বঙ্গভবনের সেই দিনগুলো – ১
মোখলেসুর রহমান চৌধুরী: ২০০৭ সালের ২২শে জানুয়ারির নির্ধারিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সকল দল অংশ নিয়েছিল। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটও সেই নির্বাচনে অংশ নেয়। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এখন এ বিষয়ট বর্ণনা করার কারণ কি? হ্যাঁ, অবশ্যই কারণ আছে।
যারা সংবিধান অনুযায়ী দায়িত্ব পালনকারী ২০০৬-২০০৭ইং এর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছিলেন তাদের জন্য এই উত্তর দিতে হচ্ছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে সেই নির্বাচন হলো না কেন? সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মনোয়য়ন বাতিলের ঘটনা ছিল এখানে ট্রাম্পকার্ড। এ ঘটনাই প্রধান বিরোধী দলকে নিবাচন বর্জন করার সুযোগ করে দেয়। রির্টানিং অফিসাররা দেশের পাঁচটি নির্বাচনী এলাকায় জেনারেল এরশাদের মনোনয়ন বাতিল করার কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতি সৃষ্টির সুযোগ আসে। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি যাতে নির্বাচনটি হয় এবং সকল সকল দলের অংশগ্রহনের ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দিন-রাত কাজ করেছি। প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত হিসেবে আমি প্রেসিডেন্টের উপদেষ্ট দুই নেত্রীর সঙ্গে আলদাভাবে একান্ত বৈঠক করে সমস্যা সমাধানের কাছাকাছি উপনীত হই। পরে সেনারগাঁও হোটেল কমপ্লেক্সে প্রধান বিরোধী দলেল দাবিনামা নিয়ে বসে সমাধানযোগ্য বিষয়গুলো নির্ধারণ করি ক্রমাগত তিন দিন বৈঠক করে।
মনোয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন সর্বশেষ আরও দু’দিন বাড়ানোর জন্য আওয়ামীলীগ থেকে বার বার দাবি জানানো হচ্ছিল। বলা হয়েছিল, এটিই তাদের শেষ দাবি। এর আগে একটি দাবি মানতেই আরেকটি দাবি দেয়া হচ্ছিল। তাই আর দাবি মানার ব্যাপারে অনেকের আপত্তি ছিল। কিন্তু আমরা সকল দলের অংশগ্রহনের মাধ্যমে নির্বাচন করতে কাজ করছিলাম। এইচএম এরশাদ মনোনয়নপত্র বাড়ানোর দাবির এই অবস্থায় অর্থাৎ মনোয়নপত্র প্রত্যাহার প্রথমে নির্ধারিত তারিখের আগের রাতে প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের কাছে তিনবার ফোন করেছিলেন। কাজী জাফর আহমদ করেছিলেন দু’বার। প্রেসিডেন্ট বিভিন্ন প্রোগ্রাম, খাওয়া ও চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে ব্যস্ত ছিলেন। পরে যখন রিং ব্যাক করা হলো তখন জেনারেল এরশাদ বললেন, মনোয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ তারিখ আর বাড়ানোর প্রয়োজন নেই।
আওয়ামীলীগ নির্বাচন বর্জন করলেও আমরা নির্বাচন করবো। সারা দেশের সব নির্বাচনী এলাকায় এ জন্যই আমাদের আলাদা প্রাথী দেয়া আছে। কিন্তু আমরা সকলেই চাচ্ছিলাম ১৯৮৮ বা ১৯৯৬ এর ১৫ই ফেব্রুয়ারী মতো নির্বাচন না করতে। সকল দলের অংশগ্রহনে নির্বাচন করতে। ওই রাতে বঙ্গভবনে দুজন উপদেষ্টা মাহবুবুল আলাম ও ড. শোয়েব আহমদ উপস্থিত ছিলেন। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে উপদেষ্টাদের নিয়মিত চা-চক্রের অংশ হিসেবে তারা এসছিলেন। এছাড়া, মনোয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন বাড়ানোর দাবির পক্ষেও তারা কথা বলছিলেন।
