লক ডাউনে নিউইয়র্কের ঘরে ঘরে ঈদের জামাত
বিশ্বজাহানের ইতিহাসে এই প্রথম ভিন্নধর্মী পরিবেশে রোববার (২৪ মে) পবিত্র ঈদুল ফিতর পালিত হলো। করোনাকালের লক ডাউনে নিউইয়র্ক সহ দেশ দেশে পরিবারের সদস্য নিয়ে ঈদের জামাত হলো ঘরে ঘরে। আবার কেউ কেউ পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীদের নিয়ে বাসা-বাড়ীর ব্যাকইয়ার্ডে ঈদের জামাতে নামাজ আদায় করেছেন। তবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কোন কোন মসজিদে সীমিত সংখ্যক মুসল্লি নিয়ে ঈদের জামাত হয়েছে। কোথাও কোথাও খোলা আকাশের নীচে মাঠে ঈদের জামাত হয়েছে।
ঈদের নামাজ আদায় শেষে বিশেষ মুনাজাতে মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে করোনা মুক্ত বিশ্ব সহ সমগ্র মুসলিম জাহান তথা মানব জাতির সুখ-সমৃদ্ধি কামনা করা হয়ছে। এছাড়াও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে নিহতদের বিদেহী আতœার মাগফেরাত ও শহীদী মর্যাদা দান এবং আক্রান্তদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করা হয়। সব মিলিয়ে মরণ ঘাতক করোনাভাইরাসের আবির্ভাবের ফলে এবারের ঈদুল ফিতর ছিলো সাদামাঠা, নিষ্প্রাণ, শোকাহত, বেদনাবিধুর।
পবিত্র ঈদুল ফিতর যুক্তরাষ্ট্রে পালিত হলো শোকাবহ পরিবেশে। মসজিদে মসজিদে তারাবীর নামাজ হয়নি, মসজিদ ছিল বন্ধ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশুদের নতুন কাপড় কেনা হয়নি। চিরাচরিত নিয়মে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়ের পথও ছিলো বন্ধ। শীর্ষ ধর্মীয় উৎসব শৃংখলিত বৈশ্বিক মহামারীর কাছে।
এদিকে গত ২২ মে শুক্রবার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হঠাৎ করে সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান উম্মূক্ত করার ঘোষণা দেন। অপরদিকে গত ২০ মে বুধবার নিউইয়র্ক-এর গভর্নর কুমো ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় ১০ জনের উপস্থিতিকে অনুমোদন দেন। তার অনুমোদন ছিল মরদেহ সমাহিত করার আনুষ্ঠানিকতার জন্য। গভর্নর কোমোর ১০জন অনুমোদনের সূত্র ধরে বিভিন্ন মসজিদ ১০জনের উপস্থিতিতে ভার্চুয়াল ঈদ জামাতের ঘোষণা দেয়। তবে অধিকাংশ মসজিদ ঈদ জামাত থেকে বিরত থাকে।
নিউইয়র্ক সহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন মসজিদে ৮/১০ জনের উপস্থিতিতে ভার্চুয়াল ঈদ জামাতের খবর পাওয়া গেছে। নিউইয়র্কের জামাইকা মুসলিম সেন্টার, ম্যানহাটনের মদীনা মসজিদ, আব্দুর রহমান মসজিদসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের অসংখ্য মসজিদ এই নিয়মে ঈদ জামাত আয়োজন করে। খুব অল্পসংখ্যক মানুষ এভাবে নামাজ আদায় করেছেন। তবে অধিকাংশ মুসলিম নর-নারী এক মাস সিয়াম সাধনার পর ঈদ আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেছেন বাসা-বাড়িতে স্ব স্ব গৃহে।
