মুসলিমদের পতিতদশা এবং ইসমাঈল সিরাজীর আত্মক্রন্দন
বিশেষ অনুরোধ
বাঙালী মুসলিমের রেনাসাঁর অগ্রনায়ক ছিলেন সিরাজগঞ্জের ইসমাঈল হোসেন সিরাজী। মুসলিমদের পতিতদশা দেখে তার হৃদয় যে কতটা আহত ও ক্রন্দনরত ছিল সেটি বুঝা যায় তার রচিত নিম্মুক্ত লেখাটি পড়ে। মুসলিম জীবনে জাগরন আনতে লক্ষে তিনি গদ্য ও পদ্য উভয়ই লিখেছিলেন। যাদের মধ্যেই তিনি লেখনীর সামর্থ্য দেখেছেন তাদেরকে তিনি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। কিন সম্পদশালী ছিলেন না, তবুও তার জন্মস্থানে বড় বড় সম্মেলন ডেকেছেন। আজ যদি তিনি হিন্দু হতেন এবং হিন্দু রেনাসাঁর পক্ষে এমনটি লিখতেন তবে হিন্দুদের ঘরে ঘরে তার পুজা হতো। পাকিস্তান আমলে তাঁর লেখা স্কুল-কলেজে পড়ানো হতো। কিন্তু আজকের বাঙালী মুসলিমগণ এ মহান বুদ্ধিবৃত্তিক মোজাহিদকে বিলকুল ভূলে গেছে। দেশে কত কাপালিকের জীবন নিয়ে কত আলোচনা হয় অথচ তাঁর মত মনিষী নিয়ে কোন আলোচনা সভা নেই। বাংলাদেশের স্কুল-কলেজের সিলেবাস থেকে তার লেখনীকে পরিকল্পিত ভাবে বাদ দেয়া হয়েছে। ছাত্রদের সংযোগহীন করা হচ্ছে তাঁর সাহিত্যের সাথে। ইসলামের শত্রুপক্ষের হাতে বাংলাদেশ যে কতটা অধিকৃত -এ হলো তার নমুনা। আর দেশ যখন শত্রু ও শত্রুদের দাসদের দখলে যায় তখন দেশ শ্রষ্ঠ সন্তানেরা উপেক্ষিত হবে, ফাঁসিতে ঝুলবে ও গুম-খুনের শিকার হবে সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? মুক্তি বাহিনী ১৯৭১ তাঁর পুত্রকে নির্মম ভাবে হত্যা করে এবং তার পরিবারকে লুন্ঠিত করে এ অপরাধে যে, পাকিস্তান ভাঙ্গার ভারতীয় প্রজেক্টকে সমর্থন করেননি। এ লেখাটি পড়া এবং অন্যদের কাছে এটি পৌঁছানোর অনুরোধ রইলো। নিজে জাগা ও অন্যকে জাগানোর ক্ষেত্রে এ প্রবন্ধটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিনীত নিবেদক: ফিরোজ মাহবুব কামাল
ইসমাঈল হোসেন সিরাজীর লেখা থেকেঃ
“… ঘোর অন্ধকারে নিপতিত পথভ্রষ্ট ব্যক্তি সহসা আলোকশিখা দেখিলে তাহার নিরাশ ও ব্যাকুল প্রাণে যেমন আশার সঞ্চার হয়, হিমসম্পাত সঙ্কুচিত অবসাদগ্রস্ত তরুলতা বসন্তের মলয় হাওয়ার নব জীবনপ্রদ স্পর্শে যেমন সর্বাঙ্গে নব পুলক ও নব জাগরণের স্ফূর্তি অনুভব করে, ভূপতিতা আশ্রয়বিহীনা লতা সহসা একটা বৃহৎ বৃক্ষের আশ্রয় পাইলে সে যেমন দ্রুতগতিতে বাড়িয়া উঠে, অধঃপতিত, আশ্রয়বিহীন, সহস্র দুর্দশাগ্রস্ত জাতিও তেমনি অতীত যুগের প্রাণময়ী গৌরব-কাহিনী পাঠ ও আলোচনা করিয়া হতাশ, নিরাশ ও অবসন্ন প্রাণে নব আনন্দ ও নব আবেগ লাভ করে। পূর্বপুরুষদিগের অপূর্ব ত্যাগ স্বীকার, অপূর্ব অধ্যবসায়, অসাধারণ স্বজাতি-প্রেমিকতা, উন্নতির অদমনীয় স্পৃহা, লোকচমকিত শৌর্য-বীর্য, অটল আত্মবিশ্বাস, অবিচল আত্মসম্মান প্রভৃতি মনুষ্যত্ব, প্রভুত্ব, উন্নতি ও মর্যাদার বিভিন্ন গুণের বিশদ কাহিনী পাঠ করিয়া আড়ষ্ট ও দুর্বল, ভীত এবং সঙ্কুচিত প্রাণের মধ্যেও একটা দুর্জয় বৈদ্যুতিক শক্তির বিক্রম লাভ করে।
যে কূপের সহিত প্রাকৃতিক উৎসের সংযোগ আছে, তাহার পানি কমিতে পারে বটে, কিন্তু কিছুতেই শুষ্ক হইতে পারে না; ঠিক সেইরূপ যে জাতির ইতিহাস অতীতের সহস্ৰ গৌরব-কাহিনীতে পরিপূর্ণ সে জাতির যদি ইতিহাসের সহিত পরিচয় থাকে, সে জাতিও অধঃপতিত এবং পরপ্রত্যাশী হইতে পারে বটে, কিন্তু সে জাতি কখনও মরিতে পারে না। তাহার জাতীয় প্রাণ হইতে মনুষ্যত্ব ও প্রভুত্ব লাভের আকাঙ্ক্ষা একেবারে সম্পূর্ণভাবে কখনও তিরোহিত হইতে পারে না। ব্যক্তিগত জীবনে যেমন আত্মবিশ্বাস একমাত্র উন্নতি ও প্রতিপত্তি লাভের কারণ, জাতিগত জীবনেও তেমনি আত্মবিশ্বাসই জাতিকে অধঃপতন ও শোচনীয়তার গভীর গহবর হইতে কল্যাণ ও আনন্দের উন্নত ও আলোকপ্ৰদীপ্ত স্ফূর্তির রাজ্যে লইয়া যাইতে সমর্থ হয়। জাতীয় গৌরবের ইতিহাস এই আত্মবিশ্বাস জন্মাইবার এবং আত্মা আকিঞ্চন-জ্ঞান দূর করিবার পক্ষে অমোঘ ঔষধ।
মুসলমানদের যেমন ইতিহাস আছে এবং সেই ইতিহাস যেমন বিরাট ও বিপুল এবং তাহাতে গৌরবের কথা, জ্ঞান-গরিমার ও প্রতিভা-গরিমার বাণী, বীরত্বের জ্বলন্ত কাহিনী যে পরিমাণে বিদ্যমান আছে, পৃথিবীর আর কোনও জাতির তাহা নাই। মুসলমান কোনও স্থান-কাল-পাত্রের ক্ষুদ্রতায় আবদ্ধ নহে বলিয়া জগতের সমস্ত মুসলমানের গৌরব ও যশঃ জগতের প্রত্যেক মুসলমানেরই প্রাপ্য ও ভোগ্য। আরবীয় মুসলমানের গৌরব যেমন চীন ও ভারতীয় মুসলমানের ভোগ্য ও প্রাপ্য, ভারত ও চীনের মুসলমানের গৌরবও তেমনি আরবীয় মুসলমানের প্রাপ্য ও ভোগ্য। গঙ্গার পানিরাশি নানা দেশ-প্রদেশ অতিক্রম করিয়া বহমান হইলেও উহা যেমন সর্বত্র একই গঙ্গার পানি, প্রয়াগের গঙ্গার পানি এবং শান্তিপুরের গঙ্গার পানি যেমন পরস্পরকে পৃথক বলিয়া কখনই মনে করিতে পারে না, তেমনি ভাষা, বর্ণ, আকৃতি ও জন্মস্থানের পার্থক্য থাকিলেও পূর্বের মুসলমান পশ্চিমের মুসলমান হইতে, কৃষ্ণাঙ্গ শ্বেতাঙ্গ হইতে, গোলাম বাদশাহ হইতে কখনই নিজকে পৃথক মনে করিতে পারে না। বস্তুতঃ তাহারা ভাবের রাজ্যে, ধর্মের রাজ্যে, কর্তব্য ও কর্মের রাজ্যে পরস্পর এক।