অনেক ত্যাগ ও কষ্টের বিনিময়ে যে আওয়ামী লীগকে আমরা নির্বাচনে নিয়ে এসেছিলাম সেই শ্রম সফল করতে ওই রাতেই আমরা মনোনয়নপত্রও জমা দেয়ার শেষ তারিখ দু’দিন বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলাম। আওয়ামী লীগ এ সিদ্ধান্তে খুশি হয়েছিল। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আমরা নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করে এভাবে নির্বাচনের তারিখ বার বার পেছাচ্ছিলাম আওয়ামী লীগের দাবি মানতে গিয়ে। কিন্তু রিটানিং অফিসারদের মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের সময় এরশাদের মনোনয়নপত্র বাতিল করার ঘটনা এসব উদ্যোগ আয়োজন তছনছ করে দেয়। চারটি আসনে রটানিং অফিসার ছিলেন ডিসি। তারা একই রকম সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। আর ঢাকায় রিটার্নিং অফিসার ছিলেন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার। ঢাকায় এরশাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্থাৎ মনোনয়ন গ্রহণ বা বাতিল-এ ব্যাপারে সুস্পস্ট সিদ্ধান্ত ছাড়াই প্রথমে কাগজ পাঠানো হয়েছিল নির্বাচন কমিশনে। ইতিমধ্যে সিলেট, হবিগঞ্জ, রংপুর ও নীলফামারী থেকে রিটার্নিং অফিসারদের পাঠানো সিদ্ধান্ত ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রচারিত হচ্ছিল। নির্বাচন কমিশন ঢাকার রিটার্নিং অফিসারকেই তখন সিদ্ধান্ত দিতে বলেছিল। অন্যান্য রিটানিং অফিসারের সিদ্ধান্ত ফলো করা হয় তখন। এরশাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে আমরা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দফায় দফায় কথা বলেছিলাম কিন্তুতারা বিধির উল্লেখ করে বলেছিলেন, এ বিষয়ে রিটানিং অফিসারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। নির্বাচন কমিশনের কিছু করা নেই। পরে যথারীতি জেনারেল নির্বাচন কমিশনে আপিল করেছিলেন এবং বিধি অনুযায়ী তা খারিজ করে দেয়া হয়।
রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে আমরা একেবারে নিম্ন পযায়েও কোন হস্তক্ষেপ করিনি। ডিসি ইউএনও কোন পর্যায়েই নয়। আমরা চেয়েছিলাম প্রশাসন স্বাধীনভাবে কাজ করবে। কিন্তু সেদিন কেন এবং কিভাবে এ ঘটনা ঘটেছিল সে প্রশ্নে র উত্তর আজও খুঁজে পাইনি। কেবল দাবির পর দাবিই নয়, রাজনৈতিক সংকট সমাধানে আমরা এমন সব দায়িত্ব পালন করেছি যার ফিরিস্তি হবে অনেক লম্বা। যেমন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া একদিন রাতে ফোন করে পরের দিন রাতে প্রেসিডেন্টের প্রোগ্রাম চেয়েছিলেন। চারদলীয় জোটের যেসব নেতা তার সঙ্গে থাকবেন তিনি তাদের নামের তালিকাও দিয়েছিলেন। পরদিন রাত সাড়ে ৯ টায় তার ওই প্রোগ্রাম কনফার্ম করে দিয়েছিলাম। সামরিক-বেসামরিক সংশ্লিষ্ট সকল পর্যায়ে ওই প্রোগ্রাম চলে গিয়েছিল। পরদিন সকালে আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একই দিন সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান। মহাজোটের নেতৃবৃন্দ যারা তার সঙ্গে থাকবেন যথারীতি তাদের তালিকাও দেন। ওই দিন সারাদিন প্রেসিডেন্টের প্রোগ্রাম ছিল এবং রাতে দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রোগ্রাম যুক্ত হওয়াররপর ফুরসত নেয়ার সময় ছিল না। কিছুদিন আগে গুরুতর অসুস্থ অবস্থা থেকে আরোগ্য লাভকারী প্রেসিডেন্টের ওপর এভাবে