দেশে একের পর এক বন্যহাতির মৃত্যুর পেছনে কারণ কী?
পিবিসি নিউজঃ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, শেরপুরের শ্রীবরদী, কক্সবাজারের চকরিয়ার পর শুক্রবার চট্টগ্রামের বাঁশখালী থেকে আরেকটি হাতির লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে দেশে গত পাঁচ দিনে চারটি হাতির মৃত্যুর ঘটনা ঘটলো।
এভাবে একের পর এক হাতি মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এই এশীয় প্রজাতির হাতিকে বন্যপ্রাণী বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইউসিএন ‘মহা-বিপন্নের তালিকায়’ অন্তর্ভূক্ত করেছে।
বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করছেন, এই প্রাণীটিকে রক্ষায় প্রশাসনের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। চারটি হাতি মৃত্যুর ঘটনায় এখন পর্যন্ত মাত্র একজনকে গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে। মামলা হয়েছে দুটি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং এশিয়ান এলিফেন্ট স্পেশালিস্ট গ্রুপের সদস্য মোহাম্মদ মোস্তাফা ফিরোজ জানান, ‘এভাবে একের পর এক হাতি মারা যাচ্ছে অথচ এটা নিয়ে সরকারের কোনো পক্ষই ভাবছে না। বেসরকারি সংস্থাগুলোরও কোনো তৎপরতা নেই। এভাবে চলতে থাকলে হাতি রক্ষা করাই কঠিন হয়ে যাবে। আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে।’
পর পর এত হাতি মৃত্যুর কারণ কী?
বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, হাতি লোকালয়ে ঢুকে পড়ায় এমন ঘটনা ঘটেছে।
এর স্পষ্ট বিরোধিতা করে মোহাম্মদ মোস্তাফা ফিরোজ জানান, হাতি লোকালয়ে আসছে না বরং হাতির আবাসভূমিতে মানুষ ঢুকে পড়ে হাতির জায়গা দখল করছে।
তিনি জানান, হাতিরা বংশ পরম্পরায় হাজার হাজার বছর ধরে একটি নির্দিষ্ট রুট ধরেই চলাচল করে। সম্প্রতি আইইউসিএন হাতির সেই সেই বিচরণক্ষেত্র পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষভাবে চিহ্নিত করেছে।
তারপরও সেই বিচরণ ক্ষেত্রে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে মানুষ বসতি গড়ে তুলছে, আবার অনেকে বন বিভাগের জমি ইজারা নিয়ে চাষাবাদ করছে।
মোস্তফা ফিরোজ বলেন, হাতি তার বিচরণ-ক্ষেত্রে কিছু পেলেই সেটা লণ্ডভণ্ড করে দেয়। সেখান থেকেই হাতি আর মানুষের দ্বন্দ্ব বাড়ছে। আর এভাবে এতগুলো হাতি প্রাণ হারিয়েছে। কোথাও বিদ্যুতের ফাঁদ পেতে মারছে, কোথাও তো গুলি করেও মারা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বা কক্সবাজারের বনাঞ্চলের হাতিগুলো সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। রোহিঙ্গারা যেখানে বসতি করেছে সেটা পুরোটাই হাতির বিচরণক্ষেত্র।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাতি মিয়ানমার থেকে এই রুটেই টেকনাফ বনে যায়। সেই রাস্তায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প হওয়ায় হাতিগুলো একপ্রকার কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। আর যেগুলো পারাপারের চেষ্টা করেছে সেগুলোয় মানুষের হামলার মারা গিয়েছে।
অন্য দিকে শেরপুরের বনাঞ্চলে অনেক হাতি ভারতের মেঘালয় থেকে খাবারের সন্ধানে বাংলাদেশের দিকে চলে আসে। বিশেষ করে বর্ষার পরে যখন নতুন ঘাস জন্মায় এবং পাকা ধানের মৌসুমে। এখন অনেক হাতিই এখানে থেকে যাচ্ছে, বাচ্চা প্রসব করছে। কিন্তু গত এক দশকে বন বিভাগের বহু জমি মানুষের দখলে চলে যাওয়ায় হাতির এই বিচরণক্ষেত্র হাতির জন্য আর নিরাপদ নেই।
আইন কঠোর হলেও প্রয়োগ নেই
বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় যে আইন করা হয়েছে তা বিশ্বের যেকোনো দেশের চাইতে অনেক কঠোর। কিন্তু এই আইনের যথেষ্ট প্রয়োগ নেই বলে অভিযোগ বিশেষজ্ঞদের।
মোস্তফা ফিরোজ মনে করেন, মানুষ-সৃষ্ট কারণে বহু হাতি মারা গেলেও এখন পর্যন্ত কাউকে কোনো শাস্তি দেয়া হয়নি। অথচ প্রথম ঘটনায় তাৎক্ষণিক আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হলে হয়তো পরের ঘটনাগুলো ঘটতো না।
বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি হাতি হত্যা করেছে বলে প্রমাণিত হলে তিনি জামিন পাবে না এবং অপরাধীকে সর্বনিম্ন দুই বছর এবং সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন এক লাখ থেকে সর্বোচ্চ দশ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
একই অপরাধ পুনরায় করলে সর্বোচ্চ ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড দেয়ার বিধান আছে। তবে কেউ যদি হাতির হামলার শিকার হন এবং তার প্রাণ যাওয়ার শঙ্কা থাকে তাহলে জীবন রক্ষার্থে হাতি হত্যার এই বিধান প্রযোজ্য হবে না।