করোনামুক্ত আর সমগ্র বিশ্বের কল্যাণ কামনার মধ্য দিয়ে উত্তর আমেরিকায় ঈদুল আযহা পালিত
সর্বত্রই সামাজিক দূরত্ব বজায় – মসজিদে মসজিদে একাধিক জামাত
সালাহউদ্দিন আহমেদ, নিউইয়র্ক (ইউএনএ): মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভ, মনের মধ্যকার পশুত্ত¡ দূর আর করোনামুক্ত পৃথিবী সহ সমগ্র বিশ্বের কল্যাণ, মুসলিম জাহানের সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি ও মুসলিম উম্মাহর ঐক্য কামনার মধ্য দিয়ে নিউইয়কসহ সমগ্র উত্তর আমেরিকায় শুক্রবার (৩১ জুলাই) নিউইয়র্ক সহ উত্তর আমেরিকার মুসলমানগণ পবিত্র ঈদুল আযহা পালিত হয়েছে। করোনাকালের বিশেষ পরিস্থিতি ও প্রেক্ষপটে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই মসজিদে মসজিদে ঈদের অধিকাংশ জামাত শেষ অনুষ্ঠিত বিশেষ মোনাজাতে এই কামনা করা হয়। এছাড়াও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে কোথাও কোথাও খোলা মাঠে এবং সড়কের উপরও ঈদের জামাত হয়েছে। তবে করোনা পরিস্থির কারনে অধিকাংশ মসজিদে একাধিক জামাত অনুষ্ঠিত হয় এবং এসব জামাতে সর্বস্তরের বিপুল সংখ্যক মুসল্লী অংশ নেন। তবে ঈদের দিন শুক্রবার সকালে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি থাকায় মুসল্লীদের নামাজ আদায়ে খানিকটা প্রতিকুল পরিবেশ মোকাবেলা করতে হয়। পবিত্র ঈদুল আযহা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব। ঈদুল আযহা উদযাপনের অন্যতম প্রধান কর্মকান্ড হচ্ছে ঈদের নামাজ আদায় করার পর সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে পশু কোরবানী। সেই লক্ষ্যে ছিলো নানা আয়োজন ও প্রস্তুতি। বিশেষ করে ঈদের নামাজ শেষে অনেকেই পশু কোরবানী দেন। আবার অনেকেই গ্রোসারী বা ফার্মের মাধ্যমে কোরবানী দেন। খবর ইউএনএ’র।
এদিকে ঈদুল আযহার নামাজে অংশগ্রহণকারী মসুল্লীরা রং বে রং এর নতুন জামা-কাপড় পড়ে ঈদের জামাতে অংশ নেয়ায় মসজিদগুলোতে ভীন্ন পরিবেশ ও আমেজ পরিলক্ষিত হয়। তাদের মাঝে ছিলো উৎসাহ-উদ্দীপনা আর ধর্মীয় ভাব-গম্ভীর পরিবেশ। তবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে মসল্লীরা ঈদেও দিনের চিরাচরিত একে অপরের সাথে ‘কোলাকুলি’ করা থেকে বিরত থাকলেও মুখে মুখে সালাম ও শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। অনেকেই প্রথম জামাত শেষে কাজে যোগ দিয়েছেন। আবার যাদের কাজ নেই তাদের অনেকে কোরবানী দিতে ফার্মে গেছেন। তবে ঈদ শেষে ফোনের মাধ্যমেই প্রবাস ও দেশ-বিদেশে ঘনিষ্টজন সহ বন্ধু-বান্ধবদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। এছাড়াও অনেকে ঘনিষ্টজন আর বন্ধু-বান্ধবদের বাসায় গিয়েও ঈদেও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
জেএমসি: নিউইয়র্কে বাংলাদেশীদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টার (জেএমসি)-এ এবার ঈদুল আযহার ৫টি জামাত অনুষ্ঠিত হয়। ঈদের দিন জেএমসি-তে সকাল সাড়ে ৬টায় প্রথম জামাত অনুষ্ঠিত হয়। এতে ইমামতি করেন জেএমসি’র খতিব ও ইমাম মওলানা মির্জাআবু জাফর বেগ। এছাড়াও জেএমসি-তে এক ঘন্টা বিরতিতে সকাল সাড়ে ৭টা, সাড়ে ৮টা, সাড়ে ৯টা এবং সকাল সাড়ে ১০টায় আরো ৪টি জামাত অনুষ্ঠিত হবে। এখানে দ্বিতীয় জামাতে ইমামতি করেন ইমাম শামসে আলী আর চতুর্থ জামাতে ইমামতি করেন হাফেজ রফিকুল ইসলাম। জেএমসি ভবন ছাড়াও মসজিদ সংলগ্ন ‘জেএমসি ওয়ে’তে খোলা রাস্তার উপরও মুসল্লীরা নামাজে অংশ নেন।