চাপ দেয়ার বিরুদ্ধে তার মেডিকেল বোর্ড ক্ষুব্ধ ছিল। শেখ হাসিনা যখন ফোনে সময় চাচ্ছিলেন তখনই আর কোন প্রোগ্রামের জন্য সময় দেয়া মেডিকেল বোর্ডের বারণ ছিল কঠোরভাবে। কিন্তু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে সম্মান করে প্রোগ্রাম দিয়ে ফেলেছিলাম। কিছুক্ষন পর তিনি জানতে চান ওই দিন রাত সাড়ে ৯টায় বেগম জিয়ার সঙ্গে প্রেসিডেন্টের কোন প্রোগ্রাম আছে কিনা? আমি হ্যাঁসূচক জবাব দিলে বলা হয়, তাকে ওই সময় দিতে এবং বেগম জিয়াকে সময় সন্ধ্যা ৭টায় (যে সময় শেখ হাসিনাকে দেয়া হয়) নিয়ে আসতে। বেগম খালেদা জিয়াকে এ বিষয়ে অনুরোধ করলে, তিনি বলেন, আমিতো আগের দিন রাতে সময় নিয়েছি। তাহলে প্রোগ্রাম বাদ দিন। এখন দু’দিক থেকেই সমস্যা হলো। দুটি প্রোগ্রামই বাদ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। একাদিকে রাজনৈতিক সংকট সমাধানের চেষ্টা, অন্যদিকে এই ইগো সঙ্কট এবং প্রশাসনিক কাযক্রম তো রয়েছেই- বলা চলে আমাদেরকে সারাক্ষণ স্নায়ুচাপের মধ্যে রেখেছল। প্রটোকল অনুযায়ী ইমিডিয়েট পাস্ট প্রাইম মিনিষ্টার বা সদ্য প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সম্মান করতে গিয়ে ওই দিন সময় দেয়া হয়। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত দুই নেত্রীর সঙ্গে এ নিয়ে যোগাযোগ করে বরফ গলাতে চেষ্ট করেছিলাম। বিভিন্ন পর্যায়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কেবল বলছিলেন, স্যার আপনি তাদেরকে বুঝিয়ে একটা ব্যবস্থা করুন। অথচ প্রটোকল অনুযায়ীও ইমডিয়েট পাষ্ট পিএম শেষে সময় পান। ২০০১ সালে এ রীতি অনুসরণ করে শেখ হাসিনাকে সব শেষে সময় দেয়া হয়। যা হোক শেষ পর্যন্ত বেগম জিয়া রাজি হন। স্বল্প সময় হাতে নিয়ে তিনি চারদল নেতৃবন্দকে নিয়ে সন্ধ্যা ৭টায় বঙ্গভবনে আসেন। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এ বৈঠক শেষ হতেই সাড়ে ৯ টায় বৈঠকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট নেতৃবৃন্দ আসেন। উপদেষ্টা এবং প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হিসেবে আমি যোগ দিই। শেখ হাসিনা প্রোগ্রামের সময় নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের জন্য আমাকে ধন্যবাদও দিয়েছিলেন।
আমাদের সময় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেল মোট ১৪ জন। একপর্যায়ে চারজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করলে তাদের শূন্যস্থান পূরণে আরও চারজন উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়া হয়। তাদের সকলের সঙ্গেই আমার সুসম্পর্ক ছিল। তারা দেখেছিল রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে কিভাবে রাত দিন নিরলস পরিশ্রম করেছিলাম। বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার দর্ঘদিনের ব্যক্তিগত সুসম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে দুই নেত্রীর সঙ্গে আমার যোগাযোগ এবং সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টাকে সরকারের উপদেষ্টারাও এপ্রিসিয়েট করছিলেন। আমি তাদেরকে আলাদাভাবে যার যার মতো যোগাযোগ করতে বলি। ফলাফল ছিল একই। আমাদের মধ্যে সমস্বয়ের কোন সমস্যা ছিল না। দুই নেত্রীর সঙ্গে একান্তভাবে বসা এবং শেখ হাসিনার মনোনীত ও দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে বসে নির্বাচন করার স্বার্থে একটি সমাধানে উপনীত হওয়ার পর্যায়ে এসে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টা পরিষদকে সময়ে সময়ে অগ্রগতি অবহিত করতাম।
