আবারও আগাচৌনামা! -মারুফ কামাল খান সোহেল
জানি মিথ্যে লিখছেন। জানি ভুল ও কল্পিত তথ্য এবং কুযুক্তিতে ভরা। তবু একসময় উনার লিখা পড়তাম। লেখায় গল্পগাছা তো থাকতোই উপরন্তু ভাষাশৈলী ও বাক্যবিন্যাসে থাকতো একটা মুন্সিয়ানার ছাপ। আমার মতন অনেকেই এ-কারণেই আগাচৌর লেখা পড়তেন, তাকে বিশ্বাস না করলেও।
মিথ্যারও তো একটা সহনীয় মাত্রা থাকে। বয়োবৃদ্ধ প্রবাসী লেখক-সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী সেই মাত্রা ও সীমানা অনেক আগেই ছাড়িয়েছেন। তাই তার লেখা পড়া ছেড়েছি অনেককাল। আমাকে আর টানেনা মোটেও তার লেখা। বরং ত্যক্তবিরক্ত বোধ করি তার একপেশে লেখা পড়তে গেলে।
আরো অনেক পাঠকের অবস্থাও আমার মতনই মনে হয়। তাই দেশি কাগজগুলোতে গাফফার ভাইয়ের লেখা ছাপবার তেমন কোনো প্রতিযোগিতা আর চোখে পড়েনা। তার লেখা নিয়ে কোনো আলাপ আলোচনাও হয়না আর। এখন মোটামুটি সকলেই তাকে একটি রাজনৈতিক দলের অন্যতম প্রচারবিদ বলেই মনে করে। তার লেখাকে আর সৃজনশীল কিংবা সাংবাদিকতা বলে মনে করা হয়না। তার বদলে বিশেষ দলের পাবলিসিটি ম্যাটেরিয়াল বলেই মনে করেন অনেকেই।
ঢাকা কলেজের ইন্টারমেডিয়েট ক্লাসের ছাত্র থাকতে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গীতি-কবিতাটি লিখেছিলেন তিনি। প্রথমে সেটি ‘একুশের গান’ শিরোনামে প্রচারপত্র ও সংকলনে স্থান পায়। কলেজের তখনকার ছাত্রসংসদ নেতা মাশির হোসেন (পরবর্তীতে দৈনিক বাংলা পত্রিকার সাংবাদিক। তাঁকে হিরু ভাই বলে ডাকতাম আমরা।
বর্তমানে মরহুম) সেই কবিতাটি পাঁচ টাকার বিনিময়ে আব্দুল লতিফকে দিয়ে সুরারোপ করিয়ে অনুষ্ঠানে গাওয়ার ব্যবস্থা করেন। এতে হিরু ভাইসহ এগারো জন ছাত্রকে ঢাকা কলেজ থেকে প্রিন্সিপ্যাল জালাল সাহেব (প্রয়াত রাজনীতিক, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের শ্বশুর) বহিষ্কার করেন।
আরো পরে শহীদ আলতাফ মাহমুদ সেই গানে নতুন করে অসাধারণ সুরারোপ করেন। দারুণ লোকপ্রিয় হয়ে ওঠে গানটি এবং একুশের শহীদ দিবসে প্রভাত ফেরির শোকসঙ্গীত হয়ে দাঁড়ায়। সেই গানের গীতিকার হিসেবে গাফফার ভাইও সমানভাবে জনপ্রিয় হন।
গল্প লিখবার হাত খুব ভালো ছিল তার। বাঙলা ভাষাও আয়ত্বে ছিল ভালোই। সে-সব গুণাবলীর কারণেই সাংবাদিকতায় ঢুকে কলাম-লেখক হিসেবে জনপ্রিয়তা পান। কিন্তু সম্পাদক হিসেবে সুবিধা করতে পারেন নি। সান্ধ্য দৈনিক আওয়াজ ও দৈনিক জনপদকে সম্পাদক হিসেবে পাঠকপ্রিয় করা সম্ভব হয়নি তার পক্ষে।
এরপর অসুস্থ পত্নীর চিকিৎসার নামে ‘পঁচাত্তর সালে সপরিবারে বিলেত গমন এবং এর পেছনে খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর আনুকূল্য লাভের এন্তার গল্প তার সম্পর্কে বাজারে চাউর আছে। অবশ্য অপ্রমাণিত সে-সব গল্প-গুজবের বিশদ বিবরণ এখানে না-দেয়াই ভালো।
