উন্নয়নের চাবিকাঠী-মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক
শৃঙ্খলাহীন জীবন মাঝিবিহীন নৌকার মত। মাঝিবিহীন নৌকা যেমন স্রােতের টানে যত্রতত্র পরিচালিত হয়, ঠিক শৃঙ্খলাহীন স্বেচ্ছাচারী মানুষ ধ্বংসের পথে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায়। কিন্তু মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। সভ্যজাতি মাত্রই শৃঙ্খলাবদ্ধ। তাই অন্যান্য প্রাণী থেকে মানুষের পার্থক্য হলো যে, মানুষ বুদ্ধিমান ও নিয়ম-শৃঙ্খলার প্রতি পরম শ্রদ্ধাশীল। এই গুণের ফলশ্রুতিতেই মানুষ স্মরণাতীতকাল থেকেই সমাজ গঠন করে একত্রে পরম আনন্দে ও শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে অভ্যস্ত। সমাজ জীবনে যেমন ব্যক্তিগত জীবনেও তেমনি মানুষের জন্য নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাবোধের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। জীবন চলার পথে প্রতিটি কাজের সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন বিদ্যমান। সে নিয়মকেই বলা হয় শৃঙ্খলা। সুশৃঙ্খলাই জীবনকে সুন্দর, গতিশীল ও সার্থক করে তোলে। বিশ্বর সমস্ত কিছু এক অদৃশ্য নিয়ম ও শৃঙ্খলার অধীন। যেমন, সৌরজগতের গ্রহ-উপগ্রহ থেকে পৃথিবীর গাছপালা, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীটপতঙ্গ একটি নির্দিষ্ট নিয়ম-শৃঙ্খলায় নিয়ন্ত্রিত। কোথাও এর সামান্যতম ব্যতিক্রম বা বিপর্যয় নেই। শৃঙ্খলা হলো উন্নতির চাবিকাঠি যা প্রক্রিয়াকে সমন্বয় করার নিমিত্তে বাধ্যতামূলক অনুসরণীয়। মানব জীবনে বেশ প্রয়োজন সেই নিয়মের শাসন।
জীবনকে সুন্দর ও উন্নত করে গড়ে তুলতে শৃঙ্খলাবোধের একান্ত প্রয়োজন। কারণ, শৃঙ্খলাই সৌন্দর্য ও জাতীয় উন্নতির একমাত্র উপায়। শৃঙ্খলা ছাড়া মানব জীবন চলতে পারেনা। বিভিন্ন সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক, সামাজিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি সব কিছুই নিয়ম-শৃঙ্খলা অনুযায়ী হয়ে থাকে। নিয়ম-শৃঙ্খলা না থাকলে সমাজে চরম আকারে শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘিœত হয়। তাই নিয়ম-শৃঙ্খলা সমাজ জীবনের জন্য এক অপরিহার্য বিষয়। শৃঙ্খলাই সমাজকে সুন্দর ও সার্থক করে তোলে। আর শৈশবকালই হচ্ছে মানব জীবনে প্রবেশের সিংহদ্বার। কাজেই শৈশবের সূচনা লগ্নেই শৃঙ্খলা ও নিয়মানুশীলনের শিক্ষা গ্রহণ একান্ত জরুরি। মানব জীবনে শ্রেষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে চাই নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলাবোধের নিখুঁত ও আন্তরিক অনুশীলন। কঠিন নিয়মের বাঁধনে বাঁধতে না পারলে পরিবারে ভাঙ্গন ধরে, সমাজ টেকেনা, রাষ্ট্র পর্যন্ত বিপর্যস্ত হয়, প্রতিষ্ঠান অচল হয়ে পড়ে। শৈশব থেকে প্রতিটি মানুষকে সমাজে বিচরণ করতে হয় বিধায় গ্রহণ করতে হয় নানা সামাজিক দায়িত্ব। কিন্তু সমাজের প্রতিটি মানুষ যদি খেয়াল-খুশিমত যথেচ্ছাচার শুরু করে, তাহলে সমগ্র সমাজটাই উচ্ছৃঙ্খলতার উন্মাদাগারে পরিণত হতে বাধ্য। সামাজিক জীবনে শৃঙ্খলা বিধান অপরিহার্য। সে ক্ষেত্রে মা-বাবার দায়িত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্র জীবনেও শৃঙ্খলাবোধের যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ, ছাত্র জীবন মানব জীবনের উৎকৃষ্ট সময়। এ সময়ই যথাযথভাবে জীবন গঠন পূর্বক পরবর্তীকালে যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠার উৎকৃষ্ট সময়। কেননা ছাত্রদেরকে ভবিষ্যতে দেশ ও জাতির গঠনমূলক কার্যের ভার গ্রহণ করতে হবে।
