শনিবার মুক্তিযুদ্ধের মহান সংগঠক আব্দুল জলিলের ৮ম মৃত্যু বার্ষিকী
কিউ, এম, সাঈদ টিটো, পিবিসি নিউজ, নওগাঁ: মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও মার্কেন্টাইল বাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জননেতা আব্দুল জলিলের ৮ম মৃত্যুবার্ষিকী শনিবার (৬ মার্চ)। মরহুম আব্দুল জলিলের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২১ জানুয়ারী এবং ২০১৩ সালের ৬ মার্চ সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ছিলেন। এছাড়াও বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ ছিলেন।
বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন ছিল আব্দুল জলিলের। মৃত্যুর আগে তিনি ১৯৯৬-২০০১ বাংলদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের সময় টানা তিন বছর বানিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ক্রান্তিকালে দলের সফল সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি নওগাঁ-৫ (সদর) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বয়:সন্ধি কালে তিনি নানা রোগে আক্রান্ত ছিলেন।
মরহুমের বড় ছেলে নওগাঁ-৫ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার নিজাম উদ্দিন জলিল জন মরহুম পিতার অসমাপ্ত কাজকে সম্পন্ন করার লক্ষে তৃনমূল নেতাদের সঙ্গে নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
[content-egg module=AE__amazoncom]
১৯৩৯ সালে মো: আব্দুল জলিল নওগাঁ শহরের চকপ্রাণ মহল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম ফয়েজ উদ্দিন আহমেদ ছিলেন নওগাঁ শহরের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তাঁর পিতার একমাত্র ছেলে সন্তান তিনি। ১৯৫৭ সালে নওগাঁ কেডি স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৬০ সালে বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট, ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থকে বিএ অনার্স (রাষ্ট্র বিজ্ঞান) ও ১৯৬৪ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে ব্যারিষ্টারী (বার এট ল) পড়ার জন্য তিনি বিলেত (লন্ডন) যান। ১৯৬৯ সালে দেশে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন চলছিল। এ সময় বঙ্গবন্ধু বিলেতে অধ্যয়নরত প্রাক্তন ছাত্র নেতাদের নিয়ে এক বৈঠক করেন। জলিলের পরিচয় হয় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তখন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে ৬৯ সালেই দেশে ফিরে আসেন এবং ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বাধীনতা আন্দোলনে। সেই সাথে শেষ হয় তাঁর ব্যারিস্টারি পড়ার সকল আয়োজন। ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে নওগাঁ মহকুমার নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয় আব্দুল জলিলের উপর। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাক সামরিকজান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বিভিন্ন তালবাহানা ও কালক্ষেপন শুরু করে।
১৯৭১ এ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে এতদ্অঞ্চলের প্রধান সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন মরহুম আব্দুল জলিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে আব্দুল জলিল নওগাঁ থেকে যাওয়ার সময় ৭৪ জন ছেলে ও তাঁর দলবল নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যান এবং বালুরঘাটে আত্রাই নদীর পূর্বতীরে শ্মশানকালী মন্দিরের পার্শ্বে একটি গৃহে অবস্থান নেন। সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ভর্তি ও বাঙ্গালীপুর, মধুপুর, কামাড়পাড়া, প্যারিলাসহ ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় বেশ কয়েকটি ট্রেনিং ক্যাম্প পরিচালনা করেন। ঐসব ক্যাম্প থেকে হায়ার ট্রেনিং এর জন্য শিলিগুড়ির পানিঘাটায় পাঠিয়ে দেওয়ার বিশাল দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
আব্দুল জলিল শুধু মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠকই ছিলেন না, ‘বঙ্গবাণী’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার মালিকও ছিলেন। আব্দুল জলিলের সাহায্য, সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় বালুরঘাট নিউমার্কেট এলাকার সুনীতি প্রিন্টিং ওয়ার্কস থেকে পত্রিকাটি প্রকাশিত ও প্রচারিত হতো। ওই পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক খন্দকার মকবুল হোসেন ও সহ সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন খন্দকার আবু বককর সিদ্দিকী।
১৯৭১ সালে তিনি সর্বপ্রথম বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ থেকে নওগাঁ সদর আসনে এমপি নির্বাচতি হন। দেশ পুনর্গঠনের কাজে পুরো মাত্রায় আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু স্বাধীনতার বিপক্ষের শত্রুরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। মানবতা বিরোধীরা, যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী ও দেশী বিদেশী শত্রুরা ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট অতর্কিত হামলা চালিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর গোটা পরিবারকে হত্যা করে। জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করে জারি করা হয় সামরিক শাসন। গণতন্ত্রের মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয় গলা টিপে। অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আব্দুল জলিলকেও গ্রেপ্তার করা হয়। দীর্ঘ ৪ বছর কারাভোগের পর ১৯৭৯ সালে তিনি মুক্তিলাভ করেন। ১৯৮২ সালে পুনরায় সামরিক শাসন জারি করার পর গ্রেপ্তার করা হয় আব্দুল জলিলকে। ১৫ দিন অজ্ঞাত স্থানে বন্দী রেখে অবর্ণনীয় দৈহিক নির্যাতন চালানো হয় তার উপর। জেলে থাকা অবস্থায় তাঁর মাতার মৃত্যু হলেও সামরিকজান্তারা মাতৃমুখখানা এক নজর দেখার জন্য কোন সুযোগ দেয়নি।
১৯৮৪ ও ১৯৮৮ সালে তিনি পর পর দু’বার নওগাঁ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে তিনি এমপি নির্বাচিত হন এবং সংসদে বিরোধী দলীয় চীফ হুইপের দায়িত্ব পালন করেন। আব্দুল জলিল আধুনিক নওগাঁর রূপকার। তাঁর উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড এক কথায় প্রকাশ করা যাবে না। নওগাঁ জেলার সকল উপজেলাতেই তাঁর হাতের স্পর্শে অনেক উন্নতি সাধিত হয়েছে। নওগাঁ শহরকে তিলোত্তমা শহরে পরিণত করা তাঁর লালিত স্বপ্ন। জাতীয় পর্যায়ে তিনি অনেক গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক পদে থাকাবস্থায় আব্দুল জলিল অনেক সফলতার পরিচয় দেন। আব্দুল জলিল স্বৈরাচারীদের বহু প্রলোভন, জুলুম, ভয়ভীতি উপেক্ষা করে শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কখনও নীতিভ্রষ্ট হননি, আদর্শচ্যুত হননি কিংবা অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি।
নওগাঁবাসীর কল্যাণ ও উন্নয়নে তিনি সদা-সর্বদাই স্বচেষ্ট ছিলেন। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের ও যোদ্ধাদের খরচ মোকাবিলায় আব্দুল জলিল মহান স্বাধীনতার ৯ মাস যুদ্ধে ভারতের প্রত্যেকটি রিসিপশন ক্যাম্পের জন্য নওগাঁ ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান ব্যাংক থেকে ৭১,৮০,০০০/- টাকা ঐ ব্যাংকের ব্যবস্থাপক ও কোষাধ্যক্ষকে ডেকে নিয়ে এসে ব্যাংকের ভোল্ট রেজিষ্টারে এন্ট্রি করে গ্রহণ করেন। সেই অর্থ দিয়ে ভারতে মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পগুলো পরিচালিত করেন। দেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধুর নতুন সরকারের নিকট খরচ অন্তে ৩৪,৫২,০০০/- টাকা ফেরত দেন।