বলতে কোন কোন রাষ্ট্রকে এবং সেই রাষ্ট্রের কোন কোন ব্যক্তিকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বুঝানো হয়েছে? ৪. কী কারণে ওই অজ্ঞাত দেশ ও তাদের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সম্পর্কে বাংলাদেশের কেউ সঙ্গত ‘বিরূপ’ মন্তব্য করতে পারবে না অথবা বাংলাদেশীরা কেন ‘বিরূপ’ মন্তব্য না করতে ওই অনুল্লেখিত দেশ এবং দেশের গুরুত্বপূর্ণ’ ব্যক্তিদের কাছে দায়বদ্ধ ?
এইসব প্রশ্নের উত্তর তথা ব্যাখ্যা অতীব জরুরী। তা’হলে আমাদের মতো ‘অবুঝ’ ওই মহান ‘দেশ ও তাদের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’দের গুরুত্ব ও কর্তৃত্ব অনুধাবন করতে সক্ষম হবে।।
তবে ওই নামহীন ভাসুর দেশ যদি ভারত হয়, এবং মোদি-অমিতের মতো খুনিরা ‘রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব’ হয় তবে তাদের প্রতি তো আমাদের কোন দায়বদ্ধতা কিংবা আনুগত্যতা নেই। বাংলাদেশ তো ভারতের করদরাজ্য নয়, যে দিল্লীর খুনিদেরকে তোয়াজ করতে হবে। আমরা তো রক্ত দিয়ে পাকিস্তানীদের তাড়িয়ে হিন্দুদের গোলাম হবো না। ভারত আমাদের সম-মর্যাদাসম্পন্ন বন্ধু হতে পারে, প্রভু নয়। আর প্রভুর মতো আচরণ করলে ভারত কিংবা মোদি-অমিতের মতো খুনিদের বিরুদ্ধে আমাদের দেশের জনগণ সোচ্চার হবেই।
ভারত আমাদেরকে বাধ্য করছে তাকে রুখে দঁড়াতে। তাই একেবারেই খোলা মনে মনের জ্বালায় লিখি। কারো কাজে কথায় দেশ ও জাতির সামান্যতম ক্ষতির সম্ভাবনা আাঁচ অনুভব করলেই লিখি । তাদের ভালো কাজে খুশি হই। (সম্প্রতি ভারতীয় সৈন্যদের বাংলাদেশে আসতে না দেয়ার সিদ্ধান্তের পক্ষে লিখেছি)। এইগুলো কারো জন্য ‘বিরূপ’ হলেও আমার জন্য দেশপ্রেম, আমার দায়িত্ব। আমাকে তা করতেই হবে Ñ তা যতো দুরূহ কিংবা বিপজ্জনকই হোক। এটা তো ৭১’এর শিক্ষা।
আমার মতো যারা মনের জ্বালায় লেখালেখি করেন এই পরিপত্র নিয়ে তারা উভয় সংকটে রয়েছেন। আমরা ঠাহর করতে পারছি না, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কারা এবং কারা নন। খুনী, চোর-চোট্টা, ব্যাংক-শেয়ার বাজার লুটেরা, দেশের সম্পদ বিদেশে পাচারকারী, ঘুষখোর আমলা, বুদ্ধিবিক্রিজীবী বিদেশী চর থেকে শুরু করে চাল-ডাল, পেঁয়াজ-তেল-নুন চোররা তো একই গুরুর শিষ্য। এই ধরনের লোকরা তো রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হতে পারে না। বরং এরা তো নিন্দিত ও ধিকৃত সমাজচ্যুত হবার কথা। এদের অপকর্মের বিরুদ্ধে তো মানুষ কথা বলবেই। কমেন্ট করবে। ব্যঙ্গচিত্র আঁকবেই।
তাই আমরা ‘কনফিউশনে’ ভুগছি। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের চিনতে কষ্ট হয়। তাই ‘রাষ্ট্রীয় ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ এবং গুরুত্বহীন ব্যক্তিদের পৃথক পৃথক তালিকা প্রকাশ করা জরুরী। তেমন তালিকা করা কঠিন হলে তাদের বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী তা জনসমক্ষে তুলে ধরা হোক। ওই বৈশিষ্ট্যের আলোকে আমরা বুঝতে পারবো কারা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি আর কারা নন।