শিকলের অসংখ্য কড়া যেমন পরস্পরের সহিত পরস্পর দৃঢ়ভাবে সংবদ্ধ, সমস্ত জগতের মুসলমানগণও তেমনি পরস্পর একক সম্বন্ধযুক্ত। এই জন্য আফ্রিকা বা আমেরিকার কােনও মুসলমানের মৃত্যু হইলে বাঙ্গালা বা বাঙ্গালার মুসলমানের কণ্ঠ হইতে ‘ইন্নালিল্লাহ …’ আপনা আপনি বাজিয়া ওঠে। এই জন্যই বাদশাহ গোলামকে কন্যা দান করিতে কুষ্ঠিত হন না। মসজিদে সম্রাট গোলামের পশ্চাতে দণ্ডায়মান হইয়া তাহার পদসম্মুখে মস্তক রাখিয়া আল্লাহকে ছেজদা করিতে কিছুমাত্র সঙ্কোচ বা কুন্ঠাবোধ করেন না। এই মহা ঐক্যের বন্ধনের জন্যই নিখিল জগতের সমস্ত দেশের, সমস্ত বর্ণের ও সমস্ত বংশের মুসলমানের গৌরব, উন্নতি বা কল্যাণের সৌরভ, পৃথিবীর যে কোন দেশের, যে কোন বর্ণের মুসলমানেরই উপভোগ্য। এই জন্যই মুসলমানের ইতিহাস বিপুল, বিরাট ও বিশাল হইয়া পড়িয়াছে। আর সেই অনন্ত ইতিহাসের পত্রে-পত্রে, ছত্ৰে-ছাত্র গৌরবের ছটা বিকীর্ণ হইতেছে। যে জাতির এমন বিপুল গৌরব কাহিনীর অসীম আলোক-ভাণ্ডার আছে, তাহাদের সম্মুখে যদি সেই ভাণ্ডারের দ্বার মুক্ত করিয়া একবার আলোকের রাজ্য প্রদর্শন করিতে পার, তবে তাহাদিগকে কেহই অন্ধকারে রাখিতে পারিবে না।
তবে মুসলমান এমন গভীর অন্ধকারে পড়িয়া আছে কেন? ইতিহাস তো তাহার খুবই আছে। কথা হইতেছে, ইতিহাস থাকিলে কি হইবে? ইতিহাসের সহিত পরিচয় আছে কয়জনের? গৃহে লক্ষ লক্ষ মণ ইস্পাত থাকিলেই শত্রু জয় করা যায় না। সেই ইস্পাত দ্বারা অস্ত্রশস্ত্র প্রস্তুত করা চাই এবং যথারীতি তাহার ব্যবহার করিলে তবে ত যুদ্ধে জয়লাভ হয়। ইতিহাসের এই অনন্ত গৌরব-কাহিনীকে যদি রসের মত, আনন্দের মত, পানির মত, হাওয়ার মত সমস্তটা জাতি ভোগ করিতে পারে, তবেই মুসলমানের পক্ষে এই মৃত্যু-সমাধি হইতে, অন্ধকার গোর হইতে, “খাবে গাফলাতে”র মোহ হইতে নূতন জগতের, নূতন জীবনের, নূতন কর্মক্ষেত্রের সন্ধানে ধাবিত হওয়া সম্ভবপর। প্রত্যেক জাতির বালকেরাই সেই জাতির ভবিষ্যনিয়ন্তা। বালকের কোমল হৃদয়ে মাতৃগর্ভ হইতে আরম্ভ করিয়া মাতৃঅঙ্কে, মাতৃঅঞ্চলে, পল্লীর পাঠশালে এবং শহরের স্কুল-কলেজে, মকতব ও মাদরাসায় পুস্তক ও প্রবন্ধে স্বজাজাতির যেরূপ বর্ণনা শ্রবণ ও পাঠ করে; স্বজাতির যেরূপ মূর্তি ইতিহাসে, উপন্যাসে, কাব্য ও আখ্যানে দেখিতে পায়, তাহারা সেইরূপভাবেই আপনাদের ভবিষ্যৎ গঠন করিতে সমর্থ হয়।
শৈশবকাল হইতে সন্তানদিগের প্রাণে জাতীয় উচ্চ আদর্শ এবং উচ্চ ভাব প্রবেশ করাইয়া দিতে না পারিলে, শত শিক্ষা দ্বারা কখনও জাতীয় উন্নতি সাধন বা অধঃপতনের গতিরোধ হইতে পারে না! অন্তরের মধ্যে বাল্যকাল হইতে যে ভাব ও কল্পনা বা চিন্তা জমাট বাঁধিয়া যায়, কার্যক্ষেত্রেও মানুষের জীবন তদনুরূপ অভিব্যক্ত ও ক্ষমতাশালী হইয়া পড়ে। পৃথিবীর উন্নত জাতিসমূহের শিক্ষার মূলে এই জাতীয়তার উচ্চ আদর্শের প্রভাব ও প্রতিপত্তি সন্তানদিগের প্রাণে বদ্ধমূল করিয়া দিবার জন্য সহস্রবিধ আয়োজন বন্দোবস্ত করা হইয়াছে। বাল্যকাল হইতেই তাহাদের সন্তানেরা শিক্ষা পায় যে, “পৃথিবীতে তাহারা বড় হইবার জন্য, শ্রেষ্ঠ হইবার জন্য জন্মগ্রহণ করিয়াছে। তাহাদের জাতিই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি।”
প্রমাণস্বরূপ গৌরবান্বিত বৃটিশ জাতির ‘রুল ব্রিটানিয়া’ সঙ্গীতটি মনে করুন : Rule Britania ! Britania rule the waves, The Britons never shall be slaves. শাসক ব্রিটিশগণ ! উর্মিরাশি সমুদ্রের, ব্রিটেন হবে না কভু পরাধীন অপরের। শৈশবকাল হইতে যে জাতির শিশুরা এইরূপ সর্বভীতিনাশক ভয়প্রদ তেজ:সঞ্চারণী বাণীর অমৃতধারা পান করিয়াছে, তাহারা যে অখণ্ড জগতের উপরে আপনাদের প্রভুত্বের সিংহাসন স্থাপন করিতে সমর্থ হইয়াছে তাহাতে আশ্চর্য কি? তারপর তাহাদের জাতীয় বীরপুরুষদিগের, কর্মীদিগের “শহীদ”দিগের শৌর্য-বীর্য-প্রভুত্ব-পরাক্রম এবং গৌরব ও প্রতাপের কথা সহস্র বর্ণে, সহস্রভাবে রঞ্জিত এবং উজ্জল করিয়া কবিতার ছন্দে, কাব্যের চিত্রে, ইতিহাসের বর্ণনায়, উপন্যাসের রস বিন্যাসে মর্মে মর্মে, প্রাণে প্রাণে, হৃদয়ে হৃদয়ে একেবারে বদ্ধমূল করিয়া দেওয়া হয়। ফলত: আজকাল সকল দেশেই-বাল্যকাল হইতেই স্বদেশের স্বজাতির গৌরব-কাহিনী, ঐতিহাসিক কীৰ্তিকলাপ ও বীর্য-শৌর্যের স্মৃতি দ্বারা বালক-বালিকাদিগের হৃদয়কে মহিমাস্পৃহ, সবল ও তেজঃপূর্ণ করিবার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করিতেছে।
আমার ইউরোপ-প্রবাসকালীন তুর্কীদিগের শিক্ষাপ্রণালী বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করিয়াছিলাম। তাহাদিগের গৃহশিক্ষা এবং বিদ্যালয়ের শিক্ষা আমাদিগের অপেক্ষা কত উন্নত, মার্জিত, সবল এবং তীক্ষ্ণ, তাহা আমি পুস্তকাকারে বর্ণনা করিয়াছি। এখানে মাত্র তাহাদিগের ইতিহাস শিক্ষা-প্ৰণালীর উল্লেখ করিতেছি। তুর্কী-বালকদিগকে নিম্নশ্রেণী হইতেই তুর্কীজাতির ইতিহাস ভালরূপে শিখান হয়; বাল্যপাঠ্য ইতিহাসে গৌরবের কথাই বিশেষরূপে বৰ্ণিত হয়। শিক্ষক ও শিক্ষয়িত্রীগণ তুর্কী জাতি, সুলতান, বীর পুরুষ, জ্ঞানাচার্য ও ধর্মবীরদিগের গৌরবের কথা, দিগ্বিজয়ের গাঁথা, জ্ঞানচর্চার কাহিনী ও মহিমার বাণী মুখে মুখে বিশেষ করিয়া গল্পের আকারে শুনাইয়া দেন। ব্যক্তিগত চরিত্রের কলঙ্ক ও অগৌরবের কথা যতদূর সম্ভব ছাত্রদিগের নিকট উল্লিখিত হয় না। পৃথিবীর সর্বত্রই আজকাল এই পদ্ধতিতেই সভ্যদেশ সমূহে ছাত্রদিগকে ইতিহাস শিক্ষা দেওয়া হয়। আমাদের দেশেও ক্রমশঃ ছোট ছেলেদিগকে নিম্নশ্রেণীতে মুখে মুখে ইতিহাস শিখাইবার বন্দোবস্ত করা হইয়াছে। কিন্তু তাহার সুফল মুসলমান ছাত্রগণ কতটা ভোগ করিতেছে, তাহা কেহ খবর রাখেন কি?
