রঙ্গভরা বঙ্গদেশে সুবিধাবাদের সেকাল একাল
মারুফ কামাল খান সোহেল : কেউ যদি বাংলাদেশের এখনকার খবরের কাগজগুলো পড়েন বা টিভি চ্যানেলগুলো দেখেন তাহলে তার মনে হবে এটা এক দল, এক মত, এক নেতার দেশ। এ দেশের মানুষের আর কোনো মত নাই। মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগই এ দেশের একমাত্র ত্রাণকর্তা। আর যত দল আছে তাদের প্রায় সবাই দেশদ্রোহী, বেঈমান ও স্বাধীনতাবিরোধী। মুজিব ও লীগ যখন যা-কিছুই করেছে তার সবই সঠিক। তাদের কোনো ভুল নাই, অন্যায় নাই, ব্যর্থতা নাই। তারা গণতন্ত্র হরণ করে একদল করলে, সংবাদপত্র-কোর্ট-নাগরিক স্বাধীনতা কেড়ে নিলে, বিনাভোটে রাষ্ট্রপতি হয়ে সেটাকে ‘যেন তিনি নির্বাচিত’ বলে ঘোষনা করলেও কোনো দোষ হয়না। তারা বিনা বিচারে অন্যমতের হাজার হাজার মানুষ মেরে ফেললেও সেটা হয় জাতীয় স্বার্থের কাজ। তাদের আমলে দুর্ভিক্ষে লাখো মানুষ অনাহারে মারা গেলে, অবাধ দুর্নীতি-লুটপাটে জাতীয় অর্থনীতি ও শিল্পকারখানা সব ধ্বংস হয়ে গেলে, চোরাচালান-মজুতদারিতে দেশ ছেয়ে গেলে এবং সন্ত্রাস-নৈরাজ্যে মানুষের নিরাপত্তা ভয়াবহভাবে বিপন্ন হলেও এর কোনোকিছুর দায় তাদের নয়, সব অন্যদের ষড়যন্ত্রের ফল।
মানুষ কি এসব প্রচারণা বিশ্বাস করে? এসব একতরফা প্রচারে কি সত্য চাপা দেয়া যায়? ব্যর্থতা ঢাকা যায়? নিজেদেরকে গ্রহনযোগ্য করা যায়? জনসমর্থন ধরে রাখা যায়? মানুষকে সব সময় বোকা বানিয়ে রাখা যায়? যায়না। তবুও যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেনা, যারা মতসহিষ্ণু নয়, যারা কেবল মিথ্যা-চক্রান্ত-অপকৌশলে প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমিয়ে মেরেকেটে ক্ষমতায় থাকায় বিশ্বাসী তারা সে চেষ্টা বারবার করে। ইতিহাস থেকে, করুণ পরিণতির অতীত থেকে শিক্ষা নেয়না।
১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তনের আগে থেকেই সংবাদমাধ্যমকে ধীরে ধীরে একমুখী করে ফেলা হয় নিবর্তনমূলক আইনি-বেআইনি বিভিন্ন পন্থায়। বাকশাল হবার পর তো চারটি সরকারি প্রচারপত্র ছাড়া আর কোনো পত্রিকাই ছিল না। তখন মিডিয়ায় এখনকার মতই ‘কানু ছাড়া আর কোনো গীত’ ছিল না। চলছিল কে কত বেশি মুজিববাদী তা প্রমাণের প্রাণপণ চেষ্টা। সংবাদ ও ভাষ্যের নামে স্তব-স্তুতি আর তোষামোদ ছাড়া আর কিছুই প্রচার হতো না। ভিন্নমত ছিল হারাম, বৈরি সংবাদ ছিল নিষিদ্ধ।
বাকশালের ভিন্নমতাবলম্বী প্রভাবশালী নেতা খন্দকার মুশতাক আহমাদ ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একটি অংশের সাহায্যে শেখ মুজিব ও তার প্রতিপত্তিশালী নিকটাত্মীয়দের সপরিবারে মেরে ক্ষমতা দখলে নেন।
সাথে সাথে বদলে যায় পুরো দৃশ্যপট। সিঁড়িতে লাশ পড়ে থাকা অবস্থায় মুজিব মন্ত্রিসভার প্রায় সব সদস্য মুশতাক মন্ত্রিসভার মন্ত্রীরূপে শপথ নেন। সংসদের স্পিকার আব্দুল মালেক উকিল তার নিহত নেতার সকরুণ পরিণতিকে ‘ফেরাউনের পতন’ বলে উল্লেখ করেন। সশস্ত্রবাহিনী সমূহ, রক্ষীবাহিনী, সীমান্তপ্রহরী বিডিআর, আনসার ও পুলিস সহ সব বাহিনীর মুজিবনিযুক্ত প্রধানরা সেই রক্তক্ষয়ী পটপরিবর্তনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে খন্দকার মুশতাকের কর্তৃত্বের প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্য প্রকাশ করেন। আর রাতারাতি পাল্টে যায় সংবাদমাধ্যমের প্রচারের ধরণ ও ভাষা।
