বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে হিমালয়ের মত দাড়িয়ে গেছে বিএনপি
শামসুল আলম
সীমাহীন বাধা অতিক্রম করে ১০টি মহাসমাবেশ শান্তিপূর্ণ ও সফলভাবে সম্পন্ন করার ভেতর দিয়ে রাজনীতিতে এককভাবে দাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি। কিছুদিন আগেও যে দলটিকে বলা হলো ’মুসলিম লীগ’ হয়ে গেছে, বা জামায়াত-নির্ভর দল হিসাবে ট্যাগ করা হতো, সেই দলটি এখন বাংলাদেশের ”ওয়ান এন্ড অনলিতে” পরিণত হয়েছে, যারা বাংলাদেশকে একাই যেনো দিকে ড্রাইভ করতে সক্ষম, কোনো সরকারী বাহিনী বা অস্ত্র ছাড়াই। কেবল দেশের জনগনের কাছেই টপ ফেভারেট নয়, বিদেশীদের কাছেও বিএনপি এখন একক বৃহত্তম শক্তি হিসাবে আবির্ভুত হয়েছে। অনেকে যাকে বলেন ছাই থেকে ফিনিক্স পাখির পূণর্ভাবের মতো।
চরম বাধাবিঘ্ন অত্যাচরের মুখেও সফলতা_____
বিএনপি আগেই বলছিল ১০ তারিখে ঢাকায় বিভাগীয় মহাসমাবেশ করবে, কিন্তু সরকার এটিকে ভয় পায় তাদের পতনের ”দড়ি ধরে মারো টান” হিসাবে। তাই এ প্রোগ্রাম বানচাল করতে সর্বপ্রকারের বাধা বিঘ্ন বিপত্তি হুমকি অত্যাচার করে বিএনপিকে কিনারে ঠেলে দেয়।
প্রথমেই বিনাভোটের প্রধানমন্ত্রী হুমকি দেন, শাপলা চত্তরের মত বিএনপিকে দমন করা হবে। একই কথা তার কৃষিমন্ত্রী রাজ্জাক উচ্চারণ করেন বার বার। এরপরে শুরু হয় পুলিশী ধমকাধমকি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে আইজিপি, পুলিশ কমিশনার, এমনকি তার নিচের অফিসাররাও ক্রমাগতভাবে হুমকি ছাড়তে থাকে- পল্টনে কর্মসূচি করতে দিব না। এরপরে সরকার অবশ্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বদ্ধ খাঁচায় বিএনপিকে ঢোকাতে নানা ফন্দিফিকির অপচেষ্টা চালায়। কিন্তু বিএনপি ধরতে পারে দু’গেটঅলা আবদ্ধ স্থানে ঢুকিয়ে শাপলা চত্তরের মত ম্যাসাকার করার সরকারী ফন্দি ফিকির। এরপরেও চরম হুমকি ও বাড়াবাড়ির পরে বিকল্প ভেন্যু খোঁজার মধ্যেই বিএনপির প্রধান অফিসে বর্বরভাবে পুলিশ ও দলীয় সন্ত্রাসীদের দিয়ে হানা দিয়ে হত্যা, শত শত আহত এবং গ্রেফতার ও বোমা নাটক করার মত ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়ে শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় কলঙ্কতিলক পড়েন। মাঝরাতে হানাদারী স্টাইলে ঘুম ভেঙে বলপূর্বক ধরে নিয়ে যায় বিএনপি মহাসচিব এবং স্টান্ডিং কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে। এ ছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ের চার হাজারের অধিক নেতা ও সংগঠককে গ্রেফতার করে, গায়েবী মামলা দেয় হাজার হাজার। তখনও ভেন্যু দেয়া হয়নি অথচ পুলিশী ব্যাকআপে সারা শহরে লাঠিসোটা অস্ত্র নিয়ে নামিয়ে দেয় সরকারী গুন্ডা মস্তানদের। এ অবস্থায় আগেরদিন সন্ধ্যায় যখন গোলাপবাগান মাঠে স্খান ঘোষণা হয়, তা ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পূর্ণ হয়ে যায়। আধো অন্ধকারের মধ্যে চলে মঞ্চ নির্মানের কাজ। রাতের মধ্যে লাখো জনতায় ভরে ওঠে গোলাপবাগ মাঠ এবং আশেপাশের এলাকা।
নেতাহীন কর্মীনির্ভর সাফল্য_____
