আবার বিয়ে!
ফারজানা হুসাইন: গত দুদিন থেকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম আর বিশেষ করে অনলাইন পোর্টালগুলোতে বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী শমী কায়সারের বিয়ের খবর প্রচার হচ্ছে। হ্যাঁ, শমী কায়সার বিয়ে করেছেন সম্প্রতি। সংবাদপত্রের মাধ্যমেই জানলাম, করোনাকালীন পৃথিবীতে বেশ ঘরোয়াভাবে, কেবল পরিবার আর নিকট আত্মীয়দের উপস্থিতিতে অভিনেত্রীর বাড়িতেই এই বিয়ের আয়োজন করা হয়। সংবাদের সঙ্গে শমী এবং তার স্বামীর বিয়ের ছবিও প্রকাশিত হয়েছে। লাল শাড়িতে বেশ টুকটুকে বউ লাগছে শমীকে। শহীদুল্লাহ কায়সার আর পান্না কায়সারের মতো বহুল পরিচিত বাবা-মায়ের সন্তান শমী, তবে তিনি তার নিজের কাজের মাধ্যমেই স্বনামধন্য। নব্বই দশকের এই জনপ্রিয় অভিনেত্রী যদিও এখন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। তিনি বিয়েও করেছেন একজন ব্যবসায়ীকেই। দু’জনের কাজের সূত্রে পরিচয় এবং প্রণয়, এখন সেই প্রণয় গড়ালো পরিণয়ে।
দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক, শিক্ষিত, স্বাবলম্বী মানুষ সামাজিক নিয়ম মেনে বিয়ে করে একসঙ্গে পথচলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা। নবদম্পতিকে তাদের নতুন জীবনের জন্য শুভেচ্ছা জানানো ছাড়া এই পুরো ঘটনায় আর কোনও কথা বলার তো কিছু নেই। কিন্তু, ফেসবুকজুড়ে আলোচনার বিষয়, বিভিন্ন অনলাইন সংবাদপত্রের শিরোনাম হলো, ‘আবারও বিয়ে করলেন শমী’, ‘তৃতীয়বার বিয়ে করলেন শমী’। শুধু তাই নয়, শমীর পূর্ববর্তী বিয়েগুলো কাদের সঙ্গে হয়েছিল তাদের নাম, পরিচয়, নাগরিকত্ব এবং সেই বিয়ে কবে শুরু হয়ে কবে শেষ হলো তার সময়সীমা—সবই এখন সংবাদ!
এই সংবাদ পড়ে লজ্জিতবোধ করি, সেই সঙ্গে অবাকও হই। আর তখনই মনে পড়ে আমরা তো সেই জেনারেশন যারা শাহরুখ খানের রোমান্স দেখে বড় হয়েছি। ‘কুচ কুচ হোতা হে’ সিনেমার সেই সংলাপ—‘হাম একবার জিতে হে, একবার মারতে হে, শাদি ভি একবার হোতি হে, অর পেয়ার ভি!’
রুপালি পর্দায় রোমান্টিক হিরোর গলা কাঁপিয়ে বলা একবার বাঁচা, একবার মরা, একবার বিয়ে আর একবারই প্রেমের প্রতিজ্ঞা যদিও শেষ হয় কলেজ জীবনের বন্ধুর সঙ্গে অনেক বছর পর দেখা হওয়া, নায়কের আবারও প্রেমে পড়া আর বিয়েতে। তবু আমরা সিনেমা শেষ করে বিড়বিড় করি—‘হাম একবার জিতে হে…!’
আর এই রকমের কিছু বাস্তব-বর্জিত সিনেমা, গল্প, উপন্যাস থেকেই আমাদের মানসিকতা আরও সংকীর্ণ হয়। আমরা রঙিন চশমায় জীবনকে দেখি, বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাই যাকে তাকে, ব্যবচ্ছেদ করি কারও ব্যক্তিগত জীবন আর পছন্দকে।
দেশের কোনও আইনেই বলে দেওয়া নেই একজন মানুষ জীবনে কয়টা বিয়ে করতে পারবেন। ডিভোর্স রীতিমতো সমাজ, আইন আর ধর্মসিদ্ধ। তবু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ফ্রি প্ল্যাটফর্ম পেয়ে আমরা একেকজন হয়ে উঠি মোরাল পুলিশ। আর আসামি যদি হয় একজন নারী, তার ওপর সেই নারী যদি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী এবং স্বাবলম্বী, তবে তো কথাই নেই। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ওই নারীর ওপর সরাসরি না পেরে, ভার্চুয়ালি চড়াও হয় নিজেদের অপারগতা ঢাকতে। যেমনটা হচ্ছে শমী কায়সারের বেলায়।
আমরা আদতেই একেকজন মহাভারতের অর্জুন! আমরা দক্ষ তীরন্দাজ হয়ে দ্রৌপদীকে জয় করতে শিখি, বুঝতে শিখি না। আমরা আমাদের ইচ্ছেমতো দ্রৌপদীকে চার ভাইয়ের সঙ্গে ভাগবাটোয়ারা করি, তাতে লজ্জায় মাথা কাটা যায় না বরং আমাদের জয়জয়কার হয়। নারী কখনও আমাদের প্রেমিকা, কখনও আমাদের সম্পত্তি, কিন্তু আমরা নারীকে আমাদের সমান ভাবতে পারি না। এ সমাজে নারীর নিজের পছন্দ থাকতে নেই, নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার, জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার যেন কোনও অধিকার নেই।
