‘নূর হোসেনের শরীরে শ্লোগান লিখেছিলাম আমি, তার মৃত্যুর জন্য নিজেকেই দায়ী ভাবতাম’
পিবিসি নিউজঃ ১০ নভেম্বর, ১৯৮৭ সাল। প্রেসিডেন্ট এরশাদের পদত্যাগ এবং গণতন্ত্রের দাবিতে রাজধানী ঢাকার সচিবালয় অবরোধের ডাক দিয়েছিল বিরোধী দলগুলো। অবরুদ্ধ নগরীতে সেদিন রাস্তায় নেমেছিল এক তরুণ, নূর হোসেন। তার বুকে পিঠে স্বৈরতন্ত্রের পতন আর গণতন্ত্রের দাবিতে লেখা শ্লোগান। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার আগে তোলা নূর হোসেনের ছবি পরবর্তীকালে হয়ে উঠে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রতীক।
এক শ্রমজীবী নিম্নবিত্ত পরিবারের এই তরুণ কী ভেবে সেদিন নিজের শরীরকে জীবন্ত পোস্টার করে তুলেছিলেন? কে তার শরীরে লিখে দিয়েছিল এই শ্লোগান?
গুলিবিদ্ধ নূর হোসেনকে সেদিন ঢাকার শাহবাগের পুলিশ কন্ট্রোলরুমের যে সেলে ফেলে রাখা হয়েছিল, সেখানে তখন রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে আটক ছিলেন আরো অনেকে। তাদের মধ্যে ছিলেন এই প্রতিবেদনের লেখক, বিবিসির মোয়াজ্জেম হোসেনও। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ৩৩ বছর পর তিনি নূর হোসেনের পরিবার, বন্ধু, সাংবাদিক, আলোকচিত্রী এবং সহবন্দীদের সাথে কথা বলে জানার চেষ্টা করেছেন সেদিনের ঘটনাপ্রবাহ :
১০ নভেম্বর, ১৯৮৭: শাহবাগ, পুলিশ কন্ট্রোল রুম
ঝাঁকড়া চুলের শ্যামলা রঙের ছেলেটিকে আমরা যখন দেখি, তখন তার দেহ রক্তাক্ত। কিন্তু তার শরীরে সাদা রঙে লেখা শ্লোগান তখনো জ্বলজ্বল করছে। আমরা তখনো জানি না, ছেলেটি কে? কী তার নাম?
শাহবাগের পুলিশ কন্ট্রোল রুমের ছোট্ট এক সেলে পড়েছিল কয়েকটি রক্তাক্ত দেহ।
আমরা ছিলাম ঠিক পাশের আরেকটি সেলে। শাহবাগের পুলিশ কন্ট্রোলরুমের সেই কয়েদখানা তখন ক্রমশ ভরে উঠছে রাজনৈতিক বন্দীতে। আমার বয়স তখন ১৯, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র।
পাশের সেলটি থেকে বহুক্ষণ আহত মানুষের মরণ চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। সহ্য করতে না পেরে আমরা একটু পরে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখেছিলাম।
ততক্ষণে সেখানে পড়ে থাকা দেহগুলো দেখে বোঝার উপায় নেই তারা জীবিত না মৃত। ছোট্ট সেলটিতে যেভাবে তাদের ফেলে রাখা হয়েছিল, তাতে বোঝা যাচ্ছিল না শরীরের কোন অংশটি কার। একজনের শরীরের নিচে চাপা পড়েছে আরেকজনের শরীর।
সেই বীভৎস দৃশ্যে বেশিক্ষণ চোখ রাখা মুশকিল।
কিন্তু একইসাথে একজনের শরীরের উর্ধাঙ্গে সাদা রঙে লেখা শ্লোগান এক তীব্র ধাক্কা দিয়েছিল আমাদের।
আমরা জানতাম না, এই তরুণের নাম নূর হোসেন।
বুকে-পিঠে শ্লোগান লিখে রাস্তায় নামা নূর হোসেনের যে ছবিটি চিরকালের জন্য বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আকাঙ্খার প্রতীক হয়ে উঠেছে, সেই ছবিটি পরে বহু শতবার দেখেছি আমি।
কয়েকটা প্রশ্ন বারে বারে আমার মনে জেগেছে: ঢাকার এক শ্রমজীবী নিম্নবিত্ত পরিবারের এই তরুণ কী ভেবে সেদিন শরীরে এই শ্লোগান লিখেছিল? কে তাকে এই কাজে উদ্বুদ্ধ করেছিল? তার শরীরে কে লিখে দিয়েছিল এই শ্লোগান?