নিউইয়র্কের বাংলাদেশী মুসলিম কমিউনিটির শীর্ষ স্থানীয় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে (জেএমসি) সমাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ঈদুল ফিতরের একটি জামাত অনুষ্ঠিত হয় রোববার সকাল পৌনে ৯টায়। এতে ইমামতি ও খুৎবা পাঠ করেন ইমাম শামসে আলী। এই জামাতে ১১জন মুসল্লি অংশ নেন বলে জানা গেছে। ঈদের জামাতের আগে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন নিউইয়ক সিটির পুলিশ কমিশনার ডেরমোট এফ. শিয়া, জেএমসি’র ট্রাষ্টিবোর্ডের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোজাফফর, পরিচালনা কমিটির সভাপতি ডা. সিদ্দিকুর রহমান ও সেক্রেটারী মনজুর আহমেদ চৌধুরী। এছাড়াও কিভাবে নামাজ আদায় করা হবে তা তুলে ধরেন জেএমসি পরিচালিত আল মামুর স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল হাফেজ মুজাহিদুল ইসলাম।
জেএমসি’র ঈদের জামাতের শুরুতে ঈদুল ফিতর বিষয়ে বক্তব্য রাখেন এবং শেষে বিশেষ মুনাজাত পরিচালনা করেন জেএমসি’র পেশ ইমাম ও খতিব মওলানা মির্জা আবু জাফর বেগ। তিনি বাংলাদেশ থেকে অংশ নেন।
জ্যামাইকার দারুল উলুম মসজিদে সমাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ঈদুল ফিতরের ৪টি জামাত অনুষ্ঠিত হয় বলে জানা গেছে। সকাল আটটায় আরো একটি ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় এস্টোরিয়ার গাউছিয়া জামে মসজিদে। এতে নামাযে ইমামতি করেন প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন মাওলানা জালাল সিদ্দিীকি। এস্টোরিয়া এলাকায় বসবাসরত অনেক প্রবাসী বাংলাদেশী এখানে ঈদের নামায আদায় করেন। জামাতে উপস্থিত সবাই সোস্যাল ডিসটান্স বজায় রাখেন।
নিউইয়র্কে সবচেয়ে বড় ঈদের জামাতটি অনুষ্ঠিত হয়েছে ব্রঙ্কসের পেলাম পার্কের বাস্কেট বল মাঠে। এখানে সোস্যাল ডিসটান্স মেনে নামাজ আদায়ের অনুমতি দেয় স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন। রোববার সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে জামাত অনুষ্ঠিত হবার কথা থাকলেও সকাল ৭টার আগেই পুরো মাঠ ভর্তি হয়ে যায়। মুসুল্লীরা নিজ নিজ নামাজের বিছানা নিয়ে সোস্যাল ডিসটান্স মেনে কাতারবন্দী হয়ে বসে যান। পাঁচ শতাধিক মুসুল্লি এখানে নামাজ আদায় করেছেন এবং নিউইয়র্ক সিটিতে এটাই সবচেয়ে বড় ঈদ জামাত বলে জানা গেছে।
এছাড়াও ব্রঙ্কসে আরো একটি জামাত অনুষ্ঠিত হয় পার্কচেস্টারের খলিল পার্টি সেন্টারে। সকাল ১০ টায় অনুষ্ঠিত এই জামাতে ইমামতি করেন পার্কচেস্টার ইসলামিক সেন্টারের ইমাম ও খতিব মাওলানা ওবায়দুল হক। নামাজ শেষে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের আত্মার মাগফেরাত এবং যারা অসুস্থ আছেন তাদের দ্রুত আরোগ্যের জন্য দোয়া করা হয়। নামাজ শেষে সকল মুসল্লিকে খলিল বিরিয়ানী হাউজের পক্ষ থেকে আপ্যায়িত করা হয়।
নিউইয়র্কের কুইন্স বুরোর উডসাইড বায়তুল জান্নাহ মসজিদে তিন দফায় ৭০জনের উপস্থিতিতে ৩টি জামাত অনুষ্ঠিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। নিউইয়র্কে অপর একটি মসজিদে ৭০জন করে ২শ জন ঈদের নামাজ আায় করেছেন।
ব্রঙ্কসের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সৈয়দ শারফিন মোর্শেদ তার বাসার সুবৃহৎ ব্যাক ইয়ার্ডে আত্মীয় পরিজন এবং পাড়া প্রতিবেশীদের নিয়ে জামাত আদায় করেছেন। তিনি জানান, প্রথমে ধারনা করেছিলাম আমাদের ফ্যামিলির লোকজন নিয়েই ঘরে ঈদের নামাজ আদায় করতে হবে। পরে গভর্নর কুমো লক ডাউন কিছুটা শিথিলের ঘোষণা দেয়ায় আত্মীয় পরিজন এবং পাড়া প্রতিবেশীদের নিয়ে বাসার ব্যাক ইয়ার্ডে নামাজ আদায় করেছি।
