পটুয়াখালীর ঐতিহ্যবাহী হোটেল রুচিতার ৪৭ বছরের ইতিহাস
এহসানুল কবির রিপন: ‘হোটেল রুচিতা’ পটুয়াখালী শহরের একটি সুপরিচিত নাম। শহরের নতুন বাজারের এই প্রতিষ্ঠানটি জেলাব্যাপী মানুষের পরিচিত। ৪৭ বছর পার হয়ে ৪৮ এ পড়েছে এর বয়স। হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা হাবিবুল হোসেন অালম তখনকার টগবগে যুবক থেকে এখন সিনিয়র সিটিজেন। রুচিতার শুরুর সাথে তার জীবনের গল্পও উঠে এসেছে অাজ গল্পের ফাঁকে তার মুখ থেকে।
যেভাবে হোটেল রুচিতার যাত্রা শুরু:
হাবিবুল হোসেন অালম ভাই ছিলেন চরপাড়া নিবাসী ডিসি কোর্টের সাবেক জেলা নাজির মরহুম হাকিম মিয়ার মেঝ ছেলে। ১৯৭১ সনের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে যান তখন মাত্র ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছেন। তৎকালীন বরগুনা মহাকুমার বুকাবুনিয়া এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা দলের সাথে ছিলেন। ৮ ডিসেম্বর পটুয়াখালী মুক্ত হওয়ার চারদিন পর ১২ ডিসেম্বর সন্ধ্যারাতে শহরে প্রবেশ করেন। চরপাড়ার বাসায় ঢোকার পর তার বাবা মরহুম হাকিম মিয়া জড়িয়ে ধরে কিছু পরামর্শ দেন। এর অাগে অালম ভাই ও তার অারেক ভাই মুক্তিযুদ্ধে যাবার অপরাধে তার বাবাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো পাক হানাদার বাহিনী। ৮ ডিসেম্বর পটুয়াখালী মুক্ত হওয়ার পর তিনি ছাড়া পেয়েছিলেন। এর অাগে তার গুলির অর্ডারও হয়েছিলো। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় সে অর্ডার কার্যকর করার অাগেই পাক বাহিনী পটুয়াখালী ত্যাগ করেন।
যুদ্ধে থেকে অাসার পর অালম ভাই নিজেকে সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে ফেলছিলেন। একাকী ঘুরছিলেন। এ অবস্থায় ১৯৭২ সনের একদিন জেলা অাওয়ামী লীগ কার্যালয়ের (বর্তমানে প্রেসক্লাব কার্যালয়) সামনে দিয়ে হেটে যাচ্ছিলেন। এমন সময় সেখানে বসা ছিলেন পটুয়াখালী সদরের সাবেক সংসদ সদস্য মরহুম হাবিবুর রহমান হাবিব মিয়া ও অামতলীর সংসদ সদস্য মরহুম নিজাম উদ্দিন তালুকদার। নিজাম তালুকদার ডাক দিলেন অালম ভাইকে। অালম ভাই ভিতরে যাওয়ার পরে কুশল বিনিময়ের এক পর্যায়ে যোগাযোগ না রাখার জন্য অনুযোগ করলেন। এক পর্যায়ে ব্যবসার পরামর্শ দিলেন এবং পথ দেখালেন।
তখন ডিসিকোর্ট ভবনের তৃতীয় তলার পশ্চিম পাশে একটি ক্যান্টিন ছিলো। সেটি অাগে কালিকাপুরের মোতাহার খন্দকার চালাতেন। নিজাম এমপি তৎকালীন জেলা প্রশাসক অাবদুল অাউয়াল সাহেবের সাথে দেখা করে ক্যান্টিনটি অালম ভাইকে পরিচালনার অনুমতির ব্যবস্থা করে দেন। অালম ভাইর বাবা মরহুম অাবদুল হাকিম মিয়া ছিলেন তখন জেলা নাজির। তিনি চাননি তার ছেলে হোটেল ব্যবসা করুক। ডিসির অনুমতি সত্বেও তিনি ছেলেকে চাবি দিতে গড়িমসি করছিলেন। পরে নিজাম এমপিই তার কাছ থেকে চাবি নিয়ে অালম ভাইকে দিয়েছিলেন। এদিকে বাসায় অালম ভাইর মা বুঝিয়ে স্বামীকে ম্যানেজ করেন। শুরু হয় অালম ভাইর হোটেল ব্যবসা। ডিসি কোর্টের ক্যান্টিনে সকাল সাড়ে অাটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত রমরমা বেচাকেনা হত। প্রতিদিন গড়ে সাড়ে তিনশ টাকা ছিলো বিক্রি। প্রতি প্লেট বিরিয়ানী বিক্রি হত দুই টাকায়। ভালই চলছিলো ক্যান্টিন।
এক বছর পরে ১৯৭৩ সনে বাবুর্চির পরামর্শে নতুন বাজারে হোটেল ব্যবসা শুরু করেন। মায়ের কাছ থেকে পাওয়া ৩২৫ টাকার পুঁজি নিয়ে হোটেল রুচিতার যাত্রা শুরু। কিছুদিন পর ছেড়ে দেন ডিসি কোর্টের ক্যান্টিনটি। অাজকের যে হোটেল রুচিতা, ওই ঘরের মালিক ছিলেন নারায়নগঞ্জের কালাই মির্জা ও তার ভাতিজা বাদশা মির্জা। রুচিতা হোটেল হওয়ার অাগে সেখানে গেঞ্জির দোকান ছিলো। এক পর্যায়ে ঘরের মালিকরা জায়গা বিক্রি করতে চাইলে অালম ভাইর নিজের অতটাকা না থাকায় তার তিন মামার নামে ১২ হাজার টাকায় কেনার ব্যবস্থা করে দেন। পরে তিনি ১৮ হাজার টাকা দিয়ে ওই প্লট নিজের নামে করে নেন। সেই থেকে চলছে হোটেল রুচিতা। অালম ভাই পটুয়াখালী চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রির সভাপতিও ছিলেন। সেই দিনের টগবগে যুবক ব্যবসায়ী অাজ ৭৩ বছরের সিনিয়র সিটিজেন। তবে তার স্মার্টনেস চলাফেরা এখনও বহাল রয়েছে। শুভ কামনা প্রিয় এই মানুষটির জন্য।
পটুয়াখালীর প্রাচীন হোটেল হিসেবে রুচিতা দ্বিতীয়। এর অাগে মাত্র একটি হোটেল প্রাচীন হিসেবে এখনও টিকে অাছে। সেটা হল কাঠপট্টি মুকুল সিনেমা মোড়ের শাহীন হোটেল। যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন লোয়ালিয়ার মরহুম মজিবর রহমান সিকদার। এটি চালু হয় স্বাধিনতার অাগে।