১৬ আগস্ট ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক বাংলা, দৈনিক ইত্তেফাক, বাংলাদেশ অবজারভার, বাংলাদেশ টাইমস এই চারটি পত্রিকার সব কটিতেই ১৫ আগস্ট খন্দকার মুশতাকের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে ফলাও করে খবর ছাপা হয়। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হবার ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে সেদিন কেউ সংবাদ পরিবেশন করেনি।
শেখ মুজিবুর রহমানের নামের সঙ্গে জাতির জনক, বঙ্গবন্ধু ইত্যাকার নানা খেতাব, বিশেষণ ও ভূষণ যুক্ত করে সংবাদ ও ভাষ্য প্রচারের প্রতিযোগিতামূলক রীতি ও রেওয়াজ চালু ছিল। কিন্তু মাত্র একদিনের ব্যবধানে এ-সবের সবকিছু বর্জন করে ১৬ আগস্ট দৈনিক বাংলার শিরোনাম ছিল ‘শেখ মুজিব নিহত, সামরিক আইন ও সান্ধ্য আইন জারি।’ সশস্ত্রবাহিনীসমূহের আনুগত্য প্রকাশ এবং একই সঙ্গে জাতির উদ্দেশে নয়া রাষ্ট্রপতি মুশতাকের ভাষণকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ ছাপা হয়। বিভিন্ন স্তরের জনসাধারণের অভিনন্দন জ্ঞাপনের সংবাদে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বাংলাদেশ গণকর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ, জাতীয় হকার্স লীগের সমর্থনের কথা প্রকাশিত হয়। প্রচারিত হয় পরিবর্তনের ঘটনায় আনন্দিত হয়ে বাকশাল সংসদ সদস্যদের অনেকের সরকারকে অভিনন্দন জানাবার খবর।
১৬ আগস্ট প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার খবরে নয়া সরকারের মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের নাম প্রকাশ করা হয়। এদের মধ্যে পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, ফণীভূষণ মজুমদার, সোহরাব হোসেন, আবদুল মান্নান, মনোরঞ্জন ধর, আব্দুল মোমিন, আসাদুজ্জামান খান প্রমুখ এবং প্রতিমন্ত্রী রূপে শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন, দেওয়ান ফরিদ গাজী, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, কে এম ওবায়দুর রহমান, ড. আজিজুর রহমান মল্লিক, ড. মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী প্রমুখ দায়িত্ব গ্রহন করেন।
সংবাদপত্রের খবরে বলা হয়, খন্দকার মুশতাকের নেতৃত্বে নবগঠিত সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাবার ঘোষণা দিয়েছে। নয়া সরকারকে স্বাগত জানিয়ে গণচীন, সাউদি আরব ও পাকিস্তানের স্বীকৃতি দানের সিদ্ধান্তের কথাও সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়। নতুন সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ও সাফল্য কামনা করে বিভিন্ন মসজিদে বিশেষ মোনাজাত ও অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনার সংবাদও প্রচার করা হয়। নয়া রাষ্ট্রপতি খন্দকার মুশতাকের জোটনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণের অঙ্গীকার এবং ‘দুর্নীতির সঙ্গে আপোস নয়’-এ ঘোষণাও খুব গুরুত্ব দিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা হয়।
