ভাসানী স্মরণে- মারুফ কামাল খান
একজন কলামিস্ট হিসাবে “মারুফ কামাল খান ” এর লেখাগুলি বেশ ভালো লাগে, তার ফেইজবুক পেইজ থেকে মাওলানা ভাসানী সম্পর্কিত লেখাটি হুবহু তুলে ধরলাম;
মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী তাঁর জীবদ্দশায় কেবল বাংলাদেশ বা এই উপমহাদেশের নয়, দীর্ঘকাল ধরে খ্যাত ছিলেন আফ্রো-এশিয়া-লাতিন আমেরিকার মজলুম মানুষের সংগ্রামে প্রেরণার দীপশিখা হিশেবে।গণমানুষের সেই কালজয়ী মহান নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে তাঁর ওফাত বার্ষিকীর প্রাক্কালে আজ স্মরণ করি পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। ১৯৭৬ সালের ১৭ নবেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন।
পশ্চিমী দুনিয়ার গণমাধ্যম তাঁকে ‘ফায়ার ইটার’ অর্থাৎ অগ্নিভূক, ‘রেড মওলানা অব দ্য ইস্ট’ অর্থাৎ প্রাচ্যের লাল মওলানা ইত্যাকার বিশেষণে চিত্রিত করলেও তিনি স্টকহোমে আফ্রো-এশীয় শান্তি-সন্মেলনে সভাপতিত্ব করেছেন। বিশ্ববিশ্রুত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের সঙ্গে যৌথবিবৃতি দিয়েছেন যুদ্ধবাদিতার বিরুদ্ধে। টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করেছে; দিয়েছে ‘প্রোফেট অব ভায়োলেন্স’ বা সহিংসতার পথপ্রদর্শক তকমা। তবে নির্যাতীত মানুষ বরাবরই তাঁকে শ্রদ্ধা করে এসেছে উৎপীড়নবিরোধী সংগ্রামের মহানায়ক হিশেবেই।
আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি -ন্যাপ; দু’টি রাজনৈতিক দলের তিনি প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ন্যাপের তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তান শাখা বিলুপ্ত করলে এই দলের নেতা-কর্মীদের নিয়েই জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তান পিপলস পার্টি গঠন করেছিলেন। মওলানার ইন্তেকালের পর বাংলাদেশে ভাসানী ন্যাপ বিলোপ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপির মূল রাজনৈতিক স্রোতধারা তৈরি হয়। ভাসানী ন্যাপের ধানের শীষ হয় বিএনপিরও নির্বাচনী প্রতীক।
তরুণ বয়সের শুরুতেই আমাদের এই অঞ্চলের কৃষক-প্রজাদের নিয়ে সামন্ত-জমিদার বিরোধী লড়াই চালিয়ে, আসামে ‘বাঙ্গাল খেদা’ নামের জনগোষ্ঠীগত হিংস্রতা রুখে দিয়ে এবং কুখ্যাত লাইন প্রথাবিরোধী সংগ্রামের পুরোভাগে থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে তিনি উপমহাদেশে সূচিত খেলাফত আন্দোলনের পথ বেয়ে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন-বিরোধী স্বাধীনতার সংগ্রামে উঠে আসেন নেতৃত্বের কাতারে। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে কংগ্রেস ও পরে মুসলিম লীগ নেতৃত্বের প্রথম সারিতেই শামিল ছিলেন তিনি।
পাকিস্তান আমলে আমাদের জাতীয় চেতনা ও সাংস্কৃতিক বিকাশের তিনিই ছিলেন প্রথম তূর্যবাদক। বাঙলা ভাষা ও সংষ্কৃতির বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকদের বৈরিতার বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রাম গড়ে তোলেন। ভাষা আন্দোলনকে দুর্নিবার করে তোলার পাশাপাশি তিনি বাংলা সাহিত্য-সংষ্কৃতি বিষয়ক সন্মেলন আয়োজন করেন। একজন জননেতার এমন ভূমিকা এই জনপদের ইতিহাসে অনন্য। মওলানা ভাসানীই প্রথম পাকিস্তানি শাসনের নিগড় ছিন্ন করতে ঐতিহাসিক ‘আসসালামু আলাইকুম’ উচ্চারণ করেন কাগমারীর ইতিহাসখ্যাত সন্মেলনে। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টাই শুধু নন, বরং এই রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনের পথপ্রদর্শকও ছিলেন। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনাকারী প্রবাসী সরকারের সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতিও ছিলেন তিনি।