আমাদের সামনে ছিল সংবিধান নির্ধারিত দুটি পথ। একটি দেশে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান। আর অপরটি No Policy decision সরকারের day to day affair অর্থাৎ কেয়ারটেকার হিসেবে রুটিন দায়িত্ব পালন করা। সংবিধানের ১২৩ ও ৫৮ ধারা ও এসব ধারার উপধারাসহ মিলিয়ে আমরা সামনে অগ্রসর হচ্ছিলাম।
রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা হচ্ছেন দেশ পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত। জনগণের ভোটে তারা ক্ষমতায় আসেন। প্লেয়ার ছাড়া যেমন খেলা হয় না তেমন রাজনতিবিদদের অংশগ্রহণ করতে না দিলে নির্বাচন হবে না। এ মূলনীতি সামনে রেখে আমরা রানীতিকদের সঙ্গে সমঝোতার লক্ষ্যে কাজ করছলাম। যারা এ দেশে হাওয়া ভবন বানাতে মূল দায়িত্ব পালন করলেন এবং পরবর্তীতে বিএনপি থেকে সরে গেলো তারা আমাকে হাওয়া ভবনের এজন্ট, গুপ্তচর ইত্যাদি আখ্যা দিলেন। অথচ আমি হাওয়া ভবনে কখনও যোগাযোগ করিনি এবং হাওয়া ভবন থেকেও আমার সঙ্গে কখনও যোগাযোগ করা হয়নি। দুই নেত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারাও করেছেন। এসব নির্বাচন অনুষ্ঠান ও সঙ্কট সমাধানের জন্যই করতে হয়েছে। আমি যা কিছু করেছি প্রকাশ্যে, গোপনে নয়। কিছু মিডিয়া প্রচার করেছে আমি নাকি মোবাইল ফোনে মিটিংয়ের কথোপকথন ধারণ করে পাচার করেছি। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফ্রি ফ্লো অব ইনফরমেশনের যুগে ট্রান্সপারেন্সির জমানায় কোন কিছুই গোপনীয় ছিল না। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও কোন গোপন মিটিং করতে বঙ্গভবনে আসতেন না। যা আলোচনা হতো সব দু’পক্ষের বক্তব্য হিসেবে প্রেসে যেতো। ব্রিফ্যিং দেয়া হতো। যে সমস্ত বিষয় আলোচনা হয়নি এমন সব অবান্তর ইস্যু কিছু কিছু মিডিয়ায় তখন স্থান পেয়েছে।
প্রেসিডেন্ট যখন প্রধান উপদেষ্টা হন তখন তাকে দায়িত্ব পালনের সহযোগিতার জন্য উপদেষ্টার প্রয়োজন হয়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা দায়িত্ব পালনকালে সরকার প্রধানের উপদেষ্টা ছিলেন সালাহ্ উদ্দিন কাদের চৌধুরী (মন্ত্রী), অধ্যাপিকা জাহানারা বেগম (প্রতিমন্ত্রী), রিয়াজ রহমান (প্রতিমন্ত্রী), বরকত উল্লাহ বুলু (প্রতিমন্ত্রী), ও মাহমুদুর রহমান (উপমন্ত্রী), ডা. এসএ মালেক (মন্ত্রী), এম আনিসুজ্জামান (মন্ত্রী), খোন্দকার আসাদুজ্জামান (মন্ত্রী) ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (পদমর্যাদা দেয়ার কথা ছিল) প্রেসিডেন্ট যখন প্রধান উপদেষ্টা অর্থাৎ একসঙ্গে রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান তখন এতজন কিংবা ডাবল উপদেষ্টা না নিয়ে রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী এমনকি আইন মন্ত্রণালয়, এটর্নি জেনারেলসহ সংশ্লিষ্ট সকল পর্যায় থেকে ভেটিং করে একজন উপদেষ্টা নিয়েছিলেন। এটাকে না বুঝে অনেকে গুলিয়ে ফেলেছিলেন। অবশ্য ড. আকবর আল খান মিডিয়াকে তখন একাধিকবার এ প্রসঙ্গে সুষ্পষ্ট বক্তব্য দিয়ে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট যতজন ইচ্ছা উপদেষ্টা নিতে পারেন এবং অতীতেও নেয়া হয়েছে এবং কাজের স্বার্থে এটা প্রয়োজন। উপদেষ্টা হিসেবে মন্ত্রীর পদমর্যাদা দেয়ার কথা থাকলেও আমি প্রতিমন্ত্রী হিসেবেই রাজি হই। