চামড়া শিল্পের বিপর্যয় পানির দামে বিক্রি
পিবিসি নিউজ ঃ দেশের সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্পের কাঁচামাল কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে এবারো হ-য-ব-র-ল অবস্থা দেখা দিয়েছে। মাঠপর্যায়ে কোরবানির পশুর চামড়া পানির দামে বিক্রি হয়েছে। দেড় লাখ টাকার একটি গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ২০০ টাকায়। গত কয়েক বছরের মতো এবারো কাঁচা চামড়ার দাম না পাওয়ায় প্রকৃত সুবিধাভোগীরা যেমন বঞ্চিত হয়েছেন, তেমনি লোকসানের মুখে পড়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। মাঠপর্যায়ে কম দামে কাঁচা চামড়া কিনেও অনেকেই বিক্রি করতে পারেননি। কেউ কেউ যৎসামান্য দাম পেয়েছেন।
গোয়ালন্দের মৌসুমি ব্যবসায়ী সোবহান মোল্লা গতকাল নয়া দিগন্তকে জানান, প্রতি বছরের মতো এবারে কিছু মুনাফার কাঁচা চামড়া কিনেছিলেন। দেড় লাখ টাকা থেকে এক লাখ ৬৫ হাজার টাকা দামের একটি গরুর চামড়া কিনেছেন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। আগে পাইকারি ব্যবসায়ীরা তাদের কাছ থেকে চামড়া নিয়ে যেতেন। কিন্তু এবার তারাই হাটে বাজারে ঘুরে বেড়িয়েছেন চামড়া নিয়ে। ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনতে আগ্রহ দেখাননি। গড়ে চার শ’ টাকা দরে তিনি চামড়া বিক্রি করেছেন। অথচ একটি চামড়া গ্রাম থেকে সংগ্রহ থেকে বাজার পর্যন্ত আরো চামড়াপ্রতি প্রায় ১০০ টাকা খরচ হয়। ফলে তিনি চামড়া কিনে কোনো মুনাফা পাননি, বরং সারা দিন চামড়া সংগ্রহ করতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেছেন।
ঈদের আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়। সরকারের নির্ধারিত দাম অনুযায়ী ট্যানারি ব্যবসায়ীরা এবার ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া কেনার কথা ৪৫-৫০ টাকায়। অন্যদিকে খাসির চামড়া ১৫ থেকে ১৭ টাকা, বকরির চামড়া ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়। অপর দিকে চামড়া ব্যবসায়ীদের তহবিল সঙ্কট মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণের নীতিমালা শিথিল করা হয়। ব্যবসায়ীরা মাত্র ৩ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে অনাদায়ী ঋণ নবায়ন করতে পারবেন। একই সাথে নতুন ঋণ নেয়ার জন্য কোনো ধরনের কোম্প্রামাইজড এমাউন্ট বা নবায়নের পর বাড়তি অর্থ পরিশোধ থেকেও তাদেরকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এতে ব্যাংকগুলোর বরাদ্দকৃত অর্থঋণ নিয়ে কোরবানির পশুর চামড়া কিনতে আর কোনো বাধা থাকবে না বলে ধরে নেয়া হয়েছিল
অন্যদিকে গত বছর ঈদুল আজহার আগে পাঁচ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ ৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংক এ খাতে বরাদ্দ রেখেছিল ৬৪৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। কিন্তু এর বিপরীতে ব্যবসায়ীরা ঋণ নিয়েছিল মাত্র ৬৫ কোটি টাকা। এবারো বরাদ্দ রাখা হয় ৫৮৩ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যবসায়ীরা জানান, এবারো ব্যবসায়ীরা ঋণ নিতে পারেননি। এবার ৬৫ কোটি টাকার নতুন ঋণ নিতে পেরেছেন ব্যবসায়ীরা
এ দিকে সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল, বাস্তবে কোথাও ওই দামে বিক্রি হতে দেখা যায়নি। দেখা যায় দেড় লাখ টাকা দিয়ে কেনা গরুর চামড়া বিক্রি করতে হচ্ছে মাত্র ১০০ থেকে ২০০ টাকায়। কিন্তু খাসি-বকরির চামড়া বেশির ভাগ স্থানে বিক্রি হয়নি।
