সরকারি রোষানলে অধিকার
পিবিসি নিউজঃ বাংলাদেশের খ্যাতনামা মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর নিবন্ধন নবায়ন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনস্ত এনজিও বিষয়ক ব্যুরো। ২০১৫ সালের ২৫ মার্চ অধিকার-এর নিবন্ধনের মেয়াদ উর্ত্তীর্ণ হয়। তারপর থেকেই সংগঠনটির নিবন্ধন নবায়ন নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে নানা ওজর-আপত্তি দেখা দেয়। এ নিয়ে উচ্চ আদালতে একটি মামলাও চলছে। কিন্তু এরই মধ্যে এক দীর্ঘ চিঠি পাঠিয়ে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার, অর্থাৎ অধিকার-এর আবেদন বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
১৯৯৪ সাল থেকেই মানবাধিকার সংগঠন হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে অধিকার। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর গুলিতে বাংলাদেশি নাগরিকদের নিহত হওয়ার পরিসংখ্যান হিসাব করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল অধিকার।
তবে ২০১৩ সালের মাঝামাঝি সংগঠনটি আলোচনায় আসে বিতর্কিত একটি তালিকাকে কেন্দ্র করে। ওই বছরের ৫ মে ঢাকায় হেফাজতে ইসলামির অবস্থান পণ্ড করতে নিরাপত্তা বাহিনী মধ্যরাতে সক্রিয় হয়ে উঠে। ওই সময় বহু সংখ্যক কর্মী হতাহত হয় বলে ইসলামি সংগঠনটির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল। ৭ মে সংগঠনটি এক বিবৃতিতে দাবি করে, মতিঝিলের শাপলা চত্বরে মধ্যরাতে চালানো ওই অভিযানে “আড়াই থেকে তিন হাজার মানুষ মারা গেছেন।”
সরকারের পক্ষ থেকে ওই দাবি সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিয়ে বলা হয়, ওই অভিযানে কেউই নিহত হননি। তৃতীয় কোন পক্ষের অনুসন্ধান বা তদন্তেও হেফাজতের দাবির পক্ষে জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে ওই অভিযানে অন্তত কয়েক ডজন মানুষ নিহত হওয়ার বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীরা বিভিন্ন সূত্রকে বলেছেন।
ঘটনার কিছুকাল পর অধিকার-এর পক্ষ থেকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ওই অভিযানে বিপুল সংখ্যক হেফাজত কর্মী নিহত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়। নিহত ব্যাক্তিদের বিস্তারিত জানতে চেয়ে সরকারের পক্ষ থেকে চিঠিও দেয়া হয়। কিন্তু সূত্রের নিরাপত্তা রক্ষার যুক্তি দেখিয়ে অধিকার বিস্তারিত তথ্য সরবরাহ করা থেকে বিরত থাকে। তবে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করার আহ্বান জানানো হয় তাদের পক্ষ থেকে।
এরপর থেকেই অধিকার এক ধরণের বৈরী পরিস্থিতিতে পড়ে।
এরই মধ্যে ২০১৩ সালের ১০ আগস্ট অধিকার-এর দুই শীর্ষ কর্মকর্তা, আদিলুর রহমান খান ও নাসির উদ্দিন এলানকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তাদের বিরুদ্ধে “তথ্য বিকৃতি”র অভিযোগ এনে বিতর্কিত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলা দায়ের করা হয়। বর্তমানে তারা জামিনে রয়েছেন।
তাদেরকে গ্রেপ্তারের পর দিন অধিকার-এর কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে পুলিশ একটি খসড়া তালিকা উদ্ধার করে। ওই সময় পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, তালিকায় থাকা অনেক নামই “ভুয়া” বা অস্তিত্ববিহীন। বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হলে অধিকার-এর এক কর্মকর্তা একটি তালিকা প্রস্তুতের কথা স্বীকার করেন। তবে তার বক্তব্য ছিল, তাদের করা চূড়ান্ত তালিকা পুলিশের জব্দ করা কম্পিউটারে ছিল না।