তবে একুশের গান বরাবরই একটা বড় পুঁজি গাফফার ভাইয়ের। আবেগপ্রবণ মানুষ হিসাবে আমরাও কখনো প্রশ্ন তুলিনা এক সময়কার একটি ইতিবাচক অবদানের জন্য আজীবনের সব অন্যায়-অপরাধ কি ইনডেমনিটি পেতে পারে? তাহলে তো রাশিয়ার ট্রটস্কি, চীনের লিন পিয়াও, বাংলাদেশের গোলাম আজম ও শাহ্ আজিজুর রহমানের বিরুদ্ধে এত নিন্দা থাকতো না। তারাও তো কখনো না কখনো নিজ নিজ অঙ্গনে কিছু না কিছু ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিলেন।
যা-হোক, যার লেখা এখন আমি আর নিজেই পড়িনা এবং যিনি মোটামুটি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছেন সেই আবদুল গাফফার চৌধুরী সম্পর্কে এত কথা নতুন করে বলার কারণ, সম্প্রতি তিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে ঢাকার এক দৈনিকে রচনা ফেঁদেছেন। সাংবাদিকতায় আমার সাবেক সহকর্মী কামাল আহমেদ তার সে-সব কুযুক্তি ও ভুল তথ্য খণ্ডন করে একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেই পোস্টে আমি একটা মন্তব্য করার পর ভাবলাম বিষয়টা ফেসবুকে আমার অন্য বন্ধুদের সঙ্গেও শেয়ার করি। তাই আমার সেই কমেন্টটি সম্প্রসারিত করেই এই পোস্ট।
গাফফার ভাই ঈমানদার মানুষ। একমাত্র একটা জিনিসেই ওনার অটল ঈমান। সেটার নাম হচ্ছে : ‘নগদ নারায়ণ।’ নগদ পেলে কার পক্ষে আর কার বিপক্ষে লিখছেন সে হুঁশ ও কান্ডজ্ঞানও তার থাকে না।
আমি একসময় অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক যায়যায়দিন পত্রিকায় লিখতাম। বয়স ও অভিজ্ঞতা বিবেচনায় উনার তুলনায় আমি একেবারেই নস্যি। অথচ তিনি আমার বিরুদ্ধেও কয়েক কাগজে লাগাতার লিখেছেন। তিনি যুক্তি ও তথ্য দিয়ে আমার লেখার জবাব দেয়ার পরিবর্তে সম্পূর্ণ ভুল ও মিথ্যা তথ্য সহযোগে আমার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণও করেছেন।
তিনি বস্তুগতভাবে লাভবান হয়ে সচরাচর আওয়ামী লীগ ও ইন্ডিয়ার পক্ষে লিখলেও ভাতা বন্ধ হলে তাদের বিরুদ্ধেও লেখালেখি শুরু করে দেন। আবার ভাতা চালু হলে ফের পুরনো ধারায় ফেরেন।
ক্ষমতায় থাকতে একবার লন্ডন সফরে গিয়ে এরশাদের দেখা হয় গাফফার ভাইয়ের সঙ্গে। তারপর কিসের বিনিময়ে জানিনা তিনি এরশাদকে মহিমান্বিত করে মস্ত লেখা ফেঁদে বসেন। সে লেখায় এরশাদকে কোমল হৃদয়ের প্রেমিক পুরুষ ও কবি সার্টিফিকেট দেন এবং প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, তার হাতে কোনো রক্তের দাগ নেই।
এককালে এরশাদের নির্বাচিতকবিতা-ছাপা সম্পাদক কবি শামসুর রাহমান এরশাদের বিপক্ষে যাবার কারণে গাফফার ভাই তার কবিতারও প্যারোডি লিখেন। ‘একটি মুনাজাতের জবাবের খসড়া’ শিরোনামের সেই প্যারোডিতে রাহমান ভাইয়ের বিরুদ্ধে ব্যাক্তিগত আক্রমণ ও তীব্র কটূক্তি করেন তিনি।
