গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও জনগণের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে আনতে জামায়াতের ১০ দফা
দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও জনগণের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ১০ দফা দাবির ভিত্তিতে দেশব্যাপী যুগপৎ গণআন্দোলন গড়ে তোলার জন্য শনিবার (১০ ডিসেম্বর) রাজধানীর একটি মিলনায়তনে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে দেশবাসীর উদ্দেশে বক্তব্য প্রদান ও কর্মসূচি ঘোষণা করেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমান।
দেশের চলমান পরিস্থিতি তুলে ধরে জামায়াত আমির ডা: শফিকুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ আজ এক ভয়াবহ পরিস্থিতিতে নিপতিত। দেশ অব্যাহতভাবে নতুন নতুন সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সামাজিক অঙ্গণে এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতি বিদ্যমান।
২০০৮ সালে সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সরকার জনগণের ওপর চেপে বসেছে। তারা ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য আদালতের দোহাই দিয়ে কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থা বাতিল করে। অথচ আদালতের রায়ে পরপর দু’টি নির্বাচন কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে করার কথা বলা হয়েছিল। তারা ক্ষমতার মোহে নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়।
তিনি আরো বলেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নির্বাচনের নামে প্রহসনের আয়োজন করে অন্যায় ও অনৈতিকভাবে বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল করে। আজ বাংলাদেশে জনগণের ভোটাধিকার নেই, কথা বলা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। চলাফেরা, মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশ করার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশ আজ এক অধিকারহারা জাতিতে পরিণত হয়েছে।
সরকার দেশের প্রশাসন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে দলীয়করণ করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক কর্তাব্যক্তি রাজনৈতিক নেতার ভাষায় কথা বলছেন। তারা তাদের পেশাদারিত্বের পরিবর্তে সরকারের অবৈধ নির্দেশ বাস্তবায়নে তৎপর।
সরকারের দলীয় ক্যাডারদের মাধ্যমে ও দলীয় প্রভাব বজায় রেখে কোনো অবস্থাতেই নির্বাচন নিরপেক্ষ হতে পারে না। বিগত দু’টো নির্বাচন তার প্রমাণ। গোটা জাতি এ বিষয়ে একমত যে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দলনিরপেক্ষ সরকারের কোনো বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, ক্রমাগতভাবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি তেল, কৃষি ও শিক্ষা উপকরণ এবং ভোজ্যতেলের মূল্য দফায় দফায় বৃদ্ধি পেয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। দেশে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংকটের কারণে জনগণকে ব্যাপক দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, ব্যাংক লুটপাট, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ফান্ডের টাকা চুরিসহ নানা অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি দেশকে অর্থনৈতিক সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। দেশ থেকে প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্প ও মেগা প্রকল্পের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতি জনগণের টাকা আত্মসাতের একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে দেশকে আজ অর্থনৈতিক সংকটের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, বর্তমান সরকার দেশের আলেম-উলামাসহ ইসলামী চিন্তাবিদদের ওপর সীমাহীন নির্যাতন চালাচ্ছে। দেশের অনেক আলেম এখনো কারাবন্দী। হাজার হাজার মামলা দিয়ে বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদেরকে হয়রানি করছে। সাংবাদিকগণ তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। অনেক সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, অনেকে গ্রেফতার হয়েছেন, অনেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে অসহায় জীবন-যাপন করছেন। অনেকে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
সরকার দেশের জনপ্রিয় ও মেধাবী সন্তানদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গুম করে দিয়েছে। গুম হওয়া পরিবারের সদস্যগণ তাদের প্রিয়জনদের ফিরে পাওয়ার জন্য আবেদন-নিবেদন করেও কোনো ফল পাচ্ছেন না।
নারী-শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, অপহরণ ও ধর্ষণের পরে খুন বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ভয়াবহ ঘটনা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে হেয় প্রতিপন্ন করেছে। দেশের যুবসমাজকে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। মাদকের সয়লাবে যুবসমাজ আজ আক্রান্ত। মানুষের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ‘মদ’ আইনগতভাবে ব্যাপক বৈধতা দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে আজ সংবিধানস্বীকৃত মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশ করার কোনো পরিবেশ নেই। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার বাস্তবায়ন করতে গেলে পুলিশ বাধা দিচ্ছে। শান্তিপূর্ণ মিছিল ও সমাবেশ থেকে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে।
আমিরে জামায়াত আরো বলেন, আপনারা জানেন ২০১১ সাল থেকে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও মহানগরীর কার্যালয় বন্ধ করে আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা হয়েছে।
দেশের বিচার বিভাগ আজ ধ্বংসের মুখোমুখি। আদালতগুলোতে ন্যায়বিচারের কোনো পরিবেশ নেই।