স্বাধীনতার পরেও আমাদের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা, জনগণের অধিকার রক্ষা এবং জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় নিরলস সংগ্রাম করে গেছেন মওলানা ভাসানী। তদানীন্তন আওয়ামী সরকার এ কারণে তাঁর পত্রিকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি মওলানা ভাসানীর কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে তাঁকে গৃহবন্দী করে রাখে। জীবন সায়াহ্নে এসেও ভারতের কাছ থেকে গঙ্গা নদীর পানিতে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে তিনি ঐতিহসিক ফারাক্কা লংমার্চের ডাক দেন এবং এতে নিজে সশরীরে নেতৃত্ব দেন।
মহানবী(সা.)-র সাম্যবাদী সাহাবী হযরত আবু জর গিফারী(রা.)-র ‘রবুবিয়ত’-এর দর্শনে গভীরভাবে আস্থাশীল ছিলেন মওলানা ভাসানী। তাঁর জীবনের ব্রত ছিল খেলাফতে রাব্বানী অর্থাৎ বিশ্বপ্রভুর প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্রীয় সমাজ প্রতিষ্ঠা। মানুষের সেবা ও নিজের জীবনাদর্শ প্রচারের লক্ষ্য নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন খোদায়ী খিদমতগার সমিতি। জীবনের বিভিন্ন সময়ে তিনি জনপ্রিয় বিভিন্ন পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করেছেন। উন্নত শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে আধুনিক সাচ্চা মুসলিম গড়ে তোলার লক্ষ্যে স্থাপন করেছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সহ নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তবে সাম্প্রদায়িকতা ছিল তাঁর দু’চোখের বিষ। ধর্মের নামে বিভেদ, হানাহানি, উগ্রতা, কুসংষ্কার ও গোড়ামীকে প্রশ্রয় দেননি তিনি কখনোই। ইসলামের সাম্যবাদী ভাবাদর্শ ও সমাজবাদী দর্শনের সংমিশ্রণে একটি শোষণহীন-সাম্য-মৈত্রীর সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল এই লোকায়িত জননায়কের আজন্মলালিত স্বপ্ন। মওলানা ভাসানী শতাব্দিব্যাপ্তপ্রায় তাঁর জীবনকালে বিশ্বের খ্যাতনামা রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিক, স্বাধীনতা সংগ্রামী, দার্শনিক, সমাজ সংষ্কারক ও সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনের দিকপালদের সঙ্গে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। শোষণ, পীড়ন, সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ছিল তাঁর প্রাণপণ লড়াই। খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের পোশাক পরে, মাটির শানকিতে কৃষকের খাদ্য খেয়ে, গ্রামের পর্ণ কুটিরে বাস করেও তিনি ছিলেন দুর্বিনীত শাসকদের ত্রাস। তাঁর ডাকে পঙ্গপালের মতো লাখ লাখ মানুষ নেমে আসতো ঘর ও কর্মস্থল ছেড়ে পথে। কবি শামসুর রাহমান তাঁর বিখ্যাত ‘সফেদ পান্জাবী’ কবিতায় জনসমুদ্রে ভাষণদানরত মওলানার আন্দোলিত হাত “বল্লমের মতো ঝলসে ওঠে বারবার” বলে বয়ান করেছেন। মজলুম এই জননেতার ‘খামোশ’ আওয়াজে কেঁপে উঠেছে জালিমের সিংহাসন।
১৯৭৬ সালে মহাপ্রয়াণের আগে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে তিনি অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছেন। তাঁর অসমাপ্ত কাজ এগিয়ে নেবার ভার দিয়ে জিয়াউর রহমানের হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি তাঁর আদর্শের পতাকা।
ক্ষমতাকে তুচ্ছ করা এই মহান জনগণমন অধিনায়কের পূণ্যস্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই তাঁর ওফাত বার্ষিকীর প্রাক্কালে। তাঁকে স্মরণ করি হৃদয়মথিত অকৃত্রিম ভালোবাসায়। বাংলাদেশে শোষণ-বঞ্চনা ও জুলুম-পীড়নমুক্ত, সামাজিক ইনসাফভিত্তিক সাম্য-মৈত্রী-শান্তির একটি সমাজ গড়তে পারলেই কেবল মওলানা ভাসানীর প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো হবে।