জেএমসি’র ঈদের জামাত চলাকালীন সময়ে নিউইয়র্ক ষ্টেট সিনেটর জন ল্যু ও স্টেট অ্যাসেম্বলীম্যান ডেভিড ওয়েপ্রিন মসজিদে উপস্থিত হয়ে মুসল্লীদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন এবং সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন।
জেএমসি পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারী মনজুর আহমেদ চৌধুরী ইউএনএ প্রতিনিধির সাথে আলাপকালে বলেন, করোনা পরিস্থিতি মেনেই জেএমসি-তে ঈদুল আযহার নামাজের আয়োজন করা হয়। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে ঈদুল ফিতরের সময়ের চেয়ে ঈদুল আযহায় একত্রে নামাজ আদায়ের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় তিনি মহান আল্লাহতায়ার কাছে শুকরিয়া আদায় কওে বলেন, সামাজিক দূরত্ব মেনে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। মুসল্লীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে মুখে মাস্ক, হাতে গেøাভস আর জায়নামাজ সাথে আনার উপর ছিলো বিশেষ অনুরোধ।
মসজিদ আল আরাফা: জ্যামাইকার মসজিদ আল আলাফা (আরাফা ইসলামিক সেন্টার)-এ পবিত্র ঈদুল আযহার ৫টি জামাত অনুষ্ঠিত হয় বলে জানা গেছে। মসজিদ সেন্টারেই প্রথম ঈদের জামাত হয় সকাল ৬টায়। এরপর সকাল ৭টা, ৮টা, ৯টা ও ১০টায় আরো ৪টি জামাত অনুষ্ঠিত হয়। করোনা পরিস্থিতির কারনে এবার এখানে মহিলাদের নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা ছিলো না। তবে পুরুষ নামাজীদের মধ্যে কে কোন জামাতে ঈদের নামাজ আদায় করবেন তার জন্য মসজিদ কমিটির কাছ থেকে সিরিয়াল নম্বর সংগ্রহ করতে হয় এবং জায়নামাজ সাথে নিয়ে সামাজিক দূরত্ব মেনে ঈদের নাজাজ আদায় করতে হয়।
মসজিদ মিশন: জ্যামাইকার ‘হাজী ক্যাম্প মসজিদ’ নামে পরিচিত মসজিদ মিশনে পবিত্র ঈদুল আযহার ৩টি জামাত অনুষ্ঠিত হয়। সকাল সাড়ে ৬টায় প্রথম জামাত ছাড়াও সকাল ৮টা ও ৯টায় আরো দু’টি জামাত অনুষ্ঠিত হয়। এখানে প্রথম জামাতে ইমামতি করেন মসজিদের ইমাম হাফেজ রফিকুল ইসলাম। দ্বিতীয় জামাতে ইমামমতি করেন মওলানা মঞ্জুরুল করীম। আর তৃতীয় জামাতে ইমামতি করেন হাফেজ তানভির। এই মসজিদে দ্বিতীয় নামাজের আগে নিউইয়র্কের ষ্টেট সিনেটর জন ল্যু উপস্থিত হয়ে মুসল্লীদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন এবং সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। এর আগে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি এম সাব্বির । মসজিদে মিশনের তিনটি জামাতেই উপস্থিত মুসল্লীদের মাঝে ফ্রি মাস্ক বিতরণ করা হয়।
দারুস সালাম মসজিদ: জ্যামাইকার দারুস সালাম মসজিদে ঈদুল আযহার ৬টি জামাত অনুষ্ঠিত হয় যথাক্রমে সকাল ৭টায়, পৌনে ৮টায়, সাড়ে ৮টায়, সোয়া ৯টায়, ১০টায় এবং সকাল পৌনে ১১টায়। এখানেও সামাজিক দূরত্ব মেনে মুসল্লীরা ঈদের নামাজ আদায় করেন।
আমেরিকান মুসলিম সেন্টার: জ্যামাইকার সার্টফিন বুলেভার্ডের আমেরিকান মুসলিম সেন্টার (এএমএস)- উদ্যোগে ঈদুল আজহার চারটি জামাত যথাক্রমে সকাল সাড়ে ৬টা, সাড়ে ৭টা, সাড়ে ৮টা ও সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হয়। সকাল সাড়ে ৮টার নামাজের বয়ান করেন এএমএস’র চেয়ারম্যান ও জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারের ইমাম মাওলানা আবু জাফর বেগ। নামাজ পরিচালনা করেন মদিনা মসজিদের সেক্রেটারী মাওলানা মোহাম্মদ জুলকীফিল। প্রতিটি জামাতে মুসল্লীদের সমাগম ছিল উল্লেখযোগ্য। ঈদের নামাজ শেষে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ সহ সমগ্র বিশ্বের কল্যাণ, মুসলিম জাহানের সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি ও মুসলিম উম্মাহর ঐক্য কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়।
