মুক্তিযোদ্ধা জসিম এর গল্প-
ফজলে এলাহী : লেখার শুরুতেই প্রয়াত চিত্রনায়ক, প্রযোজক, ফাইট ডিরেক্টর জসিমকে জানাই জন্মদিনের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের এক কীর্তিমান পুরুষের নাম জসিম যিনি আমার মতো কোটি ভক্তের কাছে ‘’অ্যাকশন কিং’’ জসিম হিসেবে পরিচিত। আজ চলচ্চিত্রের বাহিরে জসিমের অন্য একটি পরিচয়ের কথা আপনাদের বলবো তার আগে খুব সংক্ষেপে চলচ্চিত্রের জসিম সম্পর্কে একটা ধারনা দেই। আমার সমসাময়িক ও অগ্রজ বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শকরা খুব ভালো করেই জানেন সিনেমার পর্দায় ও পর্দার আড়ালে জসিমের অবদান কোনদিন অস্বীকার করা যাবে না। বাংলা চলচ্চিত্রে অ্যাকশন ধাঁচের চলচ্চিত্রগুলোকে দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় করার পেছনে জসিমের অবদান চিরদিন সোনার অক্ষরে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে লিখা থাকবে। জসিম হলেন বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বপ্রথম ফাইট ডিরেক্টর যার হাত ধরে অনেকে চলচ্চিত্রে এসেছিলেন ।
জহিরুল হকের নির্মিত বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বপ্রথম অ্যাকশন ছবি ‘রংবাজ’ সিনেমার শুটিং দেখতে গিয়ে হয়ে গেলেন ইতিহাসের অংশ। রংবাজ চলচ্চিত্রে ছোট্ট একটি চরিত্র দিয়ে চলচ্চিত্রে আগমন এরপর জসিম মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ছিলেন তৎকালীন সময়ের অন্যতম সবচেয়ে সফল ও জনপ্রিয় চিত্রনায়ক, প্রযোজক। ৫০টির মতো চলচ্চিত্রে খলনায়ক হিসেবে জনপ্রিয় পাওয়ার পরেও নায়ক চরিত্রেও সফল হলেন এবং পরবর্তীতে ‘অ্যাকশন কিং’ নায়ক হিসেবেই দর্শকদের মনে চিরদিনের জন্য ঠাই করে নিয়েছিলেন। জসিম যখন কাঁদতো তখন মনে হতো পুরো সিনেমার পর্দাটা কাঁদছে ঠিক তেমনি জসিম হাসলে, চিৎকার করলে, রাগ করলে, হুংকার দিলে পুরো সিনেমার পর্দাটাই মনে হতো পাল্টে যেতো আর দর্শকরাও প্রতিক্রিয়া দেখাতো। মুক্তিযুদ্ধের মতো পরবর্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে জসিম রেখেছিলেন সাহসী ভূমিকা। জসিম ছিলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এক বিরল প্রতিভা। প্রযোজক, ফাইট ডিরেক্টর, অভিনেতা হিসেবেও জসিম সম্পুর্ন সফল একটি নাম । প্রতিবেশি দেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে জসিম এদেশে মাল্টিস্টার সামাজিক অ্যাকশন ধারার চলচ্চিত্রকে নিয়ে গিয়েছিলেন অন্য উচ্চতায়। জসিমের সিনেমা মানেই টানটান উত্তেজনা। খলনায়ক হিসেবে জসিম ছিলেন তাঁর সমসাময়িক অন্য খলনায়কদের তুলনায় অনেক অনেক স্মার্ট ও স্টাইলিশ খলনায়ক। নায়ক হিসেবে দর্শকদের কাছে ভালোবাসা পেয়েছিলেন অ্যাকশন কিং হিসেবে।
যাইহোক এবার মুল প্রসঙ্গে আসি । ছবিতে যে পত্রিকার অংশটি দেখতে পাচ্ছেন তা হলো ১৯৯৮ সালে জসিমের মৃত্যুর পর ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবু কায়সারের লিখা জসিমকে নিয়ে একটি বিশেষ স্মৃতিচারণমুলক প্রতিবেদন যিনি ছিলেন ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধা জসীমেরই একজন সহযোদ্ধা।
