বাঙালির অহংকার একুশ-মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক
বাঙালির অহংকার একুশ
বাঙালির জাতীয় জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারি একটি স্মরণীয় দিন। একুশ হলো বাঙালির পরিচয়চিহ্ন। ভাষা আন্দোলন বাঙালিকে দিয়েছে নতুন পথের সন্ধান, নির্মাণ করেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের নতুন দিগন্ত। এ দিনের ইতিহাস আমাদের সংগ্রামী চেতনার ইতিহাস। এ দিন বাঙালির জাতীয় জীবনের সকল চেতনার উৎস। তাই চাইলেও এ দিনটিকে আমরা ভুলতে পারব না। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ঐতিহাসিক দিন একুশে ফেব্রুয়ারি। একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা ভিত্তিক আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার আন্দোলন। আর এই স্বাধীনতার মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা হয় স্বাধীন সার্বভৌম সোনার বাংলাদেশ।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে একুশের চেতনার জন্ম। পাকিস্তানিদের দ্বারা পরিচালিত এই রাষ্ট্রে সমতা ও ন্যায় নেই; পরিবর্তে আমাদের বাঙালিদের জন্য আছে সীমাহীন শোষণ, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা ও অপমান। সর্বোপরি সব ক্ষেত্রে এক উৎকট বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠল। জাতিগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার জনগণের অস্তিত্ব ও ভাগ্যকে জুড়ে দেয়া হয়েছিল কৃত্রিম ও সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার ফলে বাংলার মানুষ মূলত আবার বন্দী হলো পাকিস্তানি দুঃশাসনের জাঁতাকলে। বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের ধ্বংস করার জন্য পাকিস্তানিরা প্রথমেই আঘাত হানে আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার ওপর। সে সময় পাকিস্তানে শতকরা ৫৬ জনের মুখের ভাষা বাংলা হলেও শতকরা ৭ জনের মুখের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। বাংলা ভাষার দাবি ছিল সাত কোটি বাঙালির প্রাণের দাবি। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা বাঙালির ন্যায্য দাবিকে পদদলিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। ১৯৪৮ সালে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা এম.এ. জিন্নাহ সাহেব। ঠিক তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিক্ষোভ প্রতিবাদে গর্জে ওঠে পূর্ব বাংলার দামাল ছেলেরা। ভাষার প্রতি বাঙালির চিরঞ্জীব ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ সালের মধ্যে ক্রমান্বয়ে জোরালো হয়ে ওঠে বাংলা ভাষার মর্যাদা আদায়ের দাবি। একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন এই বৈষম্য আর অপমানের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম সরব জবাব।
১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকার এক জনসভায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার ঘোষণা দেন। ফলে বাংলার মানুষ প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা ডাক দেয় আন্দোলনের। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পূর্ব বাংলার সচেতন ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিকসহ সর্বস্তরের জনতা আন্দোলনের জন্য সংগঠিত হতে থাকে এবং আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। এ আন্দোলনের চূড়ান্ত আকার ধারণ করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। এ দিন প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনকে সামনে রেখে সারা দেশে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ব্যাপক কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। আন্দোলনের গতি দেখে তৎকালীন পাকিস্তানি সরকার ভীত হয়ে পড়ে। তাই ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করে। সেই সাথে সকল প্রকার মিটিং, মিছিল, সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে নেমে আসে। সাথে সাথে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায় আমাদের ভাই’দের বুকে। ফলে শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বারসহ অনেক ভাই। আহত হন অসংখ্য ছাত্র। এ হত্যাকা-ের ফলে আন্দোলন আরো ব্যাপক তীব্রতা লাভ করে। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি শাসকচক্র বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।
১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি একুশের প্রথম বার্ষিকী পালন করা হয়। ১৯৫৬ সালে গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান করা হয় সাংবিধানিকভাবে। এ ভাবেই ভাষার লড়াইকে পর্যায়ক্রমে স্বাধিকার এবং স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার সংগ্রামে বাস্তবায়িত করা হয়। ১৯৬২ শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফার আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের ছাত্র গণআন্দোলন, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, সর্বোপরি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। সশস্ত্র ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। স্বাধীনতা লাভের পর বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও প্রসারের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হলেও বর্তমানে আমরা ভালো ফল ভোগ করতে পারছিন না। অফিস-আদালতসহ জাতীয় জীবনে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন ও ব্যবহারের নির্দেশ থাকার পরও বাংলার ব্যবহার নেই বললেই চলে। সবত্রে বাংলা ভাষা অসহায়, মায়ে’র ভাষার প্রতি উদাসিনতা। বুকের তাজা রক্তে যে ভাষা অর্জিত, সে ভাষা আমাদের কাছেই বিকৃত। কিন্তু ১৯৭২ সালের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে মর্যাদা দেয়া হয়।
বাঙালি শিল্প, সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে ধ্বংস করার অপচেষ্টায় লিপ্ত যারা ছিল তাদের সব প্রচেষ্ঠা বিফল করে বিশ্বের প্রায় ১৮৮টি দেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটিকে পালন করা হচ্ছে। এতে তারা বাংলা ভাষাভাষীদের শিল্প সংস্কৃতি সাহিত্য ও সভ্যতাকে জানতে পারছে। তারা জানতে পারছে বাংলার বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকের সৃষ্টি কর্ম। বিশ্বের দরবারে বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি একটি বিশিষ্ট স্থান লাভ করেছে। বিশ্ব জানছে, বাঙালিই একমাত্র জাতি, যারা ভাষার জন্যে যুদ্ধ করেছে। তাই বাংলার ভাষা শহীদদেরও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে সারা বিশ্বের মানুষ। আমাদের মাতৃভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার সাথে বিশ্ববাসীর একধরনের সেতুবন্ধন তৈরি হচ্ছে। একুশ শতকের সূচনা প্রান্তে এসে জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো মাতৃভাষাগুলোর অধিকার এবং একে মর্যাদার সাথে টিকিয়ে রাখার জন্য যে-সাধারণ সংগ্রামের সূচনা করে, তা সারা বিশ্বের ভাষা প্রবাহে অসামান্য অবদান রাখছে। একইসাথে এ দিন বিশ্বের বৃহৎ ভাষাগুলোর পাশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অবহেলিত ভাষাগুলোও বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা খুঁজে পাচ্ছে। কাল থেকে কালান্তরে মাতৃভাষার প্রতি বাঙালি জাতির দায়িত্ব শতগুণে বেড়ে যায়। ভাষা দিবস একুশ ফেব্রুয়ারি ও বাংলা ভাষার কদর সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভাষা আন্দোলনের অমর একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আর আমাদের ইতিহাসের একটি রক্ত-রঙিন দিন নয়, এ দিন এখন পেয়েছে বিশ্বস্বীকৃতি। একুশ আমাদের অহংকার; আমাদের জন্য গৌরব ও প্রেরণা। এটাই হোক এবারের একুশের শপথ।