পরিচ্ছন্ন রাজনীতির বরপুত্র তারেক রহমান
:: কামরুল আহসান নোমানী ::
২০০৪ সালের ২৭ জানুয়ারী। গভীর রাত। টুঙ্গিপাড়ায় বিএনপির প্রতিনিধি সম্মেলন শেষে ক্লান্ত তারেক রহমান সার্কিট হাউজে গেলেন বিশ্রাম নেওয়ার জন্যে। একটু পরেই তাঁর ঢাকা ফেরার কথা। ফেরার প্রস্তুতি চলছে। তারেক রহমান গাড়িতে উঠে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। আচমকা সবাইকে অবাক করে দিয়ে গাড়িবহর উলটো দিকে চলা শুরু করলো। তারেক রহমানের সঙ্গে থাকা বিএনপির ততকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক আমান উল্লাহ আমান, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুসহ গাড়িবহরের সাথে থাকা অন্যান্য নেতারা হকচকিয়ে গেলেন। তারা কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেননা। কোথায় যাচ্ছে কেউ জানেনা। প্রশ্নের জবাবে তারেক শুধু মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘আমরা এক জায়গায় যাবো’। ব্যাস এতটকুই। গভীর রাতে গাড়ি গিয়ে থামলো শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিস্থলে। এতক্ষণের সাসপেন্সের অবসান হল। সবাইকে অবাক করে দিয়ে তারেক রহমান গাড়ি থেকে নেমে আসলেন। সমাধিস্থলের খাদেমকে ঢেকে তুললেন। সাথে থাকা নেতা কর্মীদের নিয়ে শেখ মুজিবর রহমানের কবর জিয়ারত করলেন তিনি।
১/১১ থেকে শিশুরা এই রটনায় বড় হয়ে উঠছিলো যে তারেক রহমান হলেন বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় খলনায়ক। তারেক রহমান গণতন্ত্রের, সুশাসনের সবচেয়ে বড় শত্রু। হাওয়া ভবন ছিলো যত্তসব হাঙ্গামার উৎস। তারেককে ঘিরে বলিউডি সিনেমার কায়দায় গল্প তৈরি করা হলো, রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রচারমাধ্যম ব্যবহার করে সেই গল্প ছড়িয়ে দেওয়া হলো। গণতন্ত্র বিনাশের সেই কালো প্রহরে তারেক-গীবত হয়ে উঠেছিলো লিভিং স্পেসের নিয়মিত ঘটনা। মঈন উদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকারের ছত্রছায়ায় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তার বানানো সব কাহিনী লাল কালিতে শিরোনাম হচ্ছিলো প্রতিটা দৈনিকে। কিন্তু আজ এই সত্য দিনের আলোর মতই স্পষ্ট যে, সেদিনের সেইসব অভিযোগ মোটেও তথ্যভত্তিক অথবা প্রামাণিক ছিলোনা। সেগুলো ছিলো স্রেফ তারেক রহমানের চরিত্র হননের চেষ্টা। ইরাকের উপর হামলা করার জন্যে আমেরিকা যেমন বিশ্ববাসিকে ‘উইপ্যান্স অব ম্যাস ডেসট্রাকশান’ বা কথিত রাসায়নিক মারনাস্ত্রের জুজু বুঝিয়েছিলো, তারেকের ক্ষেত্রেও এরকমটাই ঘটেছলো। তারেক যেন উইপ্যান্স অব ম্যাস ডেসট্রাকশান! একটার পর একটা দুর্নীতির অভিযোগ।
বাংলাদেশের কদর্য আর কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে কয়টা সুন্দর দৃশ্য আছে তার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরতম দৃশ্যটির জন্ম হলো তারেক রহমানের হাত ধরে।
রাজনৈতিক অঙ্গনে ওই সময় এরকম প্রশংসনীয় একটি ঘটনা মিডিয়ায় সেইভাবে আসেনি। কারণ তখন ওই ঘটনাটি ছিলো টপ সিক্রেট। তারেক রহমান যখন শেখ মুজিবের কবর জিয়ারত করতে যান তখন তাঁর সাথে এমনকি কোন মিডিয়াকর্মীও ছিলোনা। তারেক প্রচার চাননি, তিনি এমনকি এই ঘটনা নিয়ে কোন রাজনীতিও করতে চাননি।এই হলেন তারেক রহমান।