এই সরকারের ব্যর্থ পররাষ্ট্রনীতির কারণে অব্যাহতভাবে সীমান্ত হত্যা চলছে। দেশের নদ-নদীগুলোর পানি সমস্যা সমাধানে ভারতের সাথে কোনো সম্মানজনক চুক্তি বা সমঝোতায় আসতে পারেনি। বরং প্রতিবেশী দেশকে খুশি করার জন্য তাদের স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে কাজ করেছে। অতি সম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্তে গুলি ও বোমা বর্ষণের কোনো প্রতিকারের উদ্যোগ নিতে পারেনি এই সরকার।
১০ দফা-
১. অবিলম্বে বর্তমান অনির্বাচিত জাতীয় সংসদকে বিলুপ্ত করে ক্ষমতাসীন সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে এবং ১৯৯৬ সালে সংবিধানে সংযোজিত ধারা ৫৮-খ, গ ও ঘ এর আলোকে নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ একটি অন্তর্বর্তীকালীন কেয়ারটেকার সরকার গঠন করতে হবে;
২. কেয়ারটেকার সরকার বর্তমান নির্বাচন কমিশন বাতিল করে সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করবে। উক্ত নির্বাচন কমিশন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অনিবার্য পূর্বশর্ত হিসেবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আরপিও সংশোধন, ইভিএম পদ্ধতি বাতিল ও পেপার ব্যালট এর মাধ্যমে ভোটের ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল করতে হবে;
৩. বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ সকল বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মী, আলেম-উলামা, মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিকদের সাজা বাতিল, সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতন বন্ধ ও সকল রাজনৈতিক কারাবন্দীদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে;
৪. অবিলম্বে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ সকল দলের অফিস খুলে দেয়া, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে স্থগিতকৃত জামায়াতের নিবন্ধন ও প্রতীক ফিরিয়ে দেয়া এবং দেশে রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক সভাসহ সকল ধরনের সভা-সমাবেশ ও মত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সব দলকে স্বাধীনভাবে গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে প্রশাসন ও সরকারি দল কর্তৃক সকল প্রকার হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। স্বৈরাচারী কায়দায় বিরোধী কণ্ঠকে স্তব্ধ করার লক্ষ্যে নতুন মামলা ও নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার বন্ধ করতে হবে;
৫. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮, সন্ত্রাস দমন আইন-২০০৯ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪সহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী সকল কালা-কানুন বাতিল করতে হবে;
৬. বিদ্যুৎ, জ্বালানি, গ্যাস, সার ও পানিসহ সেবা খাতসমূহে মূল্যবৃদ্ধির গণবিরোধী সরকারি সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে এবং কৃষি ও শিক্ষা উপকরণ, শিশুখাদ্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনয়ন ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারকে সিন্ডিকেটমুক্ত করতে হবে। মুদ্রাস্ফীতির আলোকে শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য মজুরী নিশ্চিত করা, নারী-শিশু নির্যাতন, শিশুশ্রম বন্ধ করা ও কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে;
৭. গত ১৫ বছরব্যাপী বিদেশে অর্থ পাচার, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত ও শেয়ার বাজারসহ রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্নীতি চিহ্নিত করার লক্ষ্যে একটি স্বাধীন শক্তিশালী কমিশন গঠন করতে হবে। সুদ, ঘুষ বন্ধ করাসহ ছাত্র-যুবসমাজের চরিত্র রক্ষা ও মাদকের ছোবল থেকে যুব সমাজকে উদ্ধার এবং ধর্মীয় শিক্ষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে;
৮. গত ১৫ বছরে গুমের শিকার সকল নাগরিকদের উদ্ধার করতে হবে এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন বন্ধ ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনার আইনানুগ বিচারের ব্যবস্থা করে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর, উপাসনালয় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও সম্পত্তি দখলের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়ায় শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে;
৯. আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ও পেশাদারিত্বের সাথে দায়িত্ব পালনের উপযোগী করার লক্ষ্যে সরকারি হস্তক্ষেপ পরিহার করে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে;
১০. সীমান্ত হত্যা বন্ধ ও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং জাতিকে দ্বিধা-বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র বন্ধ করে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।
আমিরে জামায়াত উপরোক্ত ১০ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে আগামী ২৪ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভাগীয় শহর ও জেলায় জেলায় গণমিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, পর্যায়ক্রমে আরো কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে ইনশাআল্লাহ। এ কর্মসূচি সফল করে তোলার জন্য তিনি সকল রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, শ্রমজীবী, পেশাজীবীসহ সর্বস্তরের জনগণের সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করেন।
কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া সেক্রেটারি এবং কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মতিউর রহমান আকন্দের সঞ্চালনায় নেতৃবৃন্দের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি ডা: সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো: তাহের, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এ টি এম মা’ছুম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি হামিদুর রহমান আযাদ, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য নূরুল ইসলাম বুলবুল এবং ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমির ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সেলিম উদ্দিন।