সে-সময় সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ, বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খোন্দকার, নৌবাহিনীর প্রধান কমোডর মোশাররফ হোসেন খান, বিডিআর প্রধান ব্রিগেডিয়ার খলিলুর রহমান, পুলিশের আইজি এওএইচএম নুরুল ইসলাম। তাঁরা প্রত্যেকেই রেডিওতে ভাষণ দিয়ে মুশতাক সরকারের প্রতি তাদের নিজ নিজ বাহিনীর পক্ষ থেকে আনুগত্য প্রকাশ করেন। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত জনসাধারণকে ঘরের ভেতর থাকার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। নতুন সরকারের সঙ্গে সকল দেশপ্রেমিক ও শান্তিপ্রিয় নাগরিককে সহযোগিতা করার অনুরোধ জানানো হয়। সেই আহ্বান সংবাদপত্রগুলোতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বক্স করে প্রচার করা হয়। তাতে লেখা হয় : ‘দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সর্বতোভাবে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করুন।’
কেবল অনুকূল সংবাদ প্রকাশই নয়, ১৬ আগস্ট থেকেই পত্রিকাগুলো মুশতাক সরকারের পক্ষে সম্পাদকীয় প্রকাশ করতে থাকে। দৈনিক বাংলা’র সম্পাদকীয় ছিল- ‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ’। তাতে লেখা হয়-‘জাতীয় জীবনে একটি ঐতিহাসিক ক্রান্তির সূচনা হয়েছে। জাতীয় জীবনে সূচিত এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপকে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দিয়েছেন জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা।’ দেশের সর্বত্রই স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে জানিয়ে সম্পাদকীয় নিবন্ধে প্রশংসা করা হয় সশস্ত্রবাহিনীর। বলা হয়, তারা পবিত্র দায়িত্ব পালন করেছে। জাতির সামনে তারা খুলে দিয়েছে সম্ভাবনার স্বর্ণতোরণ, উন্মোচন করেছেন সমৃদ্ধির নবদিগন্ত। সেদিন শনিবারে দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় ছিল ‘ঐতিহাসিক নবযাত্রা’। এই দৈনিকটি খন্দকার মুশতাকের ক্ষমতা গ্রহণের ঘটনাকে দেশ ও জাতির এক ঐতিহাসিক প্রয়োজন পূরণের নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত করে। বাকশালী শাসনামল সম্পর্কে ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়- ‘সে-সময় দেশবাসী বাস্তবক্ষেত্রে যাহা লাভ করিয়াছে তাহাকে এক কথায় গভীর হতাশা ও বঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।’ রাষ্ট্রপতি হিসেবে খন্দকার মুশতাকের ভাষণের সঙ্গে সুরে সুর মিলিয়ে ইত্তেফাকে লেখা হয়- ‘গণমানুষের ভাগ্যোন্নয়নের পরিবর্তে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির আশ্রয়গ্রহণ করিয়া এবং একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাখিবার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষায় মাতিয়া উঠিয়া স্বাধীনতার সুফল হইতে জনগণকে নির্মমভাবে বঞ্চিত করা হইয়াছে।’ নতুন সরকারের সংকল্পকে পবিত্র বলে উল্লেখ করে এর সাফল্য ও জয় কামনা করে পত্রিকাটি।
১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি হিসাবে জাতির উদ্দেশে দেয়া বেতার ভাষণে খন্দকার মুশতাক বলেন, বিগত দীর্ঘকাল দেশের ভাগ্য উন্নয়নের কোনো চেষ্টা না করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা এবং সেই ক্ষমতাকে স্থায়ীভাবে আঁকড়ে রাখার ষড়যন্ত্রের জাল রচনা করা হয়েছিল।
১৬ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠায় সেই ভাষণ ও সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী মিলিয়ে প্রধান সংবাদশিরোনাম ছিল -‘দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি উচ্ছেদ। সুবিচার ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ঘোষণা। খন্দকার মুশতাকের নেতৃত্বে সশস্ত্রবাহিনীর শাসন ক্ষমতা গ্রহন’।