এ দিকে কোরবানির চামড়ার সার্বিক ব্যবস্থাপনায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ঈদের আগে সিটি করপোরেশন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে তিনটি কমিটি গঠন করে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গত সোমবারের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, কোরবানির চামড়া যথাযথভাবে সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য ক্রেতা ও বিক্রেতা পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টিসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা দ্রুত সাথে সম্পন্ন করতে গঠিত তিনটি কমিটির কাঁচা চামড়ার মূল্য স্থিতিশীল রাখাসহ কাজের আওতাও নির্ধারণ করে তারা দিয়েছিল।
কিন্তু এত কিছু উদ্যোগের পরও কাঁচা চামড়ার ন্যায্যমূল্য পাননি ব্যবসায়ীরা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চামড়া ও চামড়াজাত সব পণ্যের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। তা হলে কাঁচা চামড়ার দাম কমছে কেন, সেই উত্তর মিলছে না কোথাও।
পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশে তৈরি পণ্যের চাহিদা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইউরোপ আমেরিকায় যাচ্ছে বাংলাদেশের জুতা ও চামড়াজাত পণ্য।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের জন্য চামড়া শিল্প অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি খাত, যা সুষ্ঠু পরিচালনা ও যথাযথ উদ্যোগের মাধ্যমে এগিয়ে নিতে পারলে জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। কিন্তু বিপুল সম্ভাবনা থাকার পরও এ খাতের বিকাশ সঠিকভাবে হচ্ছে না। এই অপার সম্ভাবনাময় শিল্পকে ধ্বংসের জন্য একটি মহল উঠেপড়ে লেগেছে। এমনটি না হলে গত বছর চামড়ার মূল্য কমিয়ে এটিকে মাটিতে পুঁতে ফেলার বা নষ্ট করার জন্য উৎসাহ জোগানোর সংবাদ পাওয়া যেত না। দেশের সারা বছরের অর্ধেক চামড়া সংগ্রহ হয় ঈদের মৌসুমে, কিন্তু প্রতি বছর কোরবানির ঈদের আগে চামড়া শিল্প সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের জন্য ন্যূনতম দাম ঠিক করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে ট্যানারি মালিকদের দাবিতে বেশ কয়েক বছর ধরে ওই দাম কমতির দিকে।
ট্যানারির মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহিন আহমেদ গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ট্যানারিগুলো স্থানান্তরের কারণে ও করোনার প্রভাবে ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি। ফলে অনেকেই ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছেন। এ পরিস্থিতিতে তারা বিশেষ বিবেচনায় ঋণ নবায়নের সুযোগ চেয়েছিলেন। পুরনো ঋণগুলো ব্লক করে নতুন করে ঋণ চেয়েছিলেন। কিন্তু বরাবরের মতোই ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ দিয়ে পুরনো ঋণ সমন্বয় করে থাকে। এতে প্রকৃতপক্ষে তারা ঈদের আগে পর্যাপ্ত তহবিল সঙ্কটে ভোগেন।
তিনি জানান, ঈদের আগে দেড় হাজার কোটি টাকার চামড়া বাজার থাকে। কমপক্ষে ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকা ঋণ পেলে তারা চামড়ার প্রকৃত সুবিধাভোগী থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে পারতেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ৬০ কোটি থেকে ৬৫ কোটি টাকার ওপরে ঋণ পাওয়া যায় না; যা তাদের চাহিদার চেয়ে খুবই অপ্রতুল। গত বছর প্রায় সাড়ে ছয় শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছিল ব্যাংকগুলো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা ঋণ পেয়েছিলেন ৬৫ কোটি টাকা। এবারো ৫৮৩ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা হাতে পেয়েছেন ৬৫ কোটি টাকা। এর ফলেই তারা পর্যাপ্ত তহবিল নিশ্চিত করতে পারেননি। এতে ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন উভয়পক্ষ।