এরশাদের পতনের পর তার শ্যালক, সাবেক কূটনীতিক মহিউদ্দিনের বন্দোবস্তে তিনি বহুকাল পর দেশে ফেরেন এবং এরশাদকে উন্নয়নের রূপকার সাজিয়ে কলাম লেখা শুরু করেন। তিনি লেখেন, এতকাল পরে দেশে ফিরে তিনি উন্নয়নের নজির দেখে চমৎকৃত। ঢাকায় রিক্সাভ্রমণে বেরিয়ে তিনি বিভিন্ন স্থাপনা ও নির্মাণকাজ দেখে মুগ্ধ হন। রিক্সাঅলার সঙ্গে সওয়াল-জবাবে নাকি জানতে পারেন তার সবই ‘স্বৈরাচারের’ করা। আর এই সময়কালে দেশে খারাপ যা-কিছু ঘটেছে তার সবকিছুর জন্যই দায়ী ‘গণতান্ত্রিক শক্তি।’
সে-সময় সদ্য বিভক্ত সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সন্মেলনে যোগ দিয়ে প্রধান অতিথির ভাষণেও তিনি এরশাদের গুণকীর্তন করেন।
মাত্র কিছুদিন আগেই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত ও বন্দী এরশাদের পক্ষে এমন অসময়োচিত লেখা ও ভাষণের ব্যাপারে তার বন্ধুরাই তীব্র আপত্তি করতে থাকেন। সুবিধা হচ্ছেনা দেখে গাফফার ভাই পতিত স্বৈরাচারের ইমেজ বিল্ডিং মিশনের পাততাড়ি গুটিয়ে দ্রুত বিলেত ফিরে যান।
যুবক বয়সেই তিনি দৈনিক ইত্তেফাক ও পূর্বদেশ-এ চাকরিরত অবস্থায় টাকার বিনিময়ে ‘আজাদ’ পত্রিকায় সম্পূর্ণ উল্টো আদর্শের পক্ষে লিখেছেন। লেখার ক্ষেত্রে এমন অনৈতিকতার নজির এদেশে আর কারুর নেই। তার মতন মিথ্যে ও কল্পিত গল্প এম. আর. আকতার মুকুলও লিখতেন কিন্তু মুকুল ভাইয়ের লেখা কখনো আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে যায়নি। লেখক-সাংবাদিক হিসেবে কোনো কমিটমেন্ট না-থাকায় বদরউদ্দীন উমর ‘চানাচুর লেখক’ বলে অভিহিত করেছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরীকে।
কত মিথ্যে ও কল্পিত উদ্ধৃতি যে গাফফার ভাই দিয়েছেন তার কোনো লেখাজোকা নেই। তিনি একবার ফরহাদ মজহারের বিরুদ্ধে তিন কিস্তিতে মস্ত এক ধারাবাহিক লেখা লিখেন। এর জবাবে ফরহাদ মজহার লিখলেন : ‘গাফফার চৌধুরীর তিন কিস্তির জবাবে আমার এক কিস্তি।’ তাতে ফরহাদ মজহার প্রমাণ করে দেন যে, গাফফার ভাই তার লেখায় মার্ক্স-লেনিনের যেসব উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন সেগুলো সবই ভুয়া। নিজের মনগড়া উক্তিকেই তিনি মার্ক্স বা লেলিনের কোটেশন বলে চালিয়েছেন। সেই লেখায় ইউরোপের ল্যান্ডলকড বিভিন্ন দেশের সমুদ্রসৈকতে বেড়াবার কল্পিত গল্প ফেঁদেছিলেন গাফফার ভাই। ফরহাদ মজহার জবাবে লেখেন, এই দেশগুলোর কোনো সমুদ্রসৈকতই নেই। গাফফার ভাইয়ের লেখায় কতিপয় ইয়োরোপীয় বুদ্ধিজীবীর মতামতও তুলে ধরেছিলেন। ফরহাদ ভাই প্রমাণ করে দেন যে, এ-সব নামে কখনো কোনো বুদ্ধিজীবীই জন্মান নি। নামগুলো পর্যন্ত বানানো। গাফফার ভাইয়ের মিথ্যাচার এ-ভাবে হাতেনাতে ধরিয়ে দেয়ার পরেও তিনি কোনো জবাবই দিতে পারেননি এবং এরজন্য লজ্জিতও হননি।