ইত্তেফাকের রিপোর্টে বলা হয় – ‘সশস্ত্রবাহিনী জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষমতা গ্রহণ করেছে।’
একই দিনের পত্র-পত্রিকায় খবর ছাপা হয় যে, লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশন ভবনে প্রবাসী বাংলাদেশীরা বিক্ষোভ করেছে এবং তারা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নামিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছে।
১৭ আগস্ট সব সংবাদপত্রে রাষ্ট্রপতি মুশতাকের জীবনালেখ্য এবং সৌদি আরব ও সুদানের স্বীকৃতির সংবাদ প্রকাশ করা হয়। সেই জীবনীতে পাকিস্তানী শাসনামলে রাজনীতিতে ও মুক্তিযুদ্ধে মুশতাকের অবদান এবং আওয়ামী লীগে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার সবিস্তার বর্ণনা দেয়া হয়। সেদিনের সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ থেকে আরো জানা যায় যে, ভারতীয় মুখপাত্র মুজিব হত্যাকান্ডকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে অভিহিত করেছেন। কারফিউ ধীরে ধীরে শিথিল করা এবং মন্ত্রিসভার বৈঠকে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি সন্তোষজনক বলে আলোচিত হবার কথাও জানানো হয়।
নিহত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের মরদেহ দাফন করা হয় টুঙ্গিপাড়ায়। কিন্তু কোনো পত্রিকাই এই সংবাদটিকে গুরুত্ব দিয়ে ছাপায়নি। বরঞ্চ তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয় নতুন সরকারের প্রতি মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিকদের পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপনের খবর। ১৮ আগস্ট আওয়ামী লীগের এক সময়কার সভাপতি মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ অভিনন্দন জানান নতুন সরকারের প্রতি।
দুর্নীতির সঙ্গে আপস না করার ঘোষণা দেয়ায় খন্দকার মুশতাকের প্রশংসা করে দৈনিক বাংলার সম্পাদকীয়তে তার বৈদেশিক নীতিকেও ‘বলিষ্ঠ ও বিচক্ষণ’ বলে সাধুবাদ জানানো হয়। ইত্তেফাকও ‘সবার প্রতি বন্ধুত্ব’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। এ পত্রিকায় পরদিন সম্পাদকীয় ছিল ‘স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা এবং সৌদি আরবের স্বীকৃতি।’ ১৮ আগস্ট তারিখে দৈনিক বাংলা ‘মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা’ শিরোনামে মুশতাকের ভাষণকে অবলম্বন করে আরেকটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।
১৮ ও ১৯ আগস্টের সংবাদপত্রে বহির্বিশ্বের স্বীকৃতি ও নিরবচ্ছিন্ন জীবনযাত্রার খবরকে গুরুত্ব দেয়া হয়। ১৯ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ছিল, ব্রিটেনের সানডে টাইমস পত্রিকায় এন্টনি ম্যাসকারেনহেস-এর রিপোর্ট অনুসারে শেখ মুজিব সরকারের পতনের তিনটি কারণ। এগুলো হলো- সামরিক বাহিনীর প্রতি মুজিবের অবিশ্বাস, ইসলামের অবনয়ন এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া।
২১ আগস্ট রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করার খবর প্রকাশিত হয়। সংবিধানের আংশিক সংশোধনের পরেও পার্লামেন্ট অব্যাহত থাকে; রাষ্ট্রীয় মূলনীতি অপরিবর্তিত রাখা হয়। রাষ্ট্রপতির ৯নং আদেশ বাতিল করা হয়। এর আগেই নতুন সরকার মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্রের মারফতে প্রতিশ্রুতি পায় ব্যাপক মার্কিন সাহায্য অব্যাহত থাকবে বলে। খাদ্যশস্য নিয়ে ১৯টি জাহাজ বন্দরে ভিড়ে।