৩৩ বছর পর আমি এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পেয়ে যাই কিছু নতুন সূত্র।
৯ নভেম্বর, ১৯৮৭: মতিঝিল, পপুলার আর্ট
ঢাকার অফিস পাড়া মতিঝিল আর বঙ্গভবনকে ভাগ করে রেখেছে যে উঁচু প্রাচীর, তার পাশ দিয়ে চলে গেছে একটি রাস্তা। সেখানে পপুলার আর্ট বলে একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন ইকরাম হোসেন। তার বয়স তখন ১৮।
ছোটবেলা থেকেই ইকরামের ছিল আঁকাআঁকির শখ। সেখান থেকে হয়ে গেলেন কমার্শিয়াল আর্টিস্ট।
ইকরাম হোসেনের কথা আমি প্রথম জানতে পারি নূর হোসেনের বড় ভাই আলী হোসেনের কাছে। তিনিই আমাকে টেলিফোনে যোগাযোগ ঘটিয়ে দেন তার সাথে।
‘আমি মূলত সাইনবোর্ড, ব্যানার এসব লেখার কাজ করতাম। মতিঝিলে বিসিআইসি ভবনের কাছে ছিল আমাদের দোকান,’ বলছিলেন ইকরাম হোসেন।
তখন মতিঝিলের কাছেই বঙ্গভবনে স্টাফ কোয়ার্টারে থাকতেন ইকরাম হোসেন। তার বড় ভাই প্রেসিডেন্ট এরশাদের চাপরাশি। তিনি বড় ভাইয়ের বাসায় থাকেন, আর মতিঝিলে এই দোকান চালান।
৯ নভেম্বর, ১৯৮৭। ঢাকা শহর তখন অবরুদ্ধ, সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। পরদিন ঢাকায় সচিবালয় অবরোধ। পরিস্থিতি ভালো নয়। তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে বিকেল ৫টাতেই দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ইকরাম।
কিন্তু বিকেল সাড়ে ৪টাতেই তার কাছে এসে হাজির ছেলেটি। তার মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মাথায় ঝাঁকড়া চুল।
ছেলেটির সাথে সেরকম কথা হয়নি কখনো ইকরামের, তবে মুখ চেনা। নাম তার নূর হোসেন।
‘নূর হোসেন যখন আসলো, আমি তখন আমার কাজ শেষ করছি। নূর হোসেন আমাকে বললো, ইকরাম ভাই, আপনি এমন এক জায়গায় আজকে লিখবেন, যেখানে জীবনেও লেখেন নাই।’
ইকরাম হোসেনের শিল্পী মনে কৌতুহল জাগলো। কী এমন লেখা, যা জীবনে লেখেননি?
অফিস পাড়ায় তখন শীতের সন্ধ্যা নামছে। রাস্তাঘাট ফাঁকা হতে শুরু করেছে। ইকরামকে নিয়ে নূর হোসেন ঢুকে গেলেন এক ছোট্ট গলিতে। তারপর যা করলেন, তাতে হতভম্ব হয়ে গেলেন ইকরাম হোসেন। নূর হোসেন তার গায়ের জামা খুলে ফেললেন এক ঝটকায়।
“আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনি জামা খুললেন কেন। নূর হোসেন আমাকে বললেন, ইকরাম ভাই, আপনি আমার বুকের এখানে লিখবেন ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’, আর পিঠে লিখবেন , ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। আমি তো অবাক হয়ে গেলাম। আমি তো জীবনেও কোন মানুষের গায়ে লিখিনি। আমি কাউকে কখনো মানুষের গায়ে লিখতে দেখিনি।”
“আমি একটু ভয় পেলাম। আমার বড় ভাই প্রেসিডেন্ট এরশাদের চাপরাশি। আমি থাকি বঙ্গভবনের কোয়ার্টারে। প্রেসিডেন্ট এরশাদের বিরুদ্ধে তো আমি এরকম একটা জিনিস লিখতে পারি না। আমি বললাম, না, এটা আমি লিখতে পারবো না। আপনি এটা লিখে বাইরে গেলে পুলিশের মার খাবেন। তারপর জেলে যাবেন। আপনি মরেও যেতে পারেন।”
কিন্তু নূর হোসেন ছিলেন নাছোড়বান্দা।
“নূর হোসেন আমাকে বলেছিল, ইকরাম ভাই আমি একা না, আরো এক শ’জনের গায়ে এটা লেখা থাকবে। আমরা সবাই কাল এক সঙ্গে মিছিল করবো।”
একটু ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত ইকরাম হোসেন এরপর যা লিখে দিলেন, তা এখন ইতিহাস।
কী লিখতে হবে তা নূর হোসেন নিজেই চক দিয়ে প্রথমে দেয়ালে লিখেছিলেন। সেই লেখা দেখে নূর হোসেনের বুকে আর পিঠে তিনি সাদা রঙে একেঁ দিলেন সেই বিখ্যাত শ্লোগান: স্বৈরাচার নীপাত যাক।। গণতন্ত্র মুক্তি পাক।। যেভাবে ভুল বানানে নূর হোসেন চক দিয়ে দেয়ালে লিখে দিয়েছিলেন, ঠিক সেভাবে।
তিনি শ্লোগানটি লিখেছিলেন এনামেল পেইন্ট দিয়ে। বুকে-পিঠে দুদিকেই শ্লোগান লিখে শেষে দুটি দাড়ি দিয়েছিলেন।
“এটা আমি করেছিলাম, একটা উদ্দেশ্য মাথায় রেখে। যেহেতু নূর হোসেন বলেছিল আরো এক শ’জনের গায়ে শ্লোগান লেখা থাকবে, তার মধ্যে আমার লেখা শ্লোগান যেন আলাদা করে চেনা যায়। কিন্তু নূর হোসেন আমাকে আসলে মিথ্যে কথা বলেছিল। সে একাই আসলে সেদিন এভাবে রাস্তায় নেমেছিল। আর কেউ গায়ে শ্লোগান লিখে রাস্তায় নামেনি সেইদিন।”