সাপাহারের জবই বিলে পরিযায়ী পাখি সংরক্ষণে অভয় আশ্রম
কিউ, এম, সাঈদ টিটো, নওগাঁ : নওগাঁর সাপাহার উপজেলার ঐতিহ্যবাহী জবই বিলে শীতের শুরুতেই পরিযায়ী পাখির আগমন ও বিচরণ শুরু হলেও মৎস্য শিকারীদের অবাধ বিচরণ ও ইঞ্জিন চালিত নৌকার বিকট শব্দে পাখিরা বিল থেকে আবারও ফিরে যাচ্ছে।
বিল এলাকার বাসিন্দাদের মতে উত্তরে ভারত বর্ষের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা, দক্ষিণে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দা নদী ও পুর্নভবা নদী এবং পূর্ব ও পশ্চিমে সাপাহার উপজেলাকে দু’ভাগে বিভক্ত করে বয়ে যাওয়া দিগন্ত ছোঁয়া এই বিলে অতিতে প্রতি শীত মৌসুমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও সুদুর সাইবেরিয়া হতে হাজারো অতিথি পাখির আনাগোনায় মুখরিত থাকত পুরো বিল এলাকা।
জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতিক সম্পদে ভরা এ বিলে সেসময় পাখি শিকারে তেমন কোন বাধ্যবাধকতা না থাকায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল এমনকি রাজধানী ঢাকা শহর হতে সাহেবরা এসে পাখি শিকার করতেন এই বিলে। সেসময় সারা বিল জুড়ে ছিল অসংখ্য কচুরীপানা। বিলের অধিকাংশ এলাকায় পানির দেখা মিলত না। সারাবছরে খরা মৌসুমে একবার বিলে মাছ ধরা হত। সেসময় ২০কেজি, ৩০কেজি এমনকি এক দেড়মণ ওজনের শৌল, বোয়াল কাতলা সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধরা পড়তো জেলেদের জালে।
দেশ স্বাধীনের পরপর মধ্যবর্তী সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে জাল যার জলা তার নীতি ঘোষণা করায় এলাকার কিছু অসাধু স্বার্থন্বেষী মানুষ বিলটিকে আবাদি জমিতে পরিণত করার উপায় অবলম্বন করে বিল থেকে কচুরীপানা অপসারণ করে ফেলে বিলটিকে মৎস্যশূন্য করেন। এরপর থেকে বিলে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য মাছ ধরা পড়তোনা। প্রতিবছর শীতকালে পরিযায়ী অতিথি পাখিরাও আসা বন্ধ করে ওই বিলে।
এলাকার অভিজ্ঞমহল ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা জানান, ১৯৯৬ সালের দিকে তৎকালিন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এক সরকারী সফরে সাপাহারে এলে পুরো বিলটিকে একটি মৎস্য প্রকল্পের অধিনে এনে এলাকার প্রকৃত মৎস্যজীবিদের ভাগ্য উন্নয়নে একটি বৃহৎ প্রকল্পের ঘোষণা দেন। সেই থেকে বিল পাড়ের প্রকৃত মৎস্যজীবিদের নিয়ে একটি সমিতি গঠন করে সদস্যরা বিলটি দেখভাল করে সেখান থেকে মৎস্য আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন।
দেশে মৎস্য ও কৃষির আধুনিকায়নের ফলে মাঝের কয়েক বছর ধরে বিলটি প্রায় মৎস্য ও পাখি শূন্য হয়ে পড়ে। ২০০৮ সালের দিকে ওই বিল এলাকার উজ্জীবিত যুবক সোহানুর রহমান সবুজ এলাকার বেশ কিছু যুবকদের নিয়ে জবই বিল জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও সমাজ কল্যাণ সংস্থা নামে একটি সংগঠন গঠন করেন।
পরবর্তীতে তারা তৎকালীন এমপি ও বর্তমান খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, উপজেলা প্রশাসন, বন্যপ্রাণী ব্যাবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ রাজশাহীর সহায়তায় জেলে ও স্থানীয়দের নিয়ে বিভিন্ন সভা, সেমিনার, প্রচারের ব্যাবস্থা গ্রহণ করেন। তারা বিলের অতিথি পাখিদের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বিলের বিভিন্ন অংশে বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
খাদ্যমন্ত্রী ইতোমধ্যে ঐতিহ্যবাহী এই জবই বিলকে ঘিরে বিল এলাকায় একটি অত্যাধুনিক ইকো পার্ক গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন যাতে করে পর্যাটকরা বিলে এসে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন ও কলরবে বিলের নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন।
জবই বিল জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও সমাজ কল্যাণ সংস্থার সভাপতি সোহানুর রহমান সবুজ জানান, প্রতিবছর এ বিলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেক পর্যটক আসেন। শীতে বিলের জীব বৈচিত্র্যের প্রতি খেয়াল না করে তারা ইঞ্জিন চালিত নৌকা নিয়ে সারা বিল ঘুরে বেড়ান। এতে করে বিলে অবস্থানরত পাখির স্বাবাভিক বিচরণ বাধাগ্রস্ত হয়। তাছাড়া বিলে এখনও পাখি শিকারীদেরও অপচেষ্টা রয়েছে।
তিনি জানান, তাদের জরিপ মতে গত ২০১৯ সালে এ বিলে পাতি সরালী হাঁস ৩ হাজার, লাল ঝুঁটি ভুতি হাঁস ৫০ টি, গিরিয়া হাঁস ২৫ টি, পাতি-তিলি হাঁস ১২ টি, টিকি হাঁস ৫০টি, পিয়াং হাঁস ৪ শ’ টি, কালা পাখ-ঠেঙ্গি ৫২ টি, গেওয়ালা বাটান ৫০ টি, চা-পখি ২৮০ টি, প্রশান্ত সোনা গিরিয়া ২শ’ টি, পাতি ভুতি হাঁস ২৫০ টি, বেগুনী বক ৪ টি, কানি বক ১শ’ টি, বাজলা বক ১২০টি, গো-বক ১শ’ টি, শামুখ খোল ৪শ’ টি, পানকৌড়ী ৫শ’ টি সহ মোট ৫ হাজার ৫শ’ ৯৩ টি বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ছিল।
অভিজ্ঞদের মতে মৎস্য শিকারীদের অবাধ বিচরণ বন্ধ করে ভবিষ্যতে বিলে দেশী ও পরিযায়ী পাখির আবাধ বিচরণ ধরে রাখতে পরিকল্পিতভাবে বিলের কোন এক অংশে একটি জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষিত অঞ্চল গড়ে তুলতে পারলে দেশের বৃহত্তম ও অন্যতম জীব বৈচিত্র্যে ভরপুর, পর্যটন সমৃদ্ধ বিল হিসেবে পরিচিত পাবে ঐতিহ্যবাহী জবই বিল।
এবিষয়ে সাপাহার উপজেলা নির্বাহী অফিসার কল্যাণ চৌধুরীর সাথে কথা হলে তিনিও একই মত প্রকাশ করে বলেন, ‘মৎস্য শিকারীদের কারণে একটু হলেও পাখিদের ক্ষতি সাধিত হয়েছে। তবে অচিরেই মৎস্যজীবিদের সাথে বৈঠক করে এবিষয়ে একটি সমাধান করা হবে। এছাড়া বিলটিকে পর্যাটক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে মাননীয় খাদ্যমন্ত্রী মহোদয়ও নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। তারই সহযোগিতায় ইতোমধ্যে বিলে অনেক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে।’