আমাদের সন্তানেরা প্রায়শঃ মুসলমান-বিদ্বেষী বিজাতীয় লেখকদিগের লিখিত ইতিহাস মুসলমানদ্বেষী শিক্ষকদিগের নিকট পাঠ করিয়া থাকে। এই সমস্ত ইতিহাসের যে কোনও খানি খুলিয়া পাঠ করিলেই দেখা যাইবে যে অত্যন্ত সাবধানতার সহিত মুসলিম আমলদারীর অংশ হইতে গৌরবের কথাগুলি চাঁছিয়া, মুছিয়া একেবারে ধুইয়া ফেলা হইয়াছে। প্রাতঃস্মরণীয়, পুণ্যবান, প্রজাপালক ও কীর্তিমান বাদশাহদিগকেও যারপর নাই অত্যাচারী, নিষ্ঠুর, পিশাচ প্রকৃতি, আলস্যপরায়ণ ও ইন্দ্ৰিয় দাসররূপে সাজান হইয়াছে; গৌরবের কথা, সুশাসনের কথা যেখানে একেবারে উল্লেখ না করিলেই নয়, সেখানেও এমন কৌশলে, এত সংক্ষেপে উল্লেখ করা হইয়াছে যে, ছাত্রদের দৃষ্টি ও মনোযোগ তৎপ্রতি আকৃষ্ট না হওয়াই স্বাভাবিক। ফলতঃ স্কুলপাঠ্য ইতিহাস পাঠে, মুসলমান ছাত্রদিগের হিতের পরিবর্তে নিদারুণ বিপরীত ফলই লাভ হইতেছে। বাল্যকাল হইতেই কোমলমতি বালকগণ জাতীয় সম্মান জাতীয় গৌরববোধের স্থানে স্বজাতির প্রতি দারুণ ঘূণা ও অশ্রদ্ধার ভাব পোষণ করিতে আরম্ভ করে। তৎপর তাহারা হিন্দুদিগের রচিত অন্যান্য বহি-পুস্তকে এবং নাটকে-নভেলে মুসলমানের যে চিত্র দেখে, তাহা আরও বীভৎস ও পৈশাচিক। রঙ্গমঞ্চে মুসলমানের যে মূর্তি দেখে তাহাতে কিছুমাত্র আত্মসম্মান-বোধ বিশিষ্ট ছাত্রের পক্ষেও মৃত্যু কামনা করাই স্বাভাবিক।
হায় ! যে জাতির সুকুমারমতি বালকগণ জীবনের প্রথম হইতেই স্বজাতি সম্বন্ধে এইরূপ অতি নীচ ও জঘন্য ধারণা পোষণ করিতে বাধ্য হয় ও শিক্ষা পায়, সে জাতির বালকদিগের উত্তম জীবনের মনুষ্যত্ব, জাতীয় মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব জ্ঞানের বিকাশ হওয়া কি নিতান্তই আকাশ কুসুম নহে? ফলেও কি আমরা তাহাই দেখিতেছি না? আবার অন্যদিকে আমাদের স্বদেশীয় প্রতিবেশীদের কাণ্ড-কারখানা, কৌশল ও অধ্যবসায়ের প্রতি দৃকপাত করুন। একমাত্র কাশ্মীরের ‘রাজ তরঙ্গিণী’ খানা ব্যতীত হিন্দুর ইতিহাস বলিতে আর একখানি বহিও নাই। তাহাও পৌরাণিক গালগল্প হইতে মুক্ত নহে। অথচ গোটা হিন্দুজাতিটাই আজকাল রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণাদি হইতে নানা শ্রেণীর অলীক, অসম্ভব ও অবিশ্বাস্য গল্প এবং কেচ্ছাকাহিনীগুলি কাটিয়া ছাঁটিয়া মাজিয়া ঘষিয়া কৃত্রিম ঐতিহাসিক আকার দান করতঃ সহস্রধা বিচ্ছিন্ন এবং সহস্র সহস্র বৎসরের পতিত হিন্দুজাতির বালক বালিকার মনে আত্মসম্মান, স্বজাতির শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রভুত্ত্ব-প্রতিপত্তির ধারণা দৃঢ় বদ্ধমূল করিয়া দিবার জন্য কি বিপুল আয়োজন ও অর্থব্যয় স্বীকার করিতেছে !
রাজনীতি ক্ষেত্রে চিরপ্রতিষ্ঠাহীন ও চির প্রভুত্বশূন্য হিন্দুকে প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্যই আর্যজাতির কড়াক্রান্তি পরিমিত গৌরবকেও এমন করিয়া বিপুল ও বিরাটভাবে ফেনাইয়া ফাঁপাইয়া তোলা হইতেছে যে, তাহা ভাবিয়া অবাক হইতে হয় ! দুর্গাদাস লাহিড়ী মহাশয় প্রণীত ‘পৃথিবীর ইতিহাসের’ যে বৃহৎ বৃহৎ কয় খন্ড বাহির হইয়াছে, তাহার প্রথম দুই খণ্ড বিরাট বহিতে ভারতবর্ষের হিন্দুদিগের গৌরবকাহিনীকে ফেনাইতে যাইয়া মুসলমানের জ্ঞানগৌরবের প্রতি কঠোর আঘাত করা হইয়াছে। অথচ আশ্চর্যের বিষয় ! আমাদের কতিপয় রাজ্যশুন্য তথাকথিত নবাব এই কেতাবের তারিফ করিতে যাইয়া বেশ ‘জবান দারাজী’ শেখাইয়াছেন। এ অধম কয়েক বৎসর পূর্বে পৃথিবীর ইতিহাসের কতিপয় মারাত্মক মিথ্যা রচনা ও অপবাদ অপহ্নুতির যে প্রতিবাদ করিয়াছিল, আজও কেহ তাহার প্রতিবাদ করিতে সমর্থ হন নাই। অথচ এই সময় ‘গায়ে মানেনা আপনি মোড়ল” নবাবপুত্রদিগের হিন্দু আমলারা ইতিহাসের যে প্রশংসাপত্র লিখিয়া দিয়াছে, তাহারা চক্ষু মুদিয়া তাহাতেই নাম দস্তখত করিয়া দিয়াছেন মাত্র।
মুসলমানের জন্য যে “লানতের তওফ’ রচিত হইয়াছে, এই সমস্ত মহাত্মারা তাহার গৌরব ঘোষণা করিতে কিছুমাত্র সঙ্কোচ বোধ করেন নাই। খোদাতায়ালা ইহাদের প্রভাব সংস্রব হইতে মুসলমানকে রক্ষা করুন। ফলত: মুসলমানের অতুলনীয় বিপুল ও বিশাল বীর্য-শৌর্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শ্রেষ্ঠত্ব ও গৌরবের অভ্ৰভেদী স্তম্ভকেও কেমন করিয়া হিন্দু লেখকেরা কলঙ্ক কালিমায় আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিবার জন্য কি কূটকৌশল অবলম্বন করিয়াছেন, তাহা ভাবিলে যুগপৎ দুঃখে ও ক্ষোভে হৃদয় প্রজ্জলিত হইয়া উঠে। যাবতীয় দিগ্বিজয়ী মহাবীরদিগের দিগ্বিজয়ের কাহিনীর মধ্যে বঙ্গবিজয়ের কাহিনী মুসলমানের পক্ষে যেমন গৌরবের হিন্দুর পক্ষে উহা তেমনি কলঙ্কের কারণ। সপ্তদশ জন অশ্বারোহী মাত্র সম্বল করিয়া বাঙ্গালার ন্যায় বিশাল রাজ্য অধিকারের কাহিনী দুনিয়ার ইতিহাসে আর দুটি নাই। সপ্তদশ অশ্বারোহীর ভয়ে বিনাযুদ্ধে রাজ্যত্যাগ করতঃ খিড়কিদ্বার দিয়া রাজার পলায়নের এমন কাপুরুষতা ব্যঞ্জক কাহিনীও পৃথিবীতে আর দু’টি নাই। জাতীয় অঅভ্যুত্থানের খেয়ালের পথে হিন্দুর পক্ষে এই ঘটনা তীব্র কণ্টকস্বরূপ।