ছাত্রজীবনে যারা শৃঙ্খলা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে সে জীবনে উন্নতি লাভ করতে পারবে। তাই ছাত্রদেরকে মেনে চলতে হয় কঠোর নিয়ম ও শৃঙ্খলা। শিক্ষাঙ্গনে নিয়ম-শৃঙ্খলার প্রয়োজনীয়তা অধিক। শিক্ষার্থীদের শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান থাকা একান্ত প্রয়োজন। নিয়ম-শৃঙ্খলার গন্ডীর মধ্যে ছাত্রদের চলার পথকে গৌরবোজ্জ্বল করে ও সফলতা এনে দেয়। শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা না থাকলে সুশিক্ষা ও জ্ঞানের পরিধি বিস্তার করা অসম্ভব। অবশ্য সব ছাত্রেরই মেধা একরকম থাকেনা, আবার আর্থিক সামর্থও সকলে এক রকম থাকেনা, কিন্তু ছাত্র যদি নিয়মনিষ্ঠ জীবন যাপন করে, শিক্ষা ক্ষেত্রে যদি উপযুক্ত শৃঙ্খলা মেনে চলে, জীবন যাপনেও যদি তার সঠিক প্রয়োগ করে তাহলে ছাত্ররাও ভবিষ্যতে শ্রেষ্ঠ নাগরিক ও শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিকরূপে গড়ে ওঠবে। যে সকল ছাত্র-ছাত্রী সর্বদাই নিয়ম-শৃঙ্খলার প্রতি চরম উদাসীন এবং নিয়মিত পড়াশুনা করেনা, তাদেরকে জীবনভর অনুতাপের অনলে তিলে তিলে দগ্ধ হতে হয়। তাই বিদ্যালয়ের সকল নিয়ম-শৃঙ্খলা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা প্রতিটি শিক্ষার্থীদের পবিত্র দায়িত্ব।
নিয়ম-শৃঙ্খলা শিক্ষার অনুকরণীয় মাধ্যম হচ্ছে জীবজগত। যেমন-পাখিরা সকালে ওঠে কলগান করে, রাত্রে বিশ্রাম নেয়। মৃদুমন্দ বাতাসের পরশে নদীর বুকে কলতান শুরু হয়, আবার বায়ুপ্রবাহ বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে নদীর বুক শান্ত হয়ে যায়। মৌমাছি ও পিপীলিকা প্রভৃতি ক্ষুদ্র প্রাণিদের মাঝেও নিয়ম-শৃঙ্খলার কোনই ব্যতিক্রম দেখা যায় না। তাছাড়া, বনের হরিণ, ভেড়া ও অন্যান্য প্রাণি দলবদ্ধভাবে তাদের নিজ নিজ দলনেতার আদেশ পালন করে। একটা কাককে যদি কেউ আঘাত করে কিংবা হত্যা করে তখন সকল কাক দলবদ্ধভাবে এর তীব্র প্রতিবাদ করে। আবার শীতকালে অতিথি পাখি দলবদ্ধভাবে আমাদের দেশে উড়ে আসে কিন্তু শীত শেষে শৃঙ্খলার সহিত একইভাবে নিজ দেশে উড়ে যায়। সামান্য পিঁপড়া ও মৌমাছিরাও সুশৃঙ্খলভাবে একতাবদ্ধ হয়ে মিলেমিশে শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করে। কাজেই আমরা পশুপাখি ও ক্ষুদ্র প্রাণির জীবন যাত্রার প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি থেকেও অনায়াসে নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার শিক্ষা অনায়াসে গ্রহণ করতে পারি। কাজেই জীবন চলার প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের শৃঙ্খলাবোধ ও নিয়মানুবর্তিতার প্রতি অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় সজাগ থাকতে হবে অন্যথায় ব্যথাহতচিত্তে জীবনভর পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করতে হবে। এ পৃথিবীতে যাঁরা বড় হয়েছেন, প্রাতঃস্মরণীয় হয়েছেন, তাঁরা জীবন চলার সর্বক্ষেত্রে কঠোরভাবে শৃঙ্খলা ও নিয়মনীতি পালন করেছেন। সে জন্য নিয়ম শৃঙ্খলাহীন মানুষ বা জাতি কোনোদিন উন্নতির শিখরে আরোহণ করতে পারে না। আমাদের সবার জীবনকে সফল ও স্বার্থক করে গড়ে তুলতে শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন একান্ত প্রয়োজন।