নারী শক্তিশালী ও প্রজ্ঞার অধিকারী
আফরোজা আঁখি: গল্প নয় সত্যি। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে যেসব কাহিনি শোনা, আজও তার প্রতিকারে বদ্ধপরিকর আমি। শুনেছি যুদ্ধকালীন রাজাকার ও হানাদারদের দ্বারা নারীর সম্ভ্রমহানির কথা। ভেতরে এক প্রকার অন্যরকম অনুভূতি কাজ করত। এলাকার একজন বয়োবৃদ্ধ দাদিকে সবাই অন্য চোখে দেখত। যুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি হানাদাররা তার সম্ভ্রমহানি করেছিল। এলাকার সবাই বিচ্ছিন্নভাবে পালিয়ে বাঁচতে পারলেও তিনি লুকাতে সক্ষম হননি। পাকিস্তানিরা তার সম্ভ্রমহানি করে।
যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে কয়েক জন যুবক অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক মেয়েকে তুলে নিয়ে সম্ভ্রমহানি করে। শুনেছি, সেদিন তারা বিচারের প্রত্যাশাও করার সাহস পায়নি। নিজেদের নিরাপত্তার নিমিত্তে মেয়েকে রেঙ্গুনে পাঠিয়ে দেয়। পরে সেখানেই তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। এলাকার দুর্ধর্ষ সেই যুবকদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস কখনো কেউ পায়নি। সেইসব যুবক পরবর্তী সময়ে ভালো ভালো চাকরি জোগাড় করে। সুকৌশলে বা নিজেদের চরিত্র গোপন করে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করে। তাই আমিও নিজেকে শক্ত করে নিয়েছি।
চলমান করোনা ভাইরাস মহামারির মধ্যেও সিলেটে এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে কিছু বখাটে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ঘুরতে আসা নবদম্পতির স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে রেপ করে। এ ঘটনার প্রতিবাদে মানববন্ধন হয়েছে। কেউ কাঁদছে, কেউ বিচারের দাবি করছে। মিডিয়ার মাধ্যমে আজ সর্বসম্মুখে দৃশ্যমান বিষয়টি। এমন সব ঘটনা বন্ধ করতে প্রয়োজন কঠোর আইনি ব্যবস্থা এবং সেসব আইনের বাস্তবায়ন।
এদিকে ১২ অক্টোবর মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে নারী নির্যাতন আইনের সংশোধন খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করা হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এখন ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু, ইত্যাদির শাস্তিধারা ৯(১) যদি কোন পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহা হইলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন।
‘ব্যাখ্যা—যদি কোনো পুরুষ বিবাহবন্ধন ব্যতীত ষোল (১৬) বত্সরের অধিক বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া, অথবা ষোল (১৬) বত্সরের কম বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।
ধারা ৯(৪) যদি কোন ব্যক্তি কোন নারী বা শিশুকে (ক) ধর্ষণ করিয়া মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন; (খ) ধর্ষণের চেষ্টা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক দশ (১০) বত্সর কিন্তু কমপক্ষে পাঁচ (৫) বত্সর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন।
পরিবর্তনের ছোঁয়ায় সমাজ বদলানোর অভিলাষ আমার। আমিসহ আমার চারপাশে সব নারী/মেয়ে শক্তিশালী। প্রজ্ঞার অধিকারী। সেখানে অনেক ক্ষেত্রে পুরুষ নির্যাতনের প্রসঙ্গে এসে পড়ছে। আমার দেখা চারপাশ এখন এমনই প্রেক্ষাপট চলছে। সেখানে পুরুষ নির্যাতন আইনেরও প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক খুললেই নারীবাদী নারীদের অসহায়ত্বের ঘটনা চোখে পড়ে। আমার প্রশ্ন, নারী কোথায় দুর্বল? কেন দুর্বল? কেন অসহায়ত্বের টানাপোড়েনে ভুগছেন আধুনিক নারীরা? কিছু বখে যাওয়া তরুণ/মানুষের দায় পুরুষ সমাজকেই-বা কেন নিতে হবে! কেনই-বা তা নারীবাদ-পুরুষবাদ ইস্যু হবে। নারী শক্তিশালী—সব ক্ষেত্রেই আমি মনে করি। যদি কখনো মনে হয়, পেশিশক্তিতে ঘাটতি রয়েছে, তাহলে প্রজ্ঞা খাটিয়ে জয়ের মাল্য নারীদেরই তো হওয়ার কথা।
আমি এমন বহু বিজয় দেখেছি, দেখছি। আমার নিজগৃহে আমার ছয় বছরের মেয়েও অধিকারসচেতন। এটা সম্ভব। চাই গঠনমূলক চর্চা। আপনার মেয়েকে জেতার জন্য লড়াই করার কৌশল শেখান। সচেতন হতে শেখান। তার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেকে নৈতিকতার শিক্ষায় শিক্ষিত করুন। ঘরে চর্চা করুন সততার। মিথ্যা, পরনিন্দা বর্জন করুন। আয় বুঝে ব্যয় করুন। ঘুষ-দুর্নীতিতে বাধ্য করবেন না ঘরের পুরুষকে, কিংবা নিজেকে। অবৈধ উপার্জনের গাড়ি-বাড়ি দিয়ে আপনার সন্তানকে অন্যের চোখে ঘৃণার পাত্র করবেন না।
আমি বলি, নারী নিজেকে অসহায়-দুর্বল না ভেবে তাদের (ছেলে সন্তানদের) নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করুন। শুরু করুন নিজ ঘর থেকেই। সঙ্গে, মেয়েকে গড়ে তুলুন লড়াকু করে অসহায় কিংবা দুর্বল ভাবার সুযোগ না দিয়েই।
লেখক :সাংবাদিক