তাই আজ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয় এই ঘটনাকে মিথ্যা বলিয়া প্রতিপন্ন করিবার জন্য নানা বাকজাল বিস্তার করিয়াছেন। উপযুক্ত জবাব দিবার লোক মুসলিম-সমাজে নাই মনে করিয়াই বোধ হয় তিনি প্রসিদ্ধ ইতিহাস-বেত্তা কাজী মিনহাজ উদ্দিন সিরাজ জারজানী মহাদয়কে মিথ্যাবাদী বলিতে কিছুমাত্র সঙ্কোচবোধ করেন নাই। শূন্য ময়দানে জয়-পতাকা উড়াইয়া দিবার মত এমন সুযোগ ও সুবিধা আর কোথায় পাওয়া যাইবে? প্রিয় পাঠক-পাঠিকা ! একজন মুসলমান ছাত্রকে একজন বীর পুরুষের নাম করিতে বলুন। সে নিশ্চয়ই অম্লানবদনে নেলসন, নেপোলিয়ান, গ্যারিবল্ডী, ওয়াশিংটন এবং ভীম-অর্জুনের কথা এমন কি দস্যুদলপতি শিবাজীর কথা পর্যন্ত বলিয়া ফেলিবে। কিন্তু হায় ! সে ভ্রমেও ওমর, আলী, খালেদ-এবনে-অলিদ, আমর্, শুরহাবিল, সা’আদ, আবু ওবায়দা, জেরার, মোসন্না, হাঞ্জালা, সুলতান ছালাহউদ্দীন, ওকবা, মুছা, আয়াজ, তারেক প্রভৃতি বীরপুরুষদিগের কথা দূরে থাকুক, স্বদেশের অক্লান্ততেজঃ, দৃপ্তবীর্য মহাবীর আকবর, আওরঙ্গজেব, শেরশাহ, আলাউদ্দীন, নিজাম-উল-মূলক, হায়দার আলী (মহিশুরের শেষ অধিপতি), চাঁদ সুলতানা, রাজিয়া সুলতানা, আলীবর্দী, তাকী খান, আবুল ফজল, শুজা উদ্দৌলা, ফিরোজশাহ বাহমনি প্রভৃতি শত শত মহা তেজস্বী ও রাজ্যবিজয়ী বীরপুরুষদিগের নামও সে উচ্চারণ করিতে পারবে না।
সে হয়ত ইহাদের কাহারও কাহারও নাম জানিতে পারে বটে; কিন্তু তাহারা যে পরাক্রান্ত বীর ছিলেন, সে বিষয়ে সে কিছুই জানে না। তাহাকে যাহা বুঝান হইয়াছে, তাহার মধ্য হইতে গৌরবের ধারা খুঁজিয়া বাহির করিবার কোনও সূত্র দেওয়া হয় নাই। যে দিগ্বিজয়ের জন্য বালকের হৃদয়ে গৌরবের ভাব উদ্বুদ্ধ হওয়া আবশ্যক ছিল, তৎপরিবর্তে এই সমস্ত প্রাতঃস্মরণীয় বীরপুরুষদিগের যুদ্ধবৃত্তান্ত ও বীরত্ব কাহিনীকে নৃশংস, নিষ্ঠুর, দানবীয় ও পৈশাচিক কার্যরূপে বর্ণনা করিয়া তাহাদিগের প্রতি আভক্তি ও বিরক্তির ভাবকে সজাগ করিয়া তোলা হইয়াছে। ভারতের মুসলমান রাজত্বের ইতিহাস অনন্ত গৌরবের ভাণ্ডার। তাহা হইতে মুসলমানের অনন্ত মহিমা ও গরিমার জ্যোতি নিৰ্গত হইতেছে। কোন্ দেশে শেরশাহ, আকবর, শাহজাহান, আওরঙ্গজেব, ফিরোজ, জালালউদ্দিন, আলাউদ্দিন, হুমায়ুন প্রভৃতির ন্যায় মহাবীর ভূ-পালগণ এত অধিক সংখ্যক আবির্ভূত হইয়াছিলেন? কোন্ দেশে নাছিরউদ্দিন তুগলক, বলবন এবং আওরঙ্গজেবের ন্যায় ঋষিপ্রতিম সম্রাট এত অধিক জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন? যে দিল্লীর বাদশাহী হারেম অনন্ত নারী-প্রতিভা এবং নারীজ্ঞানের অনন্ত মহিমার আকর, আজ তাহা আর্কফলাধারী “ক্ষৌরিতচিকুর” চট্টোপাধ্যায় হইতে নথকৃন্তিকাধারী শীলের লেখনী চালনায় পাপের আকর এবং শয়তানী ও দানবীর উৎপত্তিস্থান বলিয়া অভিহিত হইতেছে।
অবশ্য এ সকল অলীক ও কল্পিত কলঙ্ককাহিনী মূলে সূত্রপাত করিয়াছেন ইউরোপীয় ঐতিহাসিক এলফিনস্টোন প্রভৃতি। ইংরেজি বিদ্যার অধিকারী প্রতিবেশীগণ সে সকল চর্বিতচর্বণ বাঙ্গালা ভাষার সাহায্যে অলিতে-গলিতে ছড়াইয়া দিয়াছেন। ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণ যে উদ্দেশ্যে এ সকল কাজ করিয়া গিয়াছেন, তাঁহাদের সে উদ্দেশ্য সফল হইয়াছে। দম্ভের সহিত বলিতে পারি, দিল্লীর হারেম যত মনস্বিনী ও প্রতিষ্ঠাশালিনী, যত ব্রহ্মবাদিনী ও তপস্বিনীর জন্মদান করিয়াছে, বাগদাদ, কায়রো, কর্ডোভাতেও তাহার তুলনা নাই। নূরজাহান, মমতাজ মহল, রোকাইয়া বেগম, গুলবদন বেগম, দৌলতুন্নেচ্ছা, জাহানারা, জেবুন্নেছা, রওশন আরা কুদসিয়া, রাজিয়া সুলতানা, হামিদা বেগমের ন্যায় এমন নারী-রত্নহার আর কোথাও খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। রাজনৈতিক প্রতিভায় এক নূরজাহানই সারাজাহানের নূর। রাজিয়া সুলতানারই বা তুলনা কোথায়? এমন বিশাল সাম্রাজ্য, কোন্ দেশে আর কোন্ স্ত্রীলোকদিগের দ্বারা এমনভাবে সুশাসিত এবং সুরক্ষিত হইয়াছিল?