দলীয় চেয়ারপারসন বানোয়াট মামলায় কারান্তরীণ, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নির্বাসনে, মহাসচিব ও স্টান্ডিং কমিটি মেম্বাররা জেলে, নগর কমিটির সভাপতি সেক্রেটারি জেলে, ঢাকা, নরসিংদি, গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি সেক্রেটারী সহ চার শত সংগঠক কেন্দ্রীয় অফিস থেকে একদিনেই গ্রেফতার, এ অবস্থায় শুধূু কর্মীদের ওপর ভর করে এত অল্প সময়ে এতবড় একটি মেগাসমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে সফল করে বিএনপি, যার মূল সংগঠক ও নেতৃত্ব দিয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। অনেক সমালোচকরাও মনে করছেন, হাসিনা সরকারে এতবিধ শক্ত বাধা পার হওয়ার ফলেই তারেক রহমানের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
প্রতিপক্ষের ডিমোশন_____
‘বিএনপিকে মহাসমাবেশ করতে দিবনা’, (গণহত্যা চালিয়ে) হেফাজতের মত শিক্ষা দেয়া হবে এমন হুমকি দিয়ে তারেক রহমানের কৌশলী যোগ্যতা ও নেতৃত্বের কাছে দারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন আওয়ামী নেত্রী, যিনি এর আগে রাজনীতি করতেন তারেক রহমানের মায়ের বিরুদ্ধে, ২০১৮ সলের পরে করেন তারেক রহমানের প্রতিপক্ষ হয়ে, আর শেষে মাত্র দু’মাসের মধ্যেই তার ডিমোশন হয় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল পর্যায়ে। ৯টি মহাসমাবেশ সফল করে মির্জা ফখরুল যে প্রখর দ্যুতি ছড়াতে থাকেন, তাকে পাল্লা দিতে ৫ বছর ধরে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী শেখ হাসিনাকে নেমে আসতে হয় আগারগাঁয়ে যেখানে ২২ হাজার চেয়ারের অর্ধেকই থাকে খালি, যশোরে, কক্সবাজারে, এবং চট্টগ্রামে বিরিয়ানি, টাবাপয়সা, চাউল, ডিম ছড়িয়ে। সর্বশেষে “হাত-পা ভেঙে দাও, পুড়িয়ে ফেলো”, সংবাদপত্রগুলিকে “তেল মারেও কি” এমন হুমকি দিয়ে নিজের দৈণ্যদশাকে প্রকট করে তুলেছেন। লীগের এহেন অস্থিরতা এবং দিশাহারা দৌড়াদৌড়ি বিএনপির রাজনীতির একটি দৃশ্যমান সফলতা।
সরকার ও ভারতের মাথানষ্ট_____
বিএনপি একবারও বলেনি যে ১০ ডিসেম্বরেই সরকারের পতন ঘটাবে। তবে কর্মী সমর্থক শুভাকাঙ্খীদের অনেক রকম আশা আগ্রহ থাকতেই পারে। অথচ বিনাভোটের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সরকারের মেশিনারীজ পুরোটাই একরকম নিশ্চিতই ছিল যে, ১০ তারিখেই সরকারের পতন ঘটবে। তাই ভয় পেয়ে দিল্লিকে SOS পাঠায়, ফলে ভারত তার গোয়েন্দা সংস্থা র-য়ের চীফ সামন্ত গোয়েলকে ঢাকায় পাঠায় তাকে রক্ষা করতে। ১৯৭৫ সালে পটপরিবর্তনের পরে আওয়ামীলীগ যেমন কোনো প্রতিরোধ করতে পারেনি, সেই শিক্ষা থেকে এবারে পতন বা তেমন ঘটনা ঘটলে সম্ভাব্য প্রতিরোধ করতে সারা দেশ থেকে ৪০ হাজার পুলিশ জড়ে করে ঢাকায়, যার বেশির ভাগই আ’লীগ আমলে রিক্রুট। অন্যদিকে ১০ হাজার অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ যুবলীগ ক্যাডার জড়ো করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেগুনবাগিচা এলাকায়, এদের মধ্যে শুটার, স্নাইপার, কিলার ছিল অনেক। কিন্তু বিএনপি সঠিক সময়ে খবর পেয়ে কোনোপ্রকার হঠকারিতায় পা দেয়নি, ফলে সরকারের যে ম্যাসাকার প্লান ছিল শত শত হত্যা করে (ট্রাকে ট্রাকে লাশ ফেলার হুকুম) বিএনপিকে হেফাজত বানানো হবে- ব্যর্থ করে দেয়।