তারেক রহমানকে আমি প্রথম সামনাসামনি দেখি খুব সম্ভবত ২০০৪ সালে। উনি তখন সাংগঠনিক সফরে পুরো দেশ চষে বেড়াচ্ছেন। তৃণমূলের কর্মীদের প্রশিক্ষণের উপর জোর দিয়েছিলেন তিনি। সারাদেশের কর্মীদের নিয়ে একটা ডাটাবেজ তৈরি করার ইচ্ছেও ছিলো তাঁর। এটা নিয়ে কাজও এগিয়েছিলো অনেকদূর। তারেক রহমান তাঁর বাবার মতই বিশ্বাস করতেন প্রশিক্ষিত কর্মীরাই হচ্ছে দলের মূল সম্পদ। এরকম একটা সফরেই আমাদের উপজেলাতে এসেছিলেন তিনি। তাঁর আগমন উপলক্ষ্যে পুরো উপজেলা জুড়ে সাজসাজ পড়ে গেল। সেইদিন দেখেছিলাম তারেক রহমানের জনপ্রিয়তা, তাঁকে একনজর দেখার জন্যে পুরো উপজেলার মানুষ বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মত হামলে পড়েছিলো।
তারেক রহমান যখন স্টেজে এলেন আমি তাঁকে দেখে চমকে গেলাম। এ কেমন যুবরাজ! পত্রপত্রিকায় তখন যুবরাজ শব্দটি বেশ প্রচলিত ছিলো। শব্দটা তাচ্ছিল্য অর্থে ব্যবহৃত হত বলাই বাহুল্য। তারেকের গায়ে দেরদেরে একটা জামা। আমার ক্ষীণ সন্দেহ হল জামাটা বোধয় ঠিকঠাক ইস্রি করাও হয়নি। প্যান্টের অবস্থাও খুব একটা সুবিধার না। কিন্তু পোশাকের এই মলিনতা ছাপিয়ে উঠেছিলো তাঁর প্রখর ব্যক্তিত্ব। বক্তব্য দেওয়ার সময় খেয়াল করলাম মানুষটা নীচু স্বরে কথা বলে। আমরা রাজনৈতিক বক্তব্য যেরকম শুনতে অভ্যস্ত, মাইরা ফালামু, কুইট্টালামু, হোতায়ালামু… তারেকের বক্তব্য মোটেও সেরকম কিছু নয়। প্রতিটা শব্দ মেপে মেপে বলেন। পুরো বক্তব্য জুড়ে বিরোধীদলের প্রতি একটাও হুমকি ধামকি নেই। কোন সমালোচনা নেই। অথচ আওয়ামীলীগ তখন রাজপথ দাবীয়ে বেড়াচ্ছে।
উনি শুধু উনার স্বপ্নের কথা বললেন, কি রকম বাংলাদেশ চান সেটা বললেন, তৃণমূলের কাছে উনার কি প্রত্যাশা সেটা জানালেন। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনলাম। আমি সেদিনই প্রথম জানলাম, রাস্তার ক্যানভাসারদের মত গলাবাজি না করেও শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধের মত আটকে রাখা যায়। আটকে রাখার এই ক্ষমতাটা তারেকের আছে। বেশ প্রবলভাবেই আছে। সহজাত নেতৃত্বগুণের যে ব্যাপারটা আমরা শুনি তারেক রহমান সেটার সবচেয়ে ভালো বিজ্ঞাপন।
সম্ভবত এই ক্ষমতাটাই কাল হয়েছিলো তারেকের জন্যে। পাঁচটা বছর ধরে গোয়েবলসীয় কায়দায় পরিকল্পিত প্রোপাগান্ডা চালানো হয়েছিলো তাঁকে নিয়ে। এই ষড়যন্ত্র পূর্ণতা পেয়েছিল ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন সরকারের সময়।
১/১১ থেকে শিশুরা এই রটনায় বড় হয়ে উঠছিলো যে তারেক রহমান হলেন বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় খলনায়ক। তারেক রহমান গণতন্ত্রের, সুশাসনের সবচেয়ে বড় শত্রু। হাওয়া ভবন ছিলো যত্তসব হাঙ্গামার উৎস। তারেককে ঘিরে বলিউডি সিনেমার কায়দায় গল্প তৈরি করা হলো, রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রচারমাধ্যম ব্যবহার করে সেই গল্প ছড়িয়ে দেওয়া হলো। গণতন্ত্র বিনাশের সেই কালো প্রহরে তারেক-গীবত হয়ে উঠেছিলো লিভিং স্পেসের নিয়মিত ঘটনা। মঈন উদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকারের ছত্রছায়ায় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তার বানানো সব কাহিনী লাল কালিতে শিরোণাম হচ্ছিলো প্রতিটা দৈনিকে। কিন্তু আজ এই সত্য দিনের আলোর মতই স্পষ্ট যে, সেদিনের সেইসব অভিযোগ মোটেও তথ্যভত্তিক অথবা প্রামাণিক ছিলোনা। সেগুলো ছিলো স্রেফ তারেক রহমানের চরিত্র হননের চেষ্টা। ইরাকের উপর হামলা করার জন্যে আমেরিকা যেমন বিশ্ববাসিকে ‘উইপ্যান্স অব ম্যাস ডেসট্রাকশান’ বা কথিত রাসায়নিক মারনাস্ত্রের জুজু বুঝিয়েছিলো, তারেকের ক্ষেত্রেও এরকমটাই ঘটেছলো। তারেক যেন উইপ্যান্স অব ম্যাস ডেসট্রাকশান! একটার পর একটা দুর্নীতির অভিযোগ।