বাগদাদের মহামতি খলিফা হারুণের বিবি জোবেদা খাতুন এবং মামুনের স্ত্রী খেদিজা বা বুরান বিদুষী ও বুদ্ধিমতী ছিলেন; স্পেনের সম্রাট তৃতীয় আবদুর রহমানের স্ত্রী জোহরাও বিদুষী ও জ্ঞানবতী ছিলেন বটে; কিন্তু নূরজাহান ও রাজিয়ার সঙ্গে কাহারও তুলনা হয় না। কিন্তু সে নূরজাহান ও রাজিয়ার জন্য আমরা কতটুকু গৌরব অনুভব করি? জাহানারা ও জেবুন্নেসার ন্যায় আজন্ম তপস্বিনী, আজন্ম ব্ৰহ্মচারিণী, আজন্ম জ্ঞানচর্চানুরাগিনী, স্পেনের খলিফা মুস্তাকফি বিল্লাহের কন্যা “ওয়ালেদা খাতুন” এবং জগদ্বিজয়ী ‘সাহেবকেস্কন’ তৈমুর লঙ্গের রাজ্ঞী বিবি খানমের ন্যায় কয়জন ধর্মশীল, গৌরবময়ী, প্রতিভাশালিনী দেখিতে পাই? হায়! আজি সেই, দিল্লীর বেগম মহলের প্রতি মোশরেক বা বেদ্বীন লেখকগণ যেরূপ ভাবে কলঙ্কের লোষ্ট্র নিক্ষেপ করিয়াছে, তাহা স্মরণেও হৃদয় বিদীর্ণ হয়। এক নরসুন্দর সন্তান, পুণ্যবতী ও যশশ্বিনী মমতাজ মহলকে বাঙ্গালী হিন্দু-কন্যারূপে পরিচিত করিবার জন্যও বিরাট গ্রন্থ লিখিতে কসুর করেন নাই। ইহাপেক্ষা অসহ্য ধৃষ্টতা এবং জাতীয় অবমাননার কথা আর কি হইতে পারে? হায় ! যে জাতির ধুতি-চাদর মাত্র পরিধেয় ব্যতীত কোনও পোশাক ছিল না — আমাদের পোশাক-পরিচ্ছদে সজ্জিত হইয়া যাহারা আজও সভ্যসমাজে যাইতে বাধ্য হন, আমাদের আদব-কায়দা ব্যতীত যাহাদের নিজস্ব বলিতে কোনও আদব-কায়দাই নাই, আশ্চর্য ব্যাপার ! তাঁহাদের লেখকেরা শত সহস্র পুস্তকে লিখিতেছেন যে, “মুসলমানেরা অসভ্য, অর্ধ সভ্য ছিল, ভারতে আসিয়া হিন্দুদের নিকট সভ্যতা শিখিয়াছে।” আর এই সমস্ত পুস্তক আমাদের সন্তানেরা পাঠ করিতেছে এবং বিশ্বাস করিতেছে। বিরাট সমাজে এই মহা সর্বনাশকর স্রোত রোধ করার জন্য কাহারও কণ্ঠে কোনও চিৎকার শ্রুত হইতেছে না। সমস্ত মুসলমান-গৌরবকে কুক্ষিগত করিয়া লইবার জন্য কিরূপ প্রবঞ্চনা ও বাগজাল বিস্তার করা হইতেছে, তাহার একটা সত্য ঘটনা উল্লেখ করিতেছি। গৌড়ের অধিকাংশ মসজিদই এনামেল বা “মিনা” দ্বারা মণ্ডিত ছিল। মুসলমানেরাই যে এনামেলের আবিষ্কর্তা, হিন্দুর চক্ষে এ গৌরব অসহ্য। একজন তথাকথিত ঐতিহাসিক হিন্দু পণ্ডিত উত্তরবঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের এক মহতী সভায় এই বিষয়ে বক্তৃতা করিতেছিলেন। তিনি একখানি মিনামণ্ডিত ইষ্টক দেখাইয়া বলিলেন– “এনামেল বা মিনার কার্য যে মুসলমানেরা ভারতে প্রবর্তন করিয়াছেন তাহা ঠিক নহে। তাহার প্রমাণ এই ইষ্টকখণ্ড। ইহা মালদহের অমুক শেঠের পুকুরে পাওয়া গিয়াছে।” অমনি অসংখ্য হিন্দুশ্রোতা হাততালি দিয়া Hear, Hear বলিয়া চিৎকার করিয়া উঠিলেন।
আমি ত যুক্তি ও প্রমাণ দেখিয়া আশ্চর্যান্বিত ! দাঁড়াইয়া দৃঢ়কণ্ঠে বলিলাম যে, ঐ ইষ্টকখণ্ড লোষ্ট্রের ন্যায় বোধ হইতেছে। সুতরাং উহা যে লোটন মসজিদ বা তাঁতি পাড়ার মসজিদের ইট, রাখালদের দ্বারা লোষ্ট্ররূপে পুকুরে নিক্ষিপ্ত হয় নাই, তাহার প্রমাণ কি? আর ঐ পুকুর কি মুসলমান আগমনের পূর্বে খনিত? পুকুরের তলায় কত ইট পাওয়া গিয়াছে? আর সব চেয়ে বড় কথা হইতেছে যে, “মিনা” যদি হিন্দুদিগের আবির্ভুত হইত, তবে তাহার সংস্কৃত নাম কি? বক্তার মুখ মলিন হইয়া গেল। তিনি বিস্ময়বিস্ফারিত নেত্রে দেখিলেন যে, এ অধম সেখানে উপস্থিত। বলা বাহুল্য, তিনি আর কোন উত্তর দিতে পারেন নাই। পণ্ডিত রজনীকান্ত চক্রবর্তী গৌড়ের ইতিহাস লিখিয়া খ্যাতি লাভ করিয়াছেন। উহার পত্রে পত্রে মুসলিম-কলঙ্ক কাহিনী ফুটাইয়া তুলিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করা হইয়াছে। কিন্তু হিন্দু রাজা কংসের মুসলমানদিগের প্রতি ভীষণ ও নৃশংস হত্যা ও অত্যাচার কাহিনী একেবারেই গোপন করা হইয়াছে। অথচ এই বইখানি জনৈক মুসলমান ভ্রাতা কর্তৃক প্রকাশিত হইয়াছে। গৌড়নগরী একদিন সুরম্য সৌধমালা, বিরাটাকার মসজিদসমূহ, অসংখ্য উদ্যান এবং বেশুমার তালাবের জন্য দিল্লীর গৌরব-স্পৰ্দ্ধিনী হইয়া উঠিয়াছিল। ইহা দুর্গ ও পরিখা দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। ইহার বিরাট জামে মসজিদ (যাহাকে হিন্দুরা অনর্থক বারদুয়ারী নাম দিয়াছেন) দিল্লির শাহজাহান নির্মিত মসজিদ অপেক্ষা কোন অংশেই ক্ষুদ্র নহে।
আমরা স্বচক্ষে গৌড়ের বিশালায়তন এবং কীর্তিকলাপ দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছি। সুতরাং গৌড়ের এই গৌরবের কিয়দংশ চুরি-চামারী বা যেমন করিয়া হউক, হিন্দুর প্রাপ্য কহিতেই হইবে। সুতরাং চন্দ্র মহাশয় আর কিছু লিখিতে না পারিয়া মস্তক কন্ডুয়ন করিতে করিতে লিখিয়াছেন যে, “আরবদেশ মরুভূমিতে পূর্ণ; সেখানে দীঘি-পুস্করিণী নাই। সুতরাং মুসলমানেরা তাহার আবশ্যকতা বোধ করিতেন না। অতএব গৌড়ের সমস্ত দীঘি-পুস্করিণী মুসলমানদের নহে, হিন্দুর খনিত।” বিজ্ঞ পাঠক-পাঠিকা, এমন চমৎকার যুক্তি আর কখনও শুনিয়াছেন কি? ডন পাসক্যল, লেনপুল, ডোজী প্রভৃতি খৃস্টান ঐতিহাসিকগণ বলেন – আরবেরা মরুবাসী ছিলেন বলিয়াই তাহারা উদ্যান, দীঘি, পুকুর এবং নহর ও উৎসের অত্যন্ত পক্ষপাতী ছিলেন। এই জন্যই ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা সমস্ত আরব রাজধানী ও আরব নগরে উদ্যান, তালাব ও নহরের প্রাচুর্য দেখা যাইত। আর সাধারণ জ্ঞানে একজন আহমকও বুঝিতে পারে যে, যাহার যে বিষয়ে অভাব থাকে সে সেই অভাব পূরণের দিকেই বেশী দৃষ্টি করে। অথচ চন্দ্র মহাশয়ের বুদ্ধি ইহার বিপরীত। আরও আশ্চর্যের বিষয় এই যে, গৌড়ের সুলতানদিগের মধ্যে কেহ আরব হইতে আসেন নাই। সুলতান ও আমীরগণ সকলেই ভারতবষীয় ছিলেন। তাঁহাদের পূর্বপুরুষগণ আফগানিস্তান এবং তুর্কীস্তানের শ্যামল উপত্যকা ও পর্বত পরিপূর্ণ সুজলা সুফলা দেশ হইতেই আসিয়াছিলেন, আরবের মরুভূমির সহিত তাঁহাদের সংশ্রব তো কিছুই ছিল না।