কিন্তু এতেও সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ মন্ত্রী, এমপি, আমলা, চেয়ারম্যান-মেম্বার, পুলিশ র্যাবের অনেকের বিরুদ্ধে চুরি-চামারি, লুটপাটের, খুনের অভিযোগ শোনা যায়। এই ধরনের ব্যক্তিরাও ‘রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ কী না এটা নিয়ে আমরা বিভ্রান্তিতে ভুগছি। এই সমস্যা থেকে বের হবার জন্য একটা রাস্তা আছে। তাহলো সরাসরি বলে দেয়া হোক: সরকারী দলের গ্রামীণ মেম্বার থেকে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত Ñ তাদের অনুচর, সহচর, চাটুকার, মোসাহেব, চামচাবাহিনী, লাঠিয়াল প্রমুখরা ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব’ এবং রাজদরবার থেকে ফরমান জারি করা হোক: তাদের সব ধরনের অপকর্ম তথা রাষ্ট্রীয় সম্পদ চুরি, ঘুষ-দুনীর্তি, খুন-খারাবিসহ সব ধরনের অপরাধ ‘সমালোচনার উর্ধ্বে।
এই ধরনের একটি স্পষ্ট নির্দেশনা আসলে ‘রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব’ সম্পর্কে ‘বিরূপ মন্তব্য’ সম্বলিত কোনো পোস্ট, ছবি, অডিও বা ভিডিও আপলোড, কমেন্ট, লাইক, শেয়ার করা থেকে আমাদের মতো ‘অবুঝ’ ‘না-লায়েক’দেরকে বিরত থাকতে সাহায্য করবে। এখন তো আমরা আঁন্ধা’র মতো: দিন-রাত, উঁচু-নিচু সব সমান। আমরা ঠাহর করতে পারছি না, কে সাধু, কে শয়তান? নাকি সবাই সাধু-শয়তান?
এই পরিপত্রের মূলসুর হলো ‘রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ’ ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে কোন ‘বিরূপ মন্তব্য’ করা যাবে না। ‘বিরূপ’ মন্তব্য বলতে সম্ভবত সমালোচনা, নিন্দা, কঠাক্ষ ইত্যাদিকে বুঝানো হয়েছে । এই পরিপত্রের ভাষা ও নির্দেশনা দেখে নিন্দুকেরা সাবেক সরকারী কর্মচারী মখা আলমগীরের উদাহরণ সামনে আনেন। পাকিস্তান আমলের মুসলিম লীগার শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের খালকাটা কর্মসুচির ওপর পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনকারী এরশাদের খয়ের খা ডিগবাজিতে ওস্তাদ মখা আলমগীর একজন আমলা । সচিবালয়ের আমলাবাহিনীকে উসকিয়ে শেখ হাসিনার সৃষ্ট ‘জনতার মঞ্চে’ এনে মখা পরিপত্র অনুযায়ী অবশ্যই রাষ্ট্রদ্রোহিতার কাজ করেছেন।
কিন্তু রাষ্ট্রীয় বিধি ভঙ্গ করে আমলাদেরকে জনতার মঞ্চে আসার জন্য শেখ হাসিনা মখা’কে পুরস্কৃত করে মন্ত্রী বানিয়েছেন। ভোটচুরি থেকে শুরু করে তার বিরুদ্ধে জনগণের সম্পদ চুরির অভিযোগ রয়েছে। বঙ্গবন্ধু এদেরকে ‘চোর’ বলে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। যদি কেউ চুরি করে তবে তাকে চোরই বলা হবে। এটা তো তাদের অর্জন। চিহ্নিত চোর একই সময়ে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে না ।