একটা অভিযোগ তো খুবই মজার ছিলো। তারেক নাকি চারশ স্যুটকেস ভর্তি ডলার সৌদি আরবে পাচার করেছিলেন! অভিযোগের জিজ্ঞাসাবাদে তারেক তদন্তকারী কর্মকর্তাদের বলেছিলেন, একটি ডিসি-১০ বিমানের কার্গো হোল্ডে কত স্যুটকেস আঁটে অথবা একজন যাত্রী কত স্যূটকেস নিয়ে যেতে পারে- সে সম্পর্কে তদের কোন ধারণা আছে কিনা। তারেকের প্রশ্ন শুনে তদন্ত কর্মকর্তারা পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছিলেন। তাদের কাছে কোন জবাব ছিলোনা।
তারেক বরাবরই শান্ত প্রকৃতির ছিলেন। ২০০৭ সালের ৭ মার্চ রাতে তারেক যখন গ্রেফতার হচ্ছিলেন তখনও তিনি ছিলেন শান্ত। অকম্পিত কন্ঠে পরিচিত এক সাংবাদিককে ফোন করে বলেছিলেন, ওরা আমাকে নিতে এসেছে। আমি কোন অপরাধ করিনি। আমার জন্যে দোয়া করবেন। এরপর দু রাকাত নফল নামাজ আদায় করলেন। মা বেগম খালেদা জিয়া তখন অঝোর ধারায় কাঁদছেন। নিস্ফল প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছেন।
গ্রেফতারের পর ইন্টারোগেশনের নামে তারেকের উপর অবর্নণীয় নির্যাতন চালানো হয়। একটা শাস্তি ছিলো এরকম, ছাদের সাথে দড়ি দিয়ে বেধে বারবার তারেককে শক্ত মেঝের উপর ফেলে দেওয়া হত। খুবই পরিকল্পিতভাবে ঠান্ডা মাথায় তারেকের কোমড়ের হাড় ভেঙে দেওয়া হয়। পরে তারেক একটা সাক্ষাতকারে স্বগক্তির মত করে বলেছিলেন, ‘কেন আমার উপর এত নির্যাতন হলো? কত তদন্তই তো হলো; কিছুই তো প্রমাণ হলোনা। অথচ অত্যাচারের কারণে সারাজীবন আমাকে পঙ্গুত্ব আর অসহ্য বেদনা বয়ে বেড়াতে হবে।’
তারেকের এই স্বগোক্তির জবাব দিতে পারবা বাংলাদেশ?
তারেক রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে উড়ে এসে জুড়ে বসেননি। তারেক রহমান মা মাটি ও দেশকে বুকে আঁকড়ে ধরে বড় হয়েছেন। বাংলাদেশের প্রতিটা মানুষের দরদ অনুভব করেছেন, কষ্ট দেখেছেন, না খাওয়া মানুষের আহাজারি শুনেছেন। গ্রামের কৃষকদের সাথে কাজ করে অনুভব করেছেন কি পরিশ্রম কৃষক করছে। তাঁর বাবার মতই বাংলার খোলা আকাশের নীচে কঠোর রোদ, বৃষ্টি উপেক্ষা করে মানুষ এবং দেশকে জানতে দেশের এইপ্রান্ত থেকে ওইপ্রান্ত ছুটে বেড়িয়েছেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি যে ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে তার পেছনে ছিলো তারেকের নিরলস পরিশ্রমের গল্প। বেগম খালেদা জিয়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পুস্পদল সংগ্রহ করেছেন আর তারেক সেই পুস্পদলের মালা গাঁথার চেষ্টা করেছেন। কখনও তিনি সফল হয়েছেন, কখনও তিনি সফল হননি, কিন্তু তার এই প্রয়াসকে তুচ্ছ করা সম্ভব নয়।তারা তারেক রহমানের মেরুদন্ডের হাড় ভেঙ্গে দিতে পেরেছে কিন্তু তারেক রহমানকে মচকাতে পারেনি। দেশ থেকে, নিজের মমতাময়ী মা থেকে দূরে আছেন বহুদিন, আদরের একমাত্র ছোটভাইয়ের কবরে একমুঠো মাটি দিতে পারেননি। তারেক গুমরে কেঁদেছেন, কিন্তু মচকাননি। তারেকরা মচকায়না। তারা লড়ে যায়।
হ্যাঁ তারেক রহমান সত্যিকার অর্থেই একজন নেতা, তিনি পরিচ্ছন্ন রাজনীতির বরপুত্র। একদিন যিনি এই দেশকে জিয়াউর রহমানের মতো তাঁর সোনালী স্পর্শে বদলে দিবেন। আর এই দেশটাও তাঁর প্রতীক্ষাতেই রয়েছে প্রায় এক যুগ ধরে। সেইদিন আর খুব বেশী দূরে নয় যেদিন তারেকের চওড়া কাঁধে চড়ে বাংলাদেশ তার হৃত স্বার্বভৌমত্ব ফিরে পাবে। আমি স্বপ্ন দেখি।
শুভ জন্মদিন লীডার!