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ ও মহাজোট নেতৃবৃন্দের সামনে বঙ্গভবনে আমাকে দেখে কনগ্র্যচুলেশনস বলে বলেছিলেন, হোয়াই স্টেট মিনিষ্টার, হোয়াই নট ফুল মিনিষ্টার ? কিন্তু আওয়ামী লীগের কিছু নেতা আমার বিরুদ্ধে নানা বক্তব্য দয়ে যাচ্ছিলেন।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক কারণে প্রেসিডেন্ট বানালেও তার হাত দিয়ে ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। আবদুর রহমান বিশ্বাসকে একইভাবে বিএনপি প্রেসিডেন্ট বানালে তার হাত ধরে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। বিএনপি’র মনোনীত প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আমাকে উপদেষ্টা বানানোর কারণে আমাকে বিএনপি ধরা হলো কেন – সেটি আমার প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচন সুষ্ঠ, অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে আমরা কাজ করেছি কিনা। বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন দেশে কেয়ারটেকার সরকার নেই। কিন্তু আমাদের দেশে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের কারণে সংবিধানে এ সরকারের ঠাঁই হয়েছে। এরপরও অবিশ্বাস থেকে আমরা মুক্ত হতে পারিনি। ২০০৭ সালের ২২ শে জানুয়ারির নির্বাচন নিরপেক্ষ হতো এবং বড় দল দু’টির যে কোনটিই ক্ষমতায় আসতে পারতো। কিন্তু এ বাস্তবতা ও এ ক্ষেত্রে গহীত সকল কার্যক্রমকে নস্যাৎ করা হয়েছে কিছু রাজনীতকের অবিমৃস্যকারিতার কারণে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন ১৯৯১ সালে অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনকালে বলেছিলন No body is neutral কিন্তু যার যার কাজটা নিরপেক্ষভাবে ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে করতে হবে। এটাই হচ্ছে বিধান।
প্রেসিডেন্ট একজন ব্যাক্তি নন, একটি ইন্সটটিউশন। এটি দেশের সর্বোচ্চ ইন্সটটিউশনও বটে। প্রেসিডেন্টের নাম বিকৃত করাসহ বিভিন্নভাবে এই ইন্সটিটিউশনকে অসম্মান পর্যন্ত করা হয়েছে। আমি শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ইন্সটিটিউশনকে উর্দ্ধে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
বিএনপি মহাসবিচ ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পর্যায়ে সংলাপ শেষ পর্যন্ত ৩১ দফা থেকে এক দফায় পরিনত হয়েছিল। বলা হয়েছিল, বিচারপতি কে. এম. হাসান চলে গেলেই হবে। বিচারপতি হাসান অপারগতা প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও আবদুল জলিলের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্বল্পমত সময়ে তাদেরকে প্রেসিডেন্টের সামনে হাজির করি। জনাব জলিল কেয়ারটেকার সরকার প্রশ্নে সংবিধানের ৬টি অপশন প্রসঙ্গে বললেন, প্রেসিডেন্ট তো আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। তিনি দায়িত্ব নিলে তো আমরা বেশি খুশি হবো। কারণ তিনি অসুস্থ হলে তো তাকে বাদ দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল এবং আমরাই তার পক্ষে সোচ্চার হয়েছিলাম। বঙ্গভবনের গেটে টিভি ক্যামেরাগুলোর সামনে তিনি তখন