মানুষ তো কেবল শরীর সর্বস্ব প্রাণী নয়। কেবল আহার, নিদ্রা ছাড়াও আরও জৈবিক আচরণেই মানুষকে কী সংজ্ঞায়িত করা যায়? যায় না। মানুষ আমরা, কারণ আমাদের মন আছে, মানবিকতা আছে। আমরা জীবন চলার পথে সঙ্গীর প্রয়োজন বোধ করি তা কেবল জৈবিক চাহিদার জন্য নয়। আমরা আমাদের সঙ্গীকে চাই আশ্বাসে, আশায়, ভাষায়, ভালোবাসায়। আমরা এক কাপ চায়ে তাই ‘তোমাকে চাই’, তর্কে-বিতর্কে তুমুল ঝগড়ায় সেই ‘তোমাকেই চাই’! আমরা আমাদের ‘সেই তোমাকে’ বলি, প্লিজ ঘুম হয়ে যাও চোখে, আমার মন খারাপের রাতে।
সম্পর্ক গড়া এবং ভাঙা দুটোই স্বাভাবিক ঘটনা। অভিনয় শিল্পী শমী কায়সার এর আগে দুজন মানুষকে পছন্দ করেছেন, ভালোলাগা-ভালোবাসা থেকে বিয়ে পর্যন্ত গড়িয়েছে সেই সম্পর্কগুলো। কিন্তু কোনও কারণে মতের মিল হয়নি, সেই মতানৈক্য থেকে হয়েছে বিচ্ছেদ। একটা সম্পর্ক মানে কেবল কোনোরকম করে টেনে নিয়ে যাওয়া নয়, সেই সম্পর্কে বন্ধুত্ব থাকতে হয়, ভালোবাসা থাকতে হয়, বোঝাপড়া থাকতে হয়, আর থাকতে হয় বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা। মানুষ নিজে বদলায়, সম্পর্কও বদলায় তার রূপ। আজ যা কিছু পরম মমতায় আর বিশ্বাসে আমরা আঁকড়ে ধরে রাখি, কাল সেই মমতা আর বিশ্বাসে চিড় ধরতেই পারে। জীবনের বদলে যাওয়া রূপ আমাদের চিন্তাকে বদলে দেয়, আমাদের নিত্যদিনের পছন্দ, অপছন্দ আর প্রয়োজনীয়তাও বদলায় এর সঙ্গে। তাই মতের অমিল, পছন্দের অমিল, জীবনবোধের পার্থক্য প্রকট হয়ে উঠলে তখন কেবল বিয়েকে টিকিয়ে রাখতে জীবনকেই নরক বানিয়ে ফেলা কতটুকু যৌক্তিক? জীবন তো একটাই, এই জীবন যাপনের জন্য, জীবনকে প্রতি মুহূর্তে উদযাপন করতে হয়। জীবনকে বোঝা বানিয়ে কেবল ঘাড়ে করে বয়ে বেড়ানোতে কোনও গরিমা নেই, বরং জীবন সেখানে পরাজিত হয়। যে সমাজ আর লোকাচার জীবনকে গলা টিপে হত্যা করে কেবল ঠুনকো সামাজিক আচারকে প্রাধান্য দিতে, সেই সমাজকে বদলাতে হয় এক সময়। কেবল সমাজের চোখে বিয়ে টিকিয়ে রাখার নামে দুজন অসুখী মানুষ একসঙ্গে থাকার চেয়ে দুজন মানুষ আলাদা আলাদাভাবে সুখী হওয়ার চেষ্টা করাই শ্রেয়। আমাদের সমাজে আমাদেরই আশেপাশে কত কত বন্ধু, আত্মীয়, পরিচিতজন আছে যারা লোকে কী বলবে এই শঙ্কায় অসুখী বৈবাহিক জীবন যাপন করে চলেছে দিনের পর দিন। সেই অসুখী দাম্পত্যের প্রভাব পড়ছে তাদের সন্তানদের ওপর। কিন্তু তবু সামাজিকতা রক্ষার নামে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করা প্রতিটা ক্লান্তিময় দিন যেন নরকের যন্ত্রণা এই পৃথিবীতেই।
এদিক থেকে শমী কায়সার তো বাহবা পাওয়ার যোগ্য। দেশবরেণ্য বাবা-মায়ের সন্তান তিনি, শমী নিজে একজন পাবলিক ফিগার—তার জীবন, তার প্রেম, ভালোবাসা, বিয়ে তো জনগণের আলোচ্য বিষয় প্রায় তিন দশক ধরে। শমীর প্রেম ভেঙেছে, সংসার ভেঙেছে, আর তা নিয়ে লোকের কটূকথা তো তিনি আগেও কম শোনেননি। তবু তিনি সাহস দেখিয়েছেন, বোঝাপড়ায় গলতিকে তিনি মুখ বুজে সহ্য করেননি, তিনি আরেকবার জীবনকে সুযোগ দিয়েছেন, আবারও স্বপ্ন দেখেছেন, ঘর বেঁধেছেন।
কবি হেলাল হাফিজ যেন শমীকেই বলেছেন,
‘কোনদিন, আচমকা একদিন
ভালোবাসা এসে যদি হুট করে বলে বসে,
“চলো”, যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যাই,
যাবে?’
পাছে লোকে কিছু বলে সেই ভয়ে সুখী হওয়ার সুযোগকে হাতছাড়া করেননি, বরং লোকের কথায় কান না দিয়ে শমী সঙ্গীর হাত ধরেছেন লাল টুকটুকে শাড়ি পরে!
এ কারণেই শমীরা অনুকরণীয়, অনুপ্রেরণাদায়ী।
লেখক: আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী।