বাংলাদেশ ক্রমে কর্তৃত্ববাদী একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে
বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে কর্তৃত্ববাদী একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে বলে মন্তব্য করে ব্রিটেন বলেছে, দেশটিতে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে সম্পর্ক বিরোধপূর্ণ, রাজনৈতিক পদ্ধতি সঙ্ঘাতপূর্ণ এবং অত্যন্ত কেন্দ্রমুখী। পার্লামেন্ট ও স্থানীয় সরকারসহ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল। বিচারিক পদ্ধতিতে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর জন্য উন্মুক্ত। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতা পাকাপোক্ত করায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ধীরে ধীরে চূর্ণ হতে চলেছে। ২০১৮ সালে প্রবর্তিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে সরকারের সমালোচনাকারী ও সংবাদমাধ্যমকে নিশ্চুপ থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে বৈদেশিক বাণিজ্যের ঝুঁকি বিষয়ক ব্রিটিশ পররাষ্ট্র, কমনওয়েলথ ও উন্নয়ন দফতরের হালনাগাদ তথ্যে এ সব কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশে বাণিজ্য পরিচালনা করতে গিয়ে ব্রিটিশ ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা কি ধরনের নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক ঝুঁকিতে পড়তে পারে- এতে তা বর্ণনা করা হয়েছে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতরের ওয়েবসাইটে এই সংক্রান্ত ডকুমেন্ট প্রকাশ করা হয়েছে
ডকুমেন্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সংসদীয় ধাচের গণতন্ত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকারী প্রধান দু’টি দল। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ৯৬ শতাংশ আসন জিতে আওয়ামী লীগ ধস নামানো জয় পায়। তবে এই নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হলেও বাংলাদেশ আকর্ষণীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রেখেছে। বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ২০১০ ডলার, যা প্রতিবেশী ভারতের চেয়েও বেশি। এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি। করোনা মহামারীর মধ্যেও বাংলাদেশ আট শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা ভারত ও চীনের চেয়ে বেশি।
এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণে ‘সহজে ব্যবসার পরিবেশ’ একটি সমস্যার কারণ হয়ে রয়েছে। ২০১৯ সালে বিশ্ব ব্যাংকের সহজে ব্যবসার পরিবেশ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৬৮। রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের শক্তিশালী স্বার্থান্বেষী চক্র পর্দার অন্তরালে যথেষ্ঠ প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে। এর একটি শক্তিশালী উদাহরণ হলো দুর্বলভাবে নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকিং খাত থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ খেলাপি হওয়া, যার সাথে রাজনীতির যোগসূত্র রয়েছে। বাংলাদেশের পুঁজিবাজার অগভীর। কোম্পানিগুলোর অর্থনৈতিক প্রতিবেদনের মান সাধারণত দুর্বল। বিনিয়োগ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে এ সব প্রতিবেদনের ওপর ভরসা রাখা যায় না।
ডকুমেন্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মানবাধিকার একটি উদ্বেগের ইস্যু হয়ে রয়েছে। এ দেশে বিচার পাওয়া কঠিন হতে পারে। আইনের বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ দুর্বল। আদালতে মামলার ব্যাপক জট রয়েছে। বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড বহাল রয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে বিচার বহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন ও দুর্নীতির অভিযোগ নিয়মিত। ২০০৬ সালের শ্রম আইনে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও অপ্রচলিত খাতে তা উদ্বেগের কারণ হয়ে রয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ঘুষ ও দুর্নীতি বাংলাদেশে অত্যন্ত শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং প্রাত্যহিক জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই বিস্তৃত। ব্যাপকভিত্তিক দুর্নীতি বেসরকারি খাতের কার্যকর উন্নয়নের পথে বাধা। এটা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বড় ধরনের বাধা ঝুঁকি তৈরি করেছে। ক্রয়প্রক্রিয়ায় অনেক ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। এর সাথে যোগ হয়েছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। রাজনীতিক, আমলা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা অবাধ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। ২০২০ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি ধারণা সূচকে বাংলাদেশ বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪৬তম অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশে কর আইন দুর্বলভাবে ও নির্বাচিত ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। কর জালিয়াতি সংক্রান্ত মিডিয়া প্রতিবেদন বাংলাদেশে খুবই সাধারণ। আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে কর ফাঁকির খবর মিডিয়ায় প্রায়ই আসে। দেশটির কাস্টমসের ওপর নিয়ন্ত্রণ আধুনিকায়নে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি থেকে এখনো তা অনেক দূরে রয়েছে। দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সুবিধাভোগী শক্তিশালী কর্মকর্তারা রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের সহায়তায় এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে।
প্যারিস সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে বুদ্ধিভিত্তিক সম্পদ অধিকারের (আইপিআর) প্রয়োগ বেশ দুর্বল বলে ডকুমেন্টে উল্লেখ করা হয়েছে।