দুর্মুখরা বলছেন এই ধরনের লোকেরাই এখন রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত। লোক-দেখানো শুদ্ধি অভিযানের নামে যে ২/৪ জনকে ধরা হয়েছে তাদের মধ্যে এই মার্কা রাষ্ট্রীয় ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ব্যক্তিও রয়েছে। হঠাৎ ‘শুদ্ধি অভিযান’ মরে যায়। শুদ্ধি অভিযান সম্পর্কে ওয়ায়েদুল কাদেরের কোন তর্জন-গর্জন নেই। দুমুর্খরা বলছেন: শুদ্ধি অভিযান চললে কাদেররাও হারিয়ে যাবেন।
অন্যদিকে সব মানুষই যার যার অবস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। যেমন গ্রামীণ মেম্বারও তার ওয়ার্ডে গুরুত্বপূর্ণ। ওই মেম্বারই আবার চাল-ডাল-আলু-তেল চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত। একই ব্যক্তি মেম্বার ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব’ আবার চুরিবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ধিকৃত। তাই এই ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ অথচ চোরের বিরুদ্ধে কেউ মন্তব্য করলে তা কী আইনবিরোধী বা রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে ? ওই চোরা মেম্বারও জনপ্রতিধি, রাষ্ট্রব্যবস্থার অংশ। এখন নিন্দুক জনগণ কোনদিকে যাবে?
সরকারের দায়িত্ব হবে ‘বিরূপ’ মন্তব্য তথা সমালোচনা যেন হতে না পারে তেমন ব্যবস্থা করা। ভোটসহ সব ধরনের চুরি, ডাকাতি, লুট , ঘুষের মতো অপরাধ বন্ধ করা। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়া। তাহলেই ফেসবুকে বিরূপ মন্তব্য বন্ধ হয়ে যাবে। চোর আর ডাকুদেরকে না ধরে তাদের নিন্দুকদেরকে ধরার জন্য নির্দেশনা বা পরিপত্র জারি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না, এবং বিরূপ মন্তব্যের জোয়ার বন্ধ করাও যাবে না।
সবাইকে মনে রাখতে হবে সরকারী-বেসরকারী চাকরিজীবী কিংবা আমাদের মতো অপাঙক্তেয়রা তো এই দেশেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ । আমরাও সমাজের দেশের সব সুখ-দুঃখের সমভাগী, সমভোগী। সুতরাং রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী না হলে দেশের সবশ্রেণীর মানুষই মত প্রকাশের অধিকার রাখেন। সরকার দেশের মালিক নয়, মালিক জনগণ। জনগণ থেকে সরকার হয়, সরকার থেকে জনগণ হয় না। জনগণের কাছে সরকার দায়বদ্ধ, সরকারের কাছে জনগণ নয়। সর্বোপরি, সরকার আর রাষ্ট্র এক নয়। সরকারের অপকর্মের বিরুদ্ধে কথা বলা মানে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলা নয়। সরকার দেশ চালায় । দেশ চালনায় সরকার কোন ভুল করলে কোন অন্যায় হলে তা শুধরে দেয়ার, নিন্দা করার, সংশোধনের পরামর্শ দেয়ার অধিকার জনগণের রয়েছে।
একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ভারতের উদীয়মান একনায়ক মোদি সরকার তার সমালোচকদের ঘায়েল করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা ঠুকেছিলেন। সুপ্রীমকোর্ট সরাসরি রায় দিয়েছে: সরকারের সমালোচনা আর রাষ্ট্রদ্রোহিতা এক নয়। সুতরাং কথিত অচিহ্নিত কথিত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অপকর্মের বিপক্ষে ‘বিরূপ মন্তব্যের জন্য কঠিন শাস্তির ঝুঁকি থাকবে এমন ধমক গ্রহণযোগ্য ও যুক্তিসংগ নয়। *
রচনাকাল: ৭ মে, ২০২০