এরই মধ্যে ২০১৪ সালে অধিকার তাদের নিবন্ধন নবায়নের আবেদন করলে, তা সরকারের পক্ষ থেকে আটকে দেয়া হয়। ২০১৬ সালের এক প্রতিবেদনে সংগঠনটি উল্লেখ করে, “অধিকার-এর মানবাধিকার সংক্রান্ত সমস্ত কার্যক্রম ব্যাহত করার জন্য দুই বছর ধরে সবগুলো প্রকল্পের বরাদ্দকৃত অর্থছাড় বন্ধ এবং নতুন কোন প্রকল্পের অর্থছাড় সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রেখেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনস্ত এনজিও বিষয়ক ব্যুরো।”
এর পর ২০১৮ সালের দিকে নিবন্ধন কার্যকর না থাকার যুক্তি দেখিয়ে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন তাদের পর্যবেক্ষক তালিকা থেকে অধিকার-কে বাদ দেয়।
এ নিয়ে এক ধরণের অচলাবস্থা চললেও, সম্প্রতি র্যাবের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর অধিকার-এর প্রতি আরও খড়গহস্ত হয় সরকার।
বাংলাদেশের বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম বিষয়ে অধিকার-এর করা পরিসংখ্যান বিশেষভাবে সমাদৃত। অধিকার-এর তথ্য ও পরিসংখ্যান বিশ্বের অনেক মানবাধিকার সংগঠনই ব্যবহার করে থাকে। বাংলাদেশের খুব অল্প সংখ্যক মানবাধিকার সংগঠনই জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সরাসরি কাজ করে থাকে। তাদের মধ্যে অধিকার একটি।
র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার বিবৃতি ও প্রতিবেদন নিয়ে সংবেদনশীল হতে দেখা যায় সরকারকে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ নিয়েও কড়া প্রতিক্রিয়া দেখান বিভিন্ন মন্ত্রী। এসব প্রতিবেদনের জন্য আকারে ইঙ্গিতে অধিকার-কে দায়ী করেন অনেকে।
এই ধরণের পরিস্থিতির মধ্যেই অধিকার-এর নিবন্ধন নবায়নের বিষয়টি নিষ্পত্তি করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এনজিও ব্যুরোর পাঠানো দীর্ঘ চিঠিতে এই নবায়ন অনুমোদন না করার পক্ষে বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক যুক্তি দেখানো হয়। একই যুক্তি দেখানো হয় বিদেশী কূটনীতিকদের কাছে পাঠানো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি চিঠিতে — যার একটি অনুলিপি নেত্র নিউজের হাতে এসেছে।
অধিকার-এর নিবন্ধন বাতিলের পক্ষে সরকার যেসব কারণ দেখিয়েছে, তার মধ্যে কিছু নগণ্য কারণও রয়েছে। যেমন, সরকারকে জমা দেয়া কিছু ঘোষণাপত্রে সংস্থার প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষর থাকা ও সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষর না থাকাকেও একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া ভ্যাট বকেয়া বাবদ ২৯২১ টাকা জমা দেয়ার চালানের কপি সংযুক্ত না থাকার কথাও কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
তবে চিঠির শেষের দিকে এই নিবন্ধন বাতিলের প্রকৃত কারণ আরও স্পষ্ট হয়েছে।
“সরকারের বিশেষ গোয়েন্দা শাখা কর্তৃক [তিনটি] প্রকল্পের কার্যক্রমে আর্থিক অসংগতি ও নেতিবাচক কর্মকান্ড বিষয়ে ব্যুরোকে অবহিত করা”র কথাও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
শেষ যুক্তিতে আরও বলা হয়, “সর্বশেষ, ‘অধিকার’ নামীয় সংস্থা কর্তৃক বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ইস্যু সৃষ্টি করে কথিত গুম-খুনসহ বিচারবহির্ভূত বিভিন্ন হত্যার বিষয়ে সংস্থার নিজস্ব ওয়েবসাইট odhikar.org -তে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশ করা হয়; যা বহির্বিশ্বে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ণ করে।”