লং আইল্যান্ডের লেক রনকনকোমা পার্কে সকাল ১১টায় একটি মাত্র জামাত অনুষ্ঠিত হয়। জামাত শেষে করোনায় হারিয়ে যাওয়া সকলের জন্য দোয়া করা হয়।
নিউজার্সী অঙ্গরাজ্যের প্যাটারসন থেকে বিএনপি নেতা সৈয়দ জুবায়ের আলী জানান, তারা স্থানীয়দের নিয়ে পাশের ছোট একটি পার্কে নামায় আদায় করেছেন। আশে পাশের বাংলাদেশী কমিউনিটির লোকজনও ছোট ছোট গ্রুপ করে কোথাও বাড়ীর আঙিনা বা পার্কে গিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করেছেন। নিউজার্সীর বাউলা সিটিতে প্রবাসী চট্টগ্রাম বাসীর উদ্যোগে সিটির আইন মেনে ডেলাওয়ার নদীর পাশে একটি পার্কে ঈদের জামাত করেছেন বলে জানা গেছে।
এছাড়াও এটর্নী মঈন চৌধুরী, যুক্তরাষ্ট্র জাসদ নেতা দেওয়ান শাহেদ চৌধুরী, ট্যাক্স কনসালটেন্ট মিয়া মোহাম্মদ আবজাল পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিজ নিজ বাসায় জামাত করে ঈদের নামাজ আদায় করেছেন বলে জানিয়েছেন।
অপরদিকে মিশিগান অঙ্গরাজ্যের প্রতিটি মসজিদে একাধিক ঈদের জামাত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। মাস্ক, গ্লাবস আর নিজ নিজ জায়নামাজ নিয়ে শত শত মুসল্লী ঈদ জামাতে অংশ নেন। কানেকটিকাট অঙ্গরাজ্যে ৫০জন করে দু’টি জামাতে অংশ নিয়েছেন ১০০ মুসল্লী। এই ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয় ম্যানচেস্টার বায়তুল মামুর মসজিদে।
জালালাবাদ এসোসিয়েশন অব আমেরিকা’র সভাপতি হেলাল চৌধুরী বসবাস করেন কানেকটিকাট অঙ্গরাজ্যে। সেখানে ম্যানেচেস্টার মসজিদে দুটি জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে তিনি জানান। এই দুই ঈদ জামাতে ৫০জন করে মুসল্লী অংশ নিয়েছেন। তবে হেলাল চৌধুরী নিজে নিরাপত্তা ঝুকি বিবেচনায় নিজ বাসায় ঈদের নামাজ পড়েছেন বলে জানিয়েছেন।
সিলেট চেম্বারের সাবেক পরিচালক লায়েছ উদ্দিনের বসবাস করেন মিশিগানে। ঈদ জামাতে উপস্থিতি কেমন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, নিজে একটি মসজিদে গিয়ে ফিরে আসেন। কারন সামাজিক দুরত্বের কারনে বড় মসজিদেও অনেক লম্বা লাইন। মসজিদ পরিবর্তন করে অন্য একটি মসজিদে নামাজ আদায় করেন জামাতের সাথে।
নর্থ ক্যারোলিনা অঙ্গরাজ্যের মসজিদে মসজিদে সীমিত মুসুল্লীর উপস্থিতিতে ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় হয়েছে। এছাড়াও বাসে বসে ঈদের নামাজ আদায় ও ভাচ্যুয়াল পদ্ধতিতে ঈদের নামাজের খুৎবা ও বিশেষ মুনাজাতে সর্বস্তরের শত শত নারী-পুরুষ অংশ নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
এছাড়া ওয়াশিংটন ডিসিসহ যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সী, কানেকটিকাট, ম্যারিল্যান্ড, পেনসেলভেনিয়া, ভার্জেনিয়া, ওয়াহিও, ফ্লোরিডা, নর্থ ক্যারোরিনা, সাউথ ক্যারোলিনা, জর্জিয়া, মিশিগান, ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস, এরিজোনা সহ প্রভৃতি স্টেটে ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।