গিয়ে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ মহামান্য প্রেসিডেন্ট রাজি হয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিতে। সঙ্কটের সমাধান হয়ে যাবে। ধানমন্ডিতে গিয়ে মটিং করে বললেন, মানি না। অথচ প্রেসিডেন্ট বলেছিলের সদ্যসাবেক দুজন প্রধান বিচারপতি সদ্য সাবেক আপিল বিভাগের দুজন সিনিয়র বিচারপতি বিভিন্ন কারণে দায়িত্ব নিতে না পারায় অর্থাৎ চারটি অপশন এক্সজস্টেড হওয়ায় পঞ্চম অপশন অনুযায়ী আপনারা দু পক্ষ একমত হোন। তারা প্রকমত হতে না পারলে ষষ্ট ও শেষ অপশন অনুযায়ী আই কুড অপার মাইসেলফ। দেশের স্বার্থে আমি অসুস্থতা থেকে কিছুদিন আগে মোটামুটি সুস্থ হলেও এ দায়িত্ব নিতে পারবো। দুজন প্রধান বিচাপতির মধ্যে বিচারপতি কেএম হাসানের পর ছিলেন বিচারপতি মাইনুর রেজা চৌধুরী। তিনি তখন মাত্র কিছুদিন আগে ইন্তেকাল করেছেন। আর দুজন সিনিয়ার বিচারপতির মধ্যে প্রথম ছিলের বিচারপতি এম এ আজিজ। যিনি সদ্য আপিল বিভাগ থেকে অবসর নিয়েছেন এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। অবশ্য আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলো তাকে মানছিল না। এমনকি প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবেও আপত্তি করছিল।
এরপর আসে বিচারপতি হামিদুল হকের নাম। তাকে বিএনপি সরকার বিচার প্রশিক্ষন ইন্সটিটিউটের চেয়ারম্যান করেছিলেন। অবসরের পর লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকা অযোগ্যতার মধ্যে পড়ে। তারপরও তিনি লিখিত দিয়েছিলেন এক পক্ষের আপত্তির কারণে তিনি প্রধান উপদেষ্টা হতে সম্মত নন। পঞ্চম অপশনে বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী প্রসঙ্গ এসেছিলেন। মান্নান ভূঁইয়া তার জোটের পক্ষ থেকে আপত্তি করে বলেছিলেনকে এম হাসানের ব্যাপারে যে কারণে আপনাদের আপত্তি একই কারণে এখানে আপত্তি আছে। কে এম হাসানের দায়িত্ব গ্রহনের বিষয়টি নিদিষ্ট ছিল। আর পঞ্চম অনুযায়ী সকল দলের কাছে গ্রহনযোগ্য হলে মাহমুদুল আমিন হতে পারতেন। তথাপি জনাব চৌধুরীর সঙ্গে এব্যাপারে যোগাযোগ করলে তিনি বলেছিলেন কেবল সকল পক্ষ একমত হলেই আমি দায়িত্ব নেবো।
সমস্যা সমাধানে দুই নেত্রীকে একসঙ্গে বসাতে চেয়েছলাম। প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে কিভাবে ছুটিতে পাঠানো হলো- ইত্যাদি ঘটনা বণনা করা যাবে। তবে আমাদের আমলে আমরা কিভাবে সমাধান করেছি বিশেষ করে নির্বাচনে সকল দলকে আনা পর্যন্ত এসব বলতে আমি রাজি হয়েছি। নির্দোষ বিষয় প্রকাশ করতে অসুবিধা নেই। তবে অনেক মিডিয়ার অনুরোধ উপরোধ উপেক্ষা করতে পারলেও পারিনি জনাব মতিউর রহমান চৌধুরীর উপর্যুপরি আন্তরিক অনুরোধ ফেলে দিতে। তবে একট জায়গায় আমরা একগ্রত হয়েছি যে, আমরা গত অসমাপ্ত নিবাচন পযন্তই থাকবো। সে সময় পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ন সুন্দর ঘটনাগুলো তুলে ধরার উদ্দেশ্যেই এই আয়োজন। সারা জীবন সততার সঙ্গে আমার দায়িত্ব পালনের ঘটনাবলী যারা আমাকে কাছে থেকে দেখেছেন তাদের কাছে নতুন করে বলার নেই। প্রেসিডেন্টের প্রেস সচিব থাকাকালে আল্লাহর অসীম রহমতে বঙ্গবভনের শতবর্ষ ও Hundred Years of Bangabhaban নামে দুটি বই প্রকাশ, প্রেসিডেন্টের অসুস্থতাকালে তার মুখপাত্র হিসেবে প্রেস ফেস করা এবং সবোপরি প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হিসেবে ঐতিহাসিক মুহুর্তে দায়িত্ব পালনের স্মৃতিময় ঘটনাগুলো সম্পর্কে এ দেশের মানুষের জানার আগ্রহ, কৌতুহল এবং সবচেয়ে বড় কথা এ ব্যাপারে জনগনের জানার অধিকারটি আমার আছে গুরুত্বপূর্ণ। এ দেশে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সফর ও ব্রিগেডয়ার জেনারেল শাবাব আশফাক হত্যা – ইত্যাদি ঘটনার সময় সাংবাদিক হিসেবে আমার দায়িত্ব পালনের স্মৃতির ঘটনা অনেকে জানেন।
