আড্ডার সেকাল-একাল- মারুফ কামাল খান সোহেল
🚥 আড্ডার সেকাল-একাল 🚥★★★★★★★★★★★★★★
আমাদের দেশে একটা সময় ছিল দাওয়ায় বা রোয়াকে কিংবা বৈঠকখানায় বসে আড্ডা। ইন্ডিয়ার বাঙলাভাষী অঞ্চল পশ্চিমবঙ্গে রোয়াকে বসে আড্ডায় অভ্যস্তদের ‘র’কবাজ’ বলা হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে এই শব্দটির অপভ্রংশ চালু হয় ‘রংবাজ’ হিসেবে। মারকুটে ও বেপরোয়া ধাঁচের ছেলেদের রংবাজ বলাটা এতোটাই বহুল প্রচলিত হয় যে, রংবাজ নামে সিনেমা টিনেমাও তৈরি হয়ে যায়। অবশ্য আরও পরে মস্তান বা মাস্তান শব্দটি দিয়ে রংবাজ শব্দটি প্রতিস্থাপিত হয়। এখন রংবাজ কথাটি আর শুনিনে। মস্তানি বাড়লেও মাস্তান শব্দের ব্যবহারও কমে গিয়েছে ঢের।
সেকালে কিশোর-তরুণদের আড্ডা ছিল মূলতঃ খেলার মাঠকেন্দ্রিক। অভিজাতরা সামাজিক যোগাযোগ ও আড্ডার জন্য ক্লাব গড়তেন। সংবাদপত্র, পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকীগুলোর অফিস ও বিভিন্ন সোসাইটিতেও বিষয়ভিত্তিক আড্ডা বসতে দেখা যেতো। কালক্রমে খেলার মাঠগুলোই উঠে গেলো। ক্লাব কালচার পেশাগত ও বৈষয়িক যোগাযোগ এবং পানাহারের কেন্দ্রে সীমিত হয়ে পড়লো। পত্রিকার অফিসগুলো সংকীর্ণ ও ব্যস্ত হয়ে উঠলো।
পরে প্রায় সকল আড্ডাই স্থানান্তরিত হলো বিভিন্ন মানের চায়ের দোকান, ক্যাফে ও রেস্তোরাঁয়। নানান বিষয়ে তুমুল আড্ডায় বিতর্ক ও মতবিনিময় ছিল প্রধান। পরচর্চাও ছিল আড্ডার একটা প্রিয় প্রসঙ্গ।
আড্ডার সিরিয়াস আলাপচারিতাকে বলা হতো: ‘চায়ের কাপে ঝড়।’ কারণ ধুমায়িত চায়ের কাপ হাতেই জমে উঠতো এসব আড্ডা। আর আড্ডায় ব্যক্ত মতামত, উত্তেজনা ও তর্কাতর্কি সব কিছু আড্ডার মধ্যেই সীমিত থাকতো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। আড্ডার বিতর্কের কারণে শত্রুতা তৈরি বা আড্ডার মতামতের ভিত্তিতে উদ্যোগ গ্রহনের নজির খুব কম ছিল। আড্ডাটা মূলতঃ ছিল নির্দোষ সময় কাটানো এবং বিশুদ্ধ সামাজিক বিনোদনেরই একটা অংশ।
তবে এসব আড্ডার পুরোটাই অলসচর্চা ছিল না। এর কিছু কিছু ইতিবাচক প্রভাবও ছিল। সাহিত্য, রাজনীতি, দর্শনসহ বিভিন্ন বিষয়ে সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটেছে অনেক আড্ডাবাজি থেকেই। কখনো সমাজসেবামূলক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিভিন্ন উদ্যোগ ও গোষ্ঠীবদ্ধতাও গড়ে উঠেছে এসব আড্ডা থেকেই।
পুঁজির বিকাশ সমাজ ও সামাজিক সংষ্কৃতিকে পাল্টায়। পয়সার সাথে আভিজাত্য যোগের চেষ্টায় অনেকের জাঁকালো ও সুপরিসর নাগরিক ড্রইংরুম সাম্প্রতিককালে চর্ব্যচোষ্যলেহ্যপ্যেয় সহযোগে ফের আড্ডার ভেন্যু হয়ে উঠেছিল।
এখন সামাজিক নেটওয়ার্কগুলো এসব আড্ডার জায়গা অনেকখানি দখল করেছে। বিশেষ করে ফেসবুক সাম্প্রতিককালে ডিজিটাল আড্ডার একটা বড় মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। ফেসবুকে উঠছে “চায়ের কাপের ঝড়।” এই আড্ডার পরিধি অনেক বিস্তৃত। চেনা-অচেনা, দেখা-অদেখা, আসল-নকল, ভালো-মন্দ অনেকের এতে অংশ নেয়ার সুযোগ বিস্তর। কাজেই ঝুঁকিও এন্তার।
অতি সংক্রামক ঘাতক অতিমারী কোভিড-১৯ এর থাবা বিস্তৃত হবার পর এই আড্ডা গত কয়েক মাস ধরে অন্তর্জালেই সীমাবদ্ধ ও কায়েমি হয়েছে। আড্ডার এই ফর্ম নতুন হলেও বেশ সুবিধাজনক ও জনপ্রিয়ও হয়ে উঠছে।
আড্ডার এই ডিজিটাল রূপান্তরের ফল এবং এর সামাজিক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া কতোটা ভালো ও মন্দ তা হাতে-কলমে বুঝতে মনে হয় আরো কিছুটা সময় লাগবে।🔹
(একটু সংশোধিত আকারে একটি পুরনো পোস্ট)