২৪ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাকের খবরে বলা হয়, দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ ২৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামানসহ সিনিয়র নেতারা ছিলেন। একই তারিখের পত্রিকা থেকে জানা যায়, রাষ্ট্রপতির নির্দেশে সামরিক আইন বিধি অনুসারে সামরিক আদালত গঠনের ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। বলা হয়- ‘বেআইনী অস্ত্র রাখা, অবৈধ সম্পত্তি অর্জন ও দুর্নীতির সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ড।’
২৫ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে সংবাদত্র থেকে জানা যায়, সেনাবাহিনী প্রধান পদে জিয়াউর রহমান নিয়োগ পেয়েছেন। ব্রিগেডিয়ার খলিলুর রহমানকে পদোন্নতি দিয়ে জিয়াউর রহমানের উপরে নতুন চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ (সিডিএস) পদ তৈরি করে তাকে সে পদে বসানো হয়। যদিও জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধ করার কারণে খলিলের সিনিয়র হয়েছিলেন। একই সঙ্গে ভারতে প্রশিক্ষণরত এইচ এম এরশাদকে পদোন্নতি দিয়ে আর্মির ডেপুটি চিফ করা হয়। এদিকে শক্তিশালী সশস্ত্রবাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে স্বাধীনভাবে কাজ করার শর্তে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল এম. এ. জি ওসমানী রাষ্ট্রপতি মুশতাকের অবৈতনিক প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করেছিলেন।
ব্রিটিশ পত্রিকা ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এ ১৬ আগস্ট এক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বাংলাদেশের সংবাদপত্রে বলা হয় – দারিদ্র্য, হিংসাদ্বেষ, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি প্রভৃতি গুরুতর সমস্যার সমাধানে ব্যর্থতার জন্য সাবেক প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই বহুল পরিমাণে দায়ী।
৩০ আগস্ট দি টেলিগ্রাফের বরাত দিয়ে শেখ মুজিবের বাকশাল সতকারের পতন সম্পর্কে বলা হয়- মুজিব শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে বিগড়ে দিয়েছিলেন; যারা তাঁকে এক সময় নেতা বানিয়েছিল।
তালিকা আর দীর্ঘ না করে এখনকার সংবাদমাধ্যমের একতরফা ও একমুখী প্রচারণার প্রতি আবারো সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করবো। এখন আবার কে কত বেশি মুজিববাদী তা প্রমাণের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। নিজেকে একমাত্র ছহি ও অন্য সকলকে ভুয়া মুজিববাদী প্রমাণের এই সুবিধাবাদী প্রতিযোগিতা ১৯৭৫ সালের বাকশাল-পর্বেও প্রবলভাবে শুরু হয়েছিল। পরে গণেশ উল্টে যাবার সাথে সাথেই দেখা গেছে রাতারাতি আনুগত্য বদলের প্রতিযোগিতা। তখন
দায় এড়াতে অনেককে বলতে শুনেছি : ‘ক্ষমতায় থাকতে আমার কথা শুনতো না কেউ।’ বেঁচে থাকলে ভবিষ্যতে হয়তো আবারো শুনতে হতে পারে এই দায় এড়ানো কোটেশন। আসলে অতি বাড়াবাড়ি, অতি ভক্তি, অতি তোষণ, অতি বিদ্বেষ, অতি বিরোধিতা এবং অতি একমুখিনতার ফল কখনো দিনান্তে শুভ হয় না। তবুও আমাদের রঙ্গভরা বড় বিচিত্র এ বঙ্গদেশে বিচিত্র সুবিধাবাদ বারবার ফিরে ফিরে আসে নানা রঙে, নানা রূপে, নানান বেশে।