আল আমীন জামে মসজিদ: এস্টোরিয়ার আল আমীন জামে মসজিদ এন্ড ইসলামিক সেন্টার-এ ঈদুল আযহার ৪টি জামাত অনুষ্ঠিত হয় যথাক্রমে সকাল ৭টা, ৮টা, ৯টা ও ১০টায়। করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য বিধি মেনেই মসজিদের ভিতরে নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা করা হয় বলে মসজিদ পরিচালনা কমিটির নেতৃবৃন্দ জানান।
বাংলাবাজার জামে মসজিদ: ব্রঙ্কসের বাংলাবাজার জামে মসজিদে সকাল ৭টায় ঈদুল আযহার প্রথম জামাত অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে আরো দুটি জামাত অনুষ্ঠিত হয় সকাল ৮টা ও ৯টায়। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি তথা প্রতিকূল পরিবেশ উপেক্ষা করে বিপুল সংখ্যক মুসল্লী এখানে জামাতে অংশ নেন।
বায়তুল জান্নাহ মুসলিম কমিউনিটি সেন্টার: ব্রæকলীনের বায়তুল জান্নাহ মুসলিম কমিউনিটি সেন্টারে ঈদুল আযহার ৬টি জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। সিদ্ধান্ত ছিলো আবহাওয়া ভালো থাকলে মসজিদের সামনে খোলা রাস্তার উপর একটি জামাত হওয়ার। কিন্তু বৃষ্টির কারনেই মসজিদ কর্তৃপক্ষ ৬টি জামাতের ব্যবস্থা করেন। সকাল সাড়ে ৬টায় প্রথম জামাত অনুষ্ঠিত হওয়ার পর পরবর্তীতে আধা ঘন্টা বিরতি দিয়ে বাকী আরো ৫টি জামাত অনুষ্ঠিত হয়।
এদিকে জ্যাকসন হাইটসের মোহাম্মদী সেন্টার ও নিউইয়র্ক ঈদগাহ’র পরিচালক ইমাম কাজী কায়্যূম জানান, করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কারণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে জামাতে নামাজের কাতার গঠন ইসলামী শরীয়তে সরাসরি নিষেধাজ্ঞার কারণে নিউইয়র্ক ঈদগাহ এবারও ফেসবুক লাইভস্ট্রিমে ঈদুল আযহার জামাতের ব্যবস্থা করা হয়। শুক্রবার সকাল ৯টায় মোহাম্মদী সেন্টার থেকে সরাসরি ফেসবুক লাইভে সম্প্রচারিত ঈদের জামাতে মুসল্লীরা অংশ নেন বলে তিনি জানান।
এছাড়াও জ্যামাইকার ইকনা, ব্রæকলীনের বাংলাদেশ মুসলিম সেন্টার, ওজনপার্কের বায়তুল আমান মসজিদ, জ্যাকসন হাইটসের জ্যাকসন হাইটস ইসলামিক সেন্টার, ব্রঙ্কসের পার্কচেষ্টার জামে মসজিদ সহ নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ড, জ্যামাইকা, জ্যাকসন হাইটস, এস্টোরিয়া, উডসাইড, ব্রঙ্কস, ব্রæকলীন, ওজনপার্ক প্রভৃতি এলাকার মসজিদে একাধিক ঈদুল আযহার জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে জানা গেছে।
অপরদিকে বাংলাদেশী অধ্যুষিত ওয়াশিংটন ডিসিসহ যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সী, কানেকটিকাট, ম্যারিল্যান্ড, পেনসেলভেনিয়া, ভার্জেনিয়া, ওয়াহিও, ফোরিডা, নর্থ ক্যারোরিনা, সাউথ ক্যারোলিনা, জর্জিয়া, মিশিগান, ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস, এরিজোনা সহ প্রভৃতি অঙ্গরাজ্যে প্রবাসী বাংলাদেশীরা ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে করোনাকালে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই পবিত্র ঈদুল আযহা পালন করেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।