মত প্রকাশের স্বাধীনতা সেন্সর করতে করোনা মহামারি ব্যবহার করেছে বাংলাদেশ: হিউম্যান রাইটস ওয়ার্চ
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তার বার্ষিক প্রতিবেদন ‘ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট ২০২১’-এ বলেছে, মুক্ত মত প্রকাশকে সেন্সর করতে এবং সমালোচকদের দমনপীড়নের অজুহাত হিসেবে করোনা মহামারিকে ব্যবহার করেছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। এতে আরো বলা হয়েছে, করোনা মহামারিতে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ অথবা ক্ষমতাসীন দলের সমালোচনা করাসহ বিরুদ্ধে যারাই কথা বলেছেন, তারা সাংবাদিক, আর্টিস্ট, ছাত্রছাত্রী, ডাক্তার, বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য ও অধিকারকর্মী যা-ই হোন না কেন, তাদেরকে গ্রেপ্তার করেছে কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্রাড এডামস বলেছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২০২০ সালে দেখিয়ে দিয়েছে যে, তাদের কর্তৃত্ববাদী নিয়ন্ত্রণের কব্জায় সবকিছু রাখতে সবই বন্ধ করে দেবে। এমনকি বৈশ্বিক এই মহামারির সময়েও। যেসব কার্টুনিস্ট এবং কিশোর ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীকে সমালোচনা করেছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে তাদের বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া বন্ধ করা উচিত। পক্ষান্তরে মহামারির মধ্যে তাদের নিজেদের কর্তৃত্ব যেভাবে নিয়ম লঙ্ঘন করেছে তা নয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ৭৬১ পৃষ্ঠার এই বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বুধবার। এটি তাদের এমন ৩১তম প্রকাশনা।
এতে বিশ্বের কমপক্ষে ১০০ দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়েছে। এতে ২০২০ সালে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশ অংশে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বেশ কিছু গণধর্ষণের ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা দেয়। এর ফলে নারী ও বালিকাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক সহিংসতার দিকে দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। এসব অপকর্মে জড়িতরা বাংলাদেশে মাঝেমাঝেই দায়মুক্তি পেয়ে যায়। করোনা মহামারির লকডাউনের সময়ে গৃহসহিংসতা বৃদ্ধির অনেক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে বেসরকারি গ্রুপগুলো। এক্ষেত্রে অধিকারকর্মীরা বাস্তবসম্মত সংস্কার দাবি করেছেন। সেসব আহ্বান শোনার পরিবর্তে সরকার তড়িঘড়ি করে একটি সংশোধনী অনুমোদন করেছে। তাতে ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন করা হয়েছে।
নিউইয়র্ক ভিত্তিক এই মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন বলেছে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যকর্মীরা রিপোর্ট করেছেন যে, পর্যাপ্ত পরিমাণ পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্টের (পিপিই) অপর্যাপ্ততা রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগও তুলেছেন তারা। যারা করোনা মহামারিকালে এসব নিয়ে কথা বলেছেন সেইসব স্বাস্থ্যকর্মীর কন্ঠকে স্তব্ধ করে দিয়েছে সরকার। সেন্সর করা হয়েছে মিডিয়া। গ্রেপ্তার করা হয়েছে। করোনা ভাইরাস নিয়ে ‘গুজব’ ছড়ানোর অভিযোগে নজরদারি থেকে দমনপীড়ন বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, নিপীড়নমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে নাটকীয়ভাবে গ্রেপ্তার বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে পোস্ট দেয়ার পর তাকে অবমাননার অভিযোগে একটি শিশুকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। করোনা ভাইরাস বিস্তারের থেকে সুরক্ষার জন্য জেলখানা থেকে কমপক্ষে ২৩ হাজার বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এর মধ্যে ওইসব ব্যক্তি নেই, যারা ক্ষমতাসীন দলের সমালোচনার জন্য বন্দি আছেন।
ওই রিপোর্টে আরো বলা হয়, জোরপূর্বক গুমের বেআইনি চর্চার অভিযোগ অব্যাহতভাবে প্রত্যাখ্যান করে চলেছে বাংলাদেশ। ইউএন ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপেয়ারিন্সেস, ইউএন কমিটি এগেইনস্ট টর্চার এবং ইউএন হিউম্যান রাইটস কমিটি যেসব উদ্বেগ তুলে ধরেছে তার প্রতিও অবজ্ঞা দেখানো হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, প্রায় পুরোপুরি দায়মুক্তির অধীনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযুক্ত। পুলিশ যখন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা মেজর সিনহা রাশেদ খানকে হত্যা করে, তখন এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে জোর দিয়ে সব সময় ‘ক্রসফায়ার’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে তড়িঘড়ি করে সেই ‘ক্রসফায়ার’ শব্দের ব্যবহার এড়িয়ে যাওয়া হয়। এতে ইঙ্গিত মেলে যে, কর্তৃপক্ষ যখন ইচ্ছা তখন এই শব্দের ব্যবহার বন্ধ করতে পারে।
হিউম্যান রাইট ওয়াচ আরো বলেছে, প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু তাদের নিরাপদ ও স্বেচ্ছায় দেশে ফেরার পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে মিয়ানমার। এই সঙ্কটে সরকার একটি ‘অ্যাবিউসিভ টার্ন’ নিয়েছে। তারা শরণার্থী শিবিরের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে কঠোর নীতি আরোপ করেছে। এ ছাড়া কর্তৃপক্ষ ‘খেয়ালখুশিমতো’ ভাসানচরে ৩ শতাধিক শরণার্থীকে আটক করে রেখেছে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা সেখানে নিরাপত্তার মান ও সুরক্ষা বিষয়ে পরিদর্শনে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদেরকে অনুমোদন দেয়া হয়নি। তাদেরকে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে নিরাপদে ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরাঁ ও মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সরকার সেসব আহ্বানে কোনো সাড়া দেয়নি।
করোনা মহামারিকালে ব্যাপক হারে অর্ডার বাতিল করার ফলে বহু গার্মেন্ট লেঅফ করা হয়। কর্মহীন হয়ে ১০ লক্ষাধিক গার্মেন্ট কর্মী বেকার হয়ে পড়েন। এর বেশির ভাগই নারী। অনেকে যে বেতন পাওনা ছিলেন, তা পাননি। ওদিকে কোম্পানিগুলোকে ভর্তুকি হিসেবে ৬০ কোটি ডলারের ঋণ দেয় সরকার। এই অর্থ দিয়ে কর্মীদের বেতন দিতে বলা হয়। কিন্তু এই বেতন কিভাবে পরিশোধ করা হয়েছে তা পরিষ্কার নয়। বিশেষ করে, ওইসব নারী যারা তাদের পরিবার চালান এবং পরিবারের প্রয়োজনীয় ভরণ পোষণ করেন।