আমি প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা থেকে পদত্যাগ করার পর একটি পত্রিকায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বেশকিছু নিয়োগ, রদবদল ইত্যাদি নিয়ে লেখা হয় এবং যেখানে এসব ঘটনার জন্য আমাকে দায়ী করা হয়। কিন্তু এসব ঘটনা দেখে আমি অবাক ও বিস্মিত হই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সকলেই হেসেছেন। পরে এগুলোর তদন্ত হয়েছে। আমি পত্রিকাটির সম্পাদকের সঙ্গে কথা বললে তিনি অনুযোগের সূরে বলেন, চার-পাঁচদিন নাকি তিনি আমাকে ফোন করেছেন এবং কথা বলতে পারেন নি। এ জন্য এটি লেখা হয়েছে। আমি বললাম সত্য-মথ্যা যাচাই করে নিলে তো পারতেন।
সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুযায়ী সংবাদে আক্রান্ত ব্যক্তির বক্তব্য নেয়া তো বাধ্যতামূলক। এক পত্রিকায় মোখলেস চৌধুরী মিন্টো রোডের লাল বাড়িতে শিরোনামে নিউজ ছেপেছিল। মন্ত্রী বা উপদেষ্টা হিসেবে বরাদ্দপ্রাপ্ত বাড়িতে থাকা আমার কোন অপরাধ ছিল কিনা জানি না। আমি ওমরাহ হজ করে আসার কারণে মাথায় টুপি দিতে হয়েছিল। এই টুপি দেয়ার ছবিও বিকৃত করে একটি পত্রিকা ছেপেছিল। মন্ত্রী বা উপদেষ্টারা বিভিন্ন আবেদন সুপারিশ করেন। এমন একট বই সরবরাহের আবেদনে সুপারিশ করার কারণে ইচ্ছামতো লেখা হয়েছে। এডিসি ইউএনওরা জবাব দিয়ে বলেছেন, উপদেষ্টা এ ধরনের সুপারিশ করতে পারেন। তবে কোন হস্তক্ষেপ করেননি এবং দরখাস্তে কাজও হয়নি। আরেকট দরখাস্তে সুপারিশ করার জন্য অনেক তদন্ত হয়েছে। Honesty is the best policy, এমন জীবন তুমি করিবে গঠন, মরনে হাসিবে তুমি, কাঁদিবে ভুবন ইত্যাদি বানী ছোটবেলা থেকেই আমাকে ওই ভাবে গড়ে উঠতে ভূমিকা রেখেছে। টাকা পয়সার প্রতি আমার কখনোই কোন লোভ ছিল না। Simple living and light thinking এই নীতিমালা আমাকে জীবনের এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। জীবনের একটি বড় অংশ ইতিমধ্য কাটিয়ে দিয়েছ। তবে আমার সততা নিয়ে শক্ররাও প্রশ্ন করতে পারবে না।
অনেক তদন্ত হওয়ায় আমি খুশি হয়েছি। আমি কেমন সংশ্লিষ্টদের তা জানা দরকার। আমি শক্ররও ক্ষতি করি না। কেবল বিশ্বাস করি, পরম করুনাময় আল্লাহ তা’আলা মঙ্গলের মধ্যে অমঙ্গল ও অমঙ্গলের মধ্যে মঙ্গল নিহিত রেখেছেন- যা আল্লাহই জানেন, আমরা জানি না। সব সময় মাটির সঙ্গে মিশে চলার চেষ্টা করেছি। মানুষের সেবা করার ব্রত নিয়ে কাজ করছ। সাংবাদিকতার নীতিমালার অনুযায়ী No rumour will be news এ কথাটি সংশ্লিষ্ট সকলকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। হিংসা-প্রতিহিংসা, মানুষের ক্ষতি করা, কাউকে cut to size করা সাংবাদিকতার ধর্ম নয়। Journtlism এর পরিবর্তে অনেকে Sensationalism করেন। Black-mail করেন। এতে সাংবাদিকতা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। দেশ ও জাতির স্বার্থে Responsible Jaurnalism অত্যন্ত জরুরি।