এমত অবস্থায় আরবের মরুভূমির কথা উল্লেখ করা নিতান্তই গাঁজাখুরী নহে কি? তারপর আরবের সর্বত্রই যে মরুভূমি ইহাই বা কে বলিল? আরবের ইরাক, ইয়েমেন ও তায়েফের ন্যায় এমন শস্যশ্যামলা, পুস্পকুন্তলা, সুজলা-সুফলা ভূমি আর কয়টি আছে? দিগ্বিজয়ী সেকেন্দার ইয়েমেনের অত্যুৎকৃষ্ট জলবায়ু, চিত্তবিনোদক প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং প্রচুর ফল-শস্যের জন্যই তাঁহার দিগন্তবিস্তৃত সাম্রাজ্যের রাজধানী ইয়েমেনেই স্থাপন করিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু তাহার অকালমৃত্যু তাহাকে এই বাসনা পূর্ণ করিতে দেয় নাই। সুতরাং পাঠক পাঠিকা, দেখিতেছেন, চন্দ্র মহাশয়ের যুক্তির সারবত্তা কয় ক্রান্তি, কয় ধূল? এই শ্রেণীর যুক্তি কেবল যে চন্দ্র মহাশয়ই প্রয়োগ করিয়াছেন, তাহা কেহ মনে করবেন না। মুসলিম গৌরব, মুসলমান-মহিমা এবং মুসলিম বীর্য-শৌর্যে ধূলি নিক্ষেপের জন্য, একমাত্র পারসী ভাষাভিজ্ঞ বাবু যদুনাথ সরকার ব্যতীত আর সকল লেখক, ঐতিহাসিক (?) ও আলোচনাকারীদিগের যুক্তিতর্ক এবং গবেষণা চন্দ্র মহাশয়ের পদানুসারী। অথচ এই সমস্ত লেখকগণ দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার ঐতিহাসিক বলিয়া খ্যাতিলাভ করিতেছেন। আর এই সমস্ত অস্পৃশ্য পুস্তক পাঠ করিয়া আমাদের বালক ও যুবকগণ “সর্বনাশের পথে” যাইতেছে।
অথচ ৩/৪ জন লেখক উঠিয়া পড়িয়া লাগিলেই এই সমস্ত ঐতিহাসিক পণ্ডিতদিগের মিথ্যাবাদিতার কাচের কেল্লা সত্যের দুই এক কষাঘাতে একেবারে চুরমার করিয়া দেওয়া যাইতে পারে। কিন্তু হায় ! আমাদের লেখকগণ ও গোটা সমাজটাই এখনও যে খাব গাফলতের কবরে শায়িত রহিয়াছে ! আরও দুই একটি ঘটনার উল্লেখ করব। পাণ্ডুয়ার মহামতি সেকেন্দার শাহ জগদ্বিখ্যাত আদিনা মসজিদ অতি বিরাট ও বিশাল। প্রাঙ্গণ শুদ্ধ ইহার ভিতরে অর্ধলক্ষ লোক নামাজ পড়িতে পারে। শাহী আমলে প্রবাদ ছিল — “আগে দেখ আদিনা পরে যাও মদিনা।” আদিনার ন্যায় বিরাট ৩৬০ গম্বুজ বিশিষ্ট মহাগ্রন্থ কোরআনের সমস্ত রচনাবলী উৎকীর্ণ বিরাট মসজিদ পৃথিবীতে আর মাত্র দুইটি প্রস্তুত হইয়াছিল। একটি কর্ডোভার জামে মসজিদ, ইহা খলিফা আবদুর রহমানের দ্বারা নির্মিত এবং ক্রমাগত যাবতীয় সুলতান এবং আমীরদিগের দ্বারা সজ্জিত ও বর্ধিত হয়; অপরটি দিগ্বিজয়ী তৈমুরলঙ্গের দ্বারা নির্মিত সমরকন্দের জামে মসজিদ। কর্ডোভার মসজিদ এক্ষণে খৃস্টানদিগের গির্জায় পরিণত। আর সমরকন্দের মসজিদে আজও জুমা-জামাত হয়।
কিন্তু অতুল ঐশ্বর্যশালী এই বিরাটকায় মজিদের অধিকাংশই ১৮৭৬ খৃ: রুশ সেনাপতি জেনারেল স্কোবেলাফ কর্তৃক কামানের গোলায় ভগ্ন ও বিধস্ত হইয়া গিয়াছে। কনস্টান্টিনোপলের মহা মসজিদ “জামে-আয়া-ছোফিয়া”ও আদিনার নিকট দাড়াইবার উপযুক্ত নহে। আমি জামে-আয়া-ছোফিয়া দেখিয়া আনন্দিত ও পুলকিত হইয়াছিলাম; কিন্তু আদিনা দেখিয়া বিস্মিত ও স্তম্ভিত হইয়াছি। আদিনা যদি আজ অক্ষুন্ন কলেবরে বজায় থাকিত তবে পৃথিবীর চারিকোণ হইতে দলে দলে লোক ইহার সোপান তলে সমাগত হইত। তাজমহল ভাস্কর্যের সুন্দর কীর্তি; কিন্তু আদিনা, ভাস্কর্যের বিপুল ও বিরাট কীর্তি। কিন্তু হায় ! বাঙ্গালার কয়টি নব্যশিক্ষিত মুসলিম যুবক আদিনার ধ্বংসাবশেষ দেখিয়াছেন? মুসলমান যুবকেরা দেখেন নাই; কিন্তু হিন্দুরা দেখিতেছেন। এই মহাকীর্তি যে দেশের মাটিতে এখনও দাড়াইয়া আছে, সে দেশের মুসলমানেরা ইহার সন্ধান পাইলে আত্মগৌরব দৃপ্ত হইয়া উঠিবে তাই হিন্দু লেখকগণ লেখনী ও ম্যাজিক লণ্ঠনের সাহায্যে আদিনাকে হিন্দুর মন্দির বলিয়া অভিহিত করিবার জন্য আদাজল খাইয়া লাগিয়াছেন।
আদিনার বহি:প্রাচীরের পাদমূলে কতিপয় হিন্দু দেবতার মূর্তি আছে। মূর্তিগুলির অকিঞ্চনতা এবং জড়ত্ব প্রতিপন্ন করিয়া সাধারণ হিন্দুদিগের মূর্তির ঈশ্বরত্ব সম্বন্ধীয় ধারণা দূর করিবার জন্যই প্রাচীরের পাদমূলে হীনস্থানে রক্ষিত হইয়াছে। একটি গণেশ মূর্তি বিশিষ্ট দ্বারের চৌকাঠের উপরের খণ্ড মহিলাদিগের উপরের তলায় উপাসনা মঞ্চে প্রবেশ দ্বারের উপরে লাগান আছে। মূর্তিটি নাক, কান কাটা। রাজ অন্ত:পুরে এবং আমীরদিগের গৃহে ইসলামে নবদীক্ষিতা অনেক হিন্দু মহিলা ছিলেন। কারণ তৎকালে উচ্চশ্রেণীর জমিদার ও করদ-রাজগণ সুন্দরী কন্যা বাদশাহ ও আমীরদিগকে উপহার স্বরূপ দান করিতেন। এইরূপে মহামতি সিরাজ উদ্দৌলাকে নিজের ভগ্নী ফৈজীকে উপহার প্রদান করিয়াছিলেন। বীরপুরুষ ও রাজদিগকে কন্যাদান করা ভারতের অতীব প্রাচীন প্রথা; মহাভারতেও ইহার অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। গণেশ হিন্দুদিগের নিত্য নমস্য দেবতা, গণেশ সর্বসিদ্ধিদাতা। অন্য দেবতার আগে গণেশের পূজা করিতে হয়। সুতরাং গণেশের প্রভাব ও গণেশের প্রতি ভক্তি হিন্দু স্ত্রীলোকদিগের মনে অপরিসীম।
ইসলামে নবদীক্ষিতা হিন্দুবংশজাত মহিলাদিগের মন হইতে গণেশের প্রতি এই অহেতুক ভক্তি ও শ্রদ্ধা দূর করিবার জন্য দরজার উপরে নাক, কান কাটা গণেশমূর্তি রক্ষিত হইয়াছিল। আশ্চর্য ব্যাপার ! এই মূর্তির যুক্তি অবলম্বন করিয়াই আদিনা মসজিদকে হিন্দুর মন্দির রূপে প্রমাণ করিবার জন্য অক্ষয় বাবু বিশেষ চেষ্টা করিতেছেন। এইরূপ তাজমহলও হিন্দু কারিগরদিগের মস্তিষ্কপ্রসূত বলিয়া ঘোষণা ও দাবী করিবার চেষ্টা হইতেছে। ৩/৪ বৎসর পূর্বে জনৈক হিন্দু লেখক এ বিষয়ে খুব জােরেশোরে ‘প্রবাসী’ পাত্রিকায় এক প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন। অবশ্য এ অধম তাহার প্রতিবাদ করিতে কুষ্ঠিত হয় নাই। আশা করি, ‘মােহাম্মদীর’ পাঠকগণের তাহা স্মরণ থাকিতে পারে। ফলতঃ বাঙ্গালী হিন্দুদিগের সহস্ৰ লেখনী এরূপভাবে রচনা জাল বিস্তার করিতে আরম্ভ করিয়াছে যে, তাহার ফলে মুসলিম-ভারতের আকাশস্পর্শী মিনার, মসজিদ, রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত আচ্ছন্ন হইয়া যাইতেছে।