আবু কায়সার যা বলেছেন তার সার সংক্ষেপ হলো – অভিনেতা জসিম যে একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তা তিনি কোথাও জাহির করতেন না। মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন জসিম ছিলেন কলেজ ছাত্র। জসিমের বাসা ছিল আগামসি লেন মসজিদ ও খন্দকার মোশ্তাকের বাসার খুব কাছাকাছি যেখান থেকে জসিম পালিয়ে গিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন।জসিমের বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার যিনি দখলদার পাকিস্থানি সৈন্যদের অনেক গোপন তথ্য জসিম ও তার সহযোদ্ধাদের কাছে সরবরাহ করে সহযোগিতা করেছিলেন। জসিমের সাথে লেখকের প্রথম পরিচয় ঘটে ১৯৭১ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ডেমরা থানার বাইগাদিয়া গ্রামে আলী মাতবরের বাড়ীতে। চারদিকে বর্ষার পানি থৈ থৈ করা প্লাবিত ঐ এলাকায় আফসর উদ্দিন মাতবরের বাড়ীতে মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নিয়েছিল এবং যেখান থেকেই তাঁরা পরবর্তীতে বিভিন্ন অপারেশনের পরিকল্পনা ও পরিচালনা করতেন। লেখক আবু কায়সার ছিলেন কমান্ডার ইব্রাহীমের গ্রুপে যেখানে আগস্ট মাসে জসিম, আমান [ জসিমের বন্ধু ও প্রযোজক মীর এনামুল করিম আমান ], চেঙ্গিস, সালেক ,মিজান প্রমুখও। সেপ্টেম্বর মাসের ১ম সপ্তাহের শুক্রবারে ঢাকার বাসাবোর কদমতলায় আর্মি ক্যাম্পে দিনে দুপুরে অতর্কিত হামলা চালিয়ে পাকসেনাদের হত্যা করে তাদের অস্র নিয়ে উল্লাস করতে করতে বিজয়ের বেশে নিজেদের আস্তানায় ফিরে আসেন জসিম ও তাঁর সহযোদ্ধারা। এভাবে একাধিক সফল অপারেশনে জসিম সাহসিকতা ও দক্ষতার সাথে ভূমিকা রেখেছিলেন।জসিম , আমান চেঙ্গিসদের বীরত্বে ধীরে ধীরে মুক্তিবাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করে বিভিন্ন এলাকা নিজেদের দখলে নেয়ার চেষ্টা করেছিল।
একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা জসিম পরবর্তীতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এক সাহসী যোদ্ধা হিসেবে বাকিটা জীবন কাজ করে গেছেন। জসিম যে সত্যি সত্যি সাহসী ও অন্যায়ের প্রতিবাদি ছিলেন সেটা পর্দায় তাঁর অসংখ্য ছবিতে প্রমাণ পাওয়া যায়। জসিম তাঁর বন্ধু ও সহযোদ্ধা আমান, মাহবুব খানদের নিয়ে জ্যাম্বস ফাইটিং গ্রুপ গড়ে তুলেন যারা সেই মান্ধাতার আমলের প্রযুক্তিকে জয় করে দারুন সব অ্যাকশন দৃশ্য পর্দায় শুধু যুক্ত করেননি পরবর্তীতে দোস্ত দুশমন, বারুদ, আসামি হাজির, কুরবানি,ধর্ম আমার মা, ভাইজান, মাস্তান রাজা, কালিয়া, বাংলার নায়ক সহ অসংখ্য ব্যবসা সফল সুপারহিট অ্যাকশন ছবি নির্মাণ করে সফল প্রোডাকশন হাউস হিসেবেও পরিচিতি লাভ করে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে আজ জসিমের মতো একজন মুক্তিযোদ্ধার বড় অভাব যিনি আমাদের চলচ্চিত্রের দুর্যোগের এই দিনে আশার আলো দেখাবেন।।
পত্রিকার ছবি সংগ্রহ ও কৃতজ্ঞতায়ঃ সাঈদুর রহিম বাপ্পী ভাইকে (অভিনেতা জসিমের ভাতিজা।।