কোনও কোনও হিন্দু লেখক এইরূপে দিল্লীর জগদ্বিখ্যাত কুতুব মিনারকেও পৃথ্বিরাজ কন্যার সূর্য দর্শনের স্তম্ভ বলিয়া রটনা করিতে কালি-কলমের ব্যবহারে কুষ্ঠিত হন নাই; কিন্তু উক্ত মিনার যে সুলতান কুতুবউদ্দীন কর্ত্তৃক ভারত-বিজয়ের স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ নিৰ্ম্মিত “কুওত-অল-ইসলাম” মসজিদের মিনারযুগলের অন্যতম, তাহা আমরা প্রত্যক্ষ করিয়া স্পষ্টই উপলব্ধি করিয়াছি। উহার সঙ্গে উত্তরদিকস্থ মিনারটি প্রায় একতলা পর্যন্ত গ্রথিত হইয়াছিল। কুতুবউদ্দীন এই মসজিদ ও মিনার সম্পূর্ণ প্রস্তুত হইবার পূর্বেই পরলোকগমন করেন। আজও উহা সেইরূপ অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই পতিত রহিয়াছে। এইরূপে আরও ভাস্কৰ্য-গৌরবের বহু মুসলিম-কীর্তিকে হিন্দু লেখকগণ কল্পনাবলে নিতান্ত অন্যায়ভাবে আপনাদের কুক্ষিগত করিবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছেন। মুসলমান পক্ষ হইতে কিছু মাত্র বাধা না পাওয়ায় প্রতিবাদ না হওয়ায় তাহাদের দুঃসাহস ও স্পর্ধা দিন দিন বাড়িয়াই চলিয়াছে।
অন্যদিকে ‘পার্বত্য মুষিক’ শিবাজী এবং রাণা প্ৰতাপ সিংহ হইতে আরম্ভ করিয়া রাজা কংস, রঘু ডাকাত, তাঁতিয়া ভীল, সুরেশ বিশ্বাস এমন কি হারু নাপিত ও রমা কৈবর্তের পর্যন্ত জীবনী বাহির হইতেছে। সেই সমস্ত জীবনীর পাতায় পাতায় হিন্দু গৌরব, হিন্দু বীর্য-শৌর্যের কাহিনী বেশ করিয়া কল্পনার আঁচে ফুটাইয়া তােলা হইতেছে। আর সেই সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানের কাপুরুষতা, অকৰ্মণ্যতা এবং হীনতার চিত্র যতদূর সম্ভব জাঁকাল করিয়া বর্ণনা করা হইতেছে। ইহার ফলে হিন্দুজাতীয় বালকদের মনে ক্রমশঃ তেজঃ সাহস এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হইতেছে, আর মুসলমান বালকদের মন নীচতা ও হীনতার অবসাদে দমিয়া যাইতেছে। আমাদের ছেলেদের হাতে দিবার জন্য এ পর্যন্ত কয়খানি মহাপুরুষ-জীবনী আমরা লিখিবার চেষ্টা করিয়াছি? বগুড়ার গৌরব স্তম্ভ, অকৃত্রিম সমাজহিতৈষী সুলেখক মৌলভী হামিদ আলী মরহুম সাহেব এ বিষয়ে ‘মােহসেন চরিত’ এবং ‘মুসলিম কর্মবীর চরিতমালা’ প্রকাশ করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহার সেই পুস্তক দুইখানির নূতন সংস্করণ বাহির করিবার লোকও বগুড়ায় নাই। বগুড়ার মুসলমানেরা সেই মহাপ্ৰাণ পণ্ডিতের স্মৃতিরক্ষার পর্যন্ত চেষ্টা করেন নাই।
এমন সমাজ যদি দিন দিন “গোল্লায়” না যায়, তবে আর কে যাইবে? হিন্দুরা শিবাজীর ন্যায় দস্যুপতি মারাঠির সম্বন্ধে গণ্ডায় গণ্ডায় বহি লিখিয়া এবং চিত্র বাহির করিয়া হিন্দু বালকদিগের প্রাণে বীরত্ব ও সাহস সঞ্চারের জন্য কি বিপুল চেষ্টা করিতেছে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার ! এই বাঙ্গালাদেশে কত মুসলমান বীরের জন্ম হইয়াছিল, মুসলমান সমাজ তাহার সংবাদও রাখেন না। উত্তরবঙ্গ বিজয়ী মহাবীর গাজী ইসমাইল, ত্রিপুরা বিজয়ী শমশের গাজী, নােয়াখালী ও বাখরগঞ্জ বিজয়ী কালুগাজী, হুগলী-পাণ্ডুয়া বিজয়ী শাহ সুলতান, শাহজাদপুর ও পাবনা বিজয়ী শাহ মখদুম ইয়েমেনী, বগুড়া বিজয়ী শাহ সুলতান মাহী সওয়ার, শ্ৰীহট্ট বিজয়ী শাহ জালাল, ত্রিহুত বিজয়ী নছরত শাহ, কামরূপ বিজয়ী হােসেন শাহ, চট্টগ্রাম বিজয়ী গাজী ইসলাম খাঁ ও পরাগল খাঁ, কামরূপ বিজয়ী হোসেন শাহ্, আসাম বিজয়ী মীরজুমলা, বিক্রমপুর তথা সমতট বিজয়ী বাবা আদম প্রভৃতি বীরপুরুষ, গাজী, দরবেশ ও শহীদ দিগের কয়খানি জীবন-চরিত রচিত হইয়াছে? আমাদের সন্তানদের মধ্যে কয়জনই বা এই সমস্ত প্ৰাতঃস্মরণীয় পুরুষদিগের নাম ও কীৰ্তিকলাপ অবগত আছে? আর আমরাই বা কয়জন স্বজাতি ও স্বদেশের ইতিবৃত্ত লইয়া আলোচনা করিয়া থাকি?
আমরা যদি বাঙ্গালার অতীত গৌরবের কাহিনী এবং স্বজাতীয় ও স্বদেশীয় কর্মী ও বীরপুরুষদিগের জীবনের গৌরবজনক ঘটনার গল্প ও আলোচনা করিতাম, তাহা হইলে আজ এই ভীষণ আত্মবিস্মৃতির মধ্যেও জাতীয় জীবনের ভাবি কল্যাণ ও মঙ্গলের সহস্র বিদ্যুৎস্ফূরণ দেখিতে পাইতাম। প্ৰাতঃস্মরণীয় কাজী সিরাজউদ্দীনের ন্যায় এমন নির্ভীক এবং কঠোর ন্যায়বিচারক যে বাঙ্গালার বিচারকদিগের মধ্যে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন আজ সেই বাঙ্গালার মাসিক ও সাপ্তাহিক কাগজগুলি কথায় কথায় সেই কাজীর বিচারকে উপহাস ও বিদ্রুপ করিতে কিছুমাত্র কুষ্ঠাবােধ করে না ! আর সর্বাপেক্ষা গভীর দুঃখ ও আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সেই উপহাস ও বিদ্রুপের বাক্যবাণে আমাদের মর্মের আত্মগৌরবের ভাবটি কিছুমাত্র বিদ্ধ হয় না। আর সুলতান গিয়াসউদ্দিনের ন্যায় এমন ন্যায়পরায়ণ নরপতিই বা পৃথিবীতে কয়জন জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন? পৃথিবীর আর কোনও দেশে শায়েস্তা খাঁর ন্যায় শাসনকর্তা আর একটিও খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে কি? যিনি খাদ্যশস্যের প্রাচুৰ্য সম্পাদনের জন্য ভবিষ্যৎ শাসনকর্তাদের কর্তব্যবােধকে উদ্বুদ্ধকরণার্থ এমন তােরণ নির্মাণ করিয়াছেন, প্রায় আড়াইশত বৎসর গত হইতে চলিল, কিন্তু হায় !
আজও সে দ্বার কাহারও খুলিবার মুরোদ হইল না। প্রজা হিতৈষণার ইহা অপেক্ষা জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত আর কিছু আছে কি? শায়েস্তা খাঁর এই ক্ষুদ্র তোরণের নিকট পৃথিবীর যাবতীয় কীর্তিহীন ও নগণ্য। কিন্তু হায় ! আমরা সে গৌরব কতটা অনুভব করি? আমরা যদি মানুষ হইতাম, তাহা হইলে এই নিরন্ন ও নিত্য দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত দেশে শায়েস্তা খাঁর জন্মোৎসব সম্পন্ন হইত। শায়েস্তা খাঁ যদি হিন্দু হইতেন, তাহা হইলে হিন্দুদিগের গৃহে গৃহে আজ তাঁহার পূজা হইত। ব্যভিচার দোষের জন্য একমাত্র পুত্রকে হত্যা করিতে যে মহামতি নবাব মোরশেদ কুলি খাঁ কুন্ঠিত হইয়াছিলেন না, তাহার এই পুণ্য-কথা আমরা কয়জন মনে করিয়া থাকি? মহাবীর আলীবর্দী খাঁ যেরূপ অনাহার-ক্লেশ সহ্য করিয়া দুৰ্জয় বিক্রমে, অক্লান্ত পরিশ্রমে বিধাতার অভিসম্পাত স্বরূপ, বিপুল মহারাষ্ট্র দস্যুদিগের করাল কবল হইতে বঙ্গদেশকে রক্ষা করিয়া ছিলেন, তাহা লইয়া আমরা কতটুকু আলোচনা করিয়া থাকি? পাষণ্ড রাজা কংসের অত্যাচার হইতে স্বজাতিকে রক্ষা করিবার জন্য, যে মহাতপাঃ দরবেশ শেখ নূর কুতুবুল আলম নিজ পুত্রকেও আধ্যাত্মিকভাবে হত্যা করিয়াছিলেন, সে আত্মোৎসর্গ ও স্বর্থত্যাগের কথা আমরা কখনও আলোচনা করি কি?
বাঙ্গালার যে দ্বাদশ ভৌমিকের স্বাধীনতা ও প্রতাপের কথায় বাঙ্গালার ইতিহাসের গৌরব বৃদ্ধি হইয়াছে, সেই দ্বাদশ ভৌমিক বা বার ভুঞার মধ্যে তিনজন মাত্র হিন্দু এবং নয়জন মুসলমান ছিলেন। হিন্দুরা তাহাদের এই তিন ভৌমিকের সম্বন্ধে কতই না কবিতা, গাঁথা, জীবনী, উপন্যাস ও গল্প লিখিয়াছেন, আর ঘরে ঘরে তাহা পঠিত হইতেছে। কিন্তু হায় ! আমাদের নয়জন মুসলমান ভূঞার স্বাধীনতা ও অদ্ভুত কীর্তিকলাপের বিষয় আমাদের সন্তানদিগকে অবগত করাইবার জন্য, একটি অক্ষরও রচিত হইয়াছে কি? বাঙ্গালী মুসলমানের অতীত গৌরবের কথা কত বলিব? বার ভুঞার দলপতি ঈসা খাঁ মসনদ আলী প্রবলপ্রতাপ সেনাপতি মানসিংহের সহিত দ্বৈরথ যুদ্ধের সময় মানসিংহের তরবারী ভগ্ন হইয়া যাওয়ায় মানসিংহ প্রাণভয়ে আকুল হইয়া পড়েন। কিন্তু মহাবীর ঈসা খাঁ স্বকীয় অলোকসামান্য মহানুভবতা প্রভাবে নিজের উৎকৃষ্ট তরবারী মানসিংহকে অর্পণ করিয়া তাঁহাকে আশ্বস্ত করেন। জিজ্ঞাসা করি পৃথিবীর ইতিহাসে এইরূপ অসামান্য মহানুভবতার দৃষ্টান্ত আর কয়টি আছে? হায় ! পৃথিবীর কোন বিজয়ী জাতি, বিজিত ও বিধর্মীকে এত অধিক জায়গীর, জমিদারী ও উচ্চপদ প্রদান করিয়াছিলেন? বিজিত হিন্দুর চৌধুরী, মুস্তফী, বখশী, মজুমদার, রায়, খাঁ, সরকার, খাস্তগীর, মহলানবিস প্রভৃতি অসংখ্য গৌরবসূচক উপাধিতে মুসলমানের বদান্যতার ও উদারতার স্বচ্ছ ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্তই কি প্রদর্শিত হইতেছে না? হায় ! তথাপি তাহারা হিন্দুভায়াদেৱ কর্তৃক অত্যাচারী, অবিচারী, ম্লেচ্ছ ও যবন বলিয়া অভিহিত ! ইহা তাঁহাদেৱ ঘোরতর বিদ্বেষ ও কৃতঘ্নতা নহে কি? হায় অধঃপতন ! তুমি কি এমন করিয়াই আত্মবিস্মৃত জাতির অতীত গৌরবের আলোকচ্ছটাকেও কালিমাময় ও কলঙ্কিত করিয়া তোল? হায় আত্মবিস্মৃতি ! তুমি কেমন করিয়া সিংহকে শৃগাল, বীরপুরুষকে ভীরু, মহিমান্বিতকে কলঙ্কিত, তেজদৃপ্তকে মলিন, অগ্নিকে ভস্ম, সমুদ্রকে গােস্পদ এবং পর্বতকে বল্মীকস্তূপে পরিণত কর, বাঙ্গালার মুসলমানই তাহার চরম দৃষ্টান্ত।
যে বাঙ্গালার ঢাকা, সপ্তগ্রাম, গৌড়, পাণ্ডুয়া, তাণ্ডা, দেবকোট (ঘোড়াঘাট), মুর্শিদাবাদ, রাজমহল, সোনার গাঁ প্রভৃতি বিপুল কীর্তিশালিনী মহানগরীসমূহের অসংখ্য মসজিদ, মিনার, প্রাসাদ, দুর্গ, বিদ্যালয়, পান্থশালা এবং দীঘি-পুস্করিণী মুসলিম গৌরবের অনন্ত কাহিনী আজিও ঘোষণা করিতেছে হায় ! সে দেশের বিরাট সমাজদেহের ভিতরে একটি আত্মাও কি জাতীয়তার মহিমাময়ী স্মৃতি দ্বারা উদ্বুদ্ধ হইতেছে? হায় বাঙ্গালা ! হায় মুসলমান ! তােমার গাঁথা গাহিবার জন্য একটি হৃদয়তন্ত্রীও কি বাজিয়া উঠিবে না? মুসলমান যদিও দেশকালপাত্রে আবদ্ধ নহে, তথাপি “আগে ঘরের কথা, পরে পরের কথা”এই নীতি অনুসারে প্রথমে স্বদেশীয় ও স্বজাতীয় মহাজনদিগের জীবনকাহিনী এবং কীর্তিকলাপের গৌরবগাঁথার পুলকপ্ৰদ স্পর্শে ভাবী আশার স্থল সন্তানদিগের কোমল হৃদয়তন্ত্রী ঝঙ্কৃত করিয়া তুলিতে হইবে। অতীত গৌরব ও মহত্ত্বের স্মৃতিরূপ শরণির সাহায্যেই ভবিষ্যৎ আলোকরাজ্যে অগ্রসর হইবার জন্য যথেষ্ট সাহায্য করিতে হইবে। আজকাল হিন্দু লেখকদিগের চেষ্টায় বাঙ্গালার প্রায় প্রত্যেক জেলার ইতিহাস বাহির হইয়াছে এবং হইতেছে। যেগুলি বাহির হইয়াছে, তাহা সমস্তই পাঠ করিয়াছি। তাহাতে মুসলমানের কথা যতটা থাকা উচিত ছিল, তাহার কিছুই নাই, আর থাকিতেও পারে না।
বিজিত জাতি বিজয়ী জাতির ইতিহাস ও গৌরবগাঁথা কখনও প্রাণ খুলিয়া লিখিতে পারে না। তাহাতে যে তাহার প্রাণে আঘাত লাগে। বিশেষতঃ শৃগালের হস্তে সিংহের চিত্র অঙ্কিত করিতে দিলে সে সিংহ শৃগালের তুলিকায়ই চিত্রিত হইবে। এ জন্য বঙ্গীয় মুসলমানদিগের একটি সাহিত্য সভা ও কতিপয় উপযুক্ত লাইব্রেরী বা কুতুবখানা গঠিত হওয়া আবশ্যক। আর সেই সাহিত্য-সভা হইতে একটি ঐতিহাসিক মন্ডলী নির্বাচন করিয়া সকলের সমবেত চেষ্টায় বঙ্গদেশের মুসলমানদের বহুখণ্ড বিশিষ্ট একখানি বিরাট ইতিহাস লিখিত হইবে। প্রত্যেক জেলা, পরগণা, মহকুমা ও প্রাচীন পল্লী হইতে মালমশলা সংগ্ৰহ করিতে হইবে। সেই মালমশলার সহিত “সিয়ের-উল-মুতআখখেরিন”, “রিয়াজ উছ-ছালাতিন”, “ফেরেস্তা”, “আইন-ই-আকবরী”, “খোরশেদ-ই-জাহানামা”, “তাবাকাত-ই-আকবরী”, “তারিখ-ই-ফিরোজশাহী”, “তবকাতে নাসিরী” এবং “তারিখে-বাঙ্গালা” প্রভৃতি গ্রন্থ হইতে ইষ্টকাদি পাইয়া বাঙ্গালী মুসলমানের জন্য এক বিরাট ও মনোহর ইতিহাসের তাজমহল গড়িতে হইবে। সেই ইতিহাসের তাজমহলই বঙ্গীয় মুসলমান সন্তানদের মনে আত্মগৌরব ও আত্মপ্রতিষ্ঠার ভাব প্রাণের ভিতরে জাগাইয়া তুলিবে॥” —