স্যাংশন আছে, স্যাংশন নাই_____
২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের র্যাব, সাত পুলিশ ও সেনাকর্মকর্তার ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারী করে যুক্তরাষ্ট্র। এরপরে সরকারের গুম, ক্রসফায়ারে সংখ্যা কমে যেতে থাকে, যার সরাসরি বেনিফিট পায় বিএনপি, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, এবছর ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবসে বাংলাদেশের আরও কিছু পুলিশ গোয়েন্দাদের ওপর নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা আসতে পারে। কিন্তু এবারের ১০ তারিখ শেষে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের স্যংশন লিস্টে বাংলাদেশের নাম আসেনি। ফলে বিরোধী কিছুটা শিবিরে হতাশা এবং সরকারী শিবিরে আনন্দ উচ্ছাস পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশের ওপর স্যাংশন তৈরি থাকলেও তা ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকাশ করা হয়নি, তার কারণ যুক্তরোষ্ট্রে ভারতীয় অরিজিন ২০০ ল’মেকার আছে, তাদের কিছু কিছুকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের স্যাংশন লিস্টটি ১০ ডিসেম্বরে ওয়েবসােইটে দেয়া থেকে বিরত রাখা হয়। কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, এই তালিকা ঘোষণায় বাংলাদেশের চলমান সরকার বিরোধী আন্দোলনে একটি পক্ষকে সমর্থন যোগানো বোঝাবে, তাই কর্মসূচিটি পার হওয়ার পরে যেন ওয়েবসাইটে দেয়া হয়। মূলত ট্রেজারী ডিপার্টমেন্টের স্যাংশন ঘোষণা একটি নিয়মিত প্রসেজ, যা যথাসময়ে পাবলিশ হবে। দেখা যাবে, এটি প্রকাশের পরে বাংলাদেশে জুলুমবাজ ও মানবাধিকার হরণকারীদের আবার দৌড়ঝাপ দেখা যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তায় বাংলাদেশ_____
তবে স্যাংশন দৃশ্যমান হতে সময় নিলেও এর চেয়েও শক্ত কিছুর ইঙ্গিত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর তা হলো, বাংলাদেশ পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তায় (National Sesurity) অন্তর্ভুক্ত হওয়া। বিএনপির আন্দোলন এবং সরকারের নিবর্তন নিয়ে হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক মুখপাত্র জেনারেল জন কিরবি ৯ ডিসেম্বর (অর্থাৎ বিএনপির সমাবেশের ঠিক আগে) বলেন, “হোয়াইট হাউজ বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং অত্যন্ত গভীরভাবে সবকিছু লক্ষ রাখছে।’ কূটনীতিতে সাধারণত closely বা মনিটরিং শব্দ ব্যবহারই যথেষ্ট, কিন্তু বিস্ময়করভাবে হোয়াইট হাউজ “very, very closely,” শব্দগুলি ব্যবহার করেছে, যা অত্যন্ত কঠিন কিছুকে নির্দেশ করে।
হতাশা ও আশা_____
বিএনপির অনেকের মধ্যে হতাশা শুরু হয়েছে যে, সরকারের পতন তো ঘটলো না। কিন্তু তাদেরকে বুঝতে হবে, বিএনপি একবারও বলেনি ১০ তারিখেই পতন ঘটাবে। সরকার পতন ঘটাতে হলে যে সকল ধারাবাহিক পদক্ষেপসমুহ নিতে তার সবগুলো নেয়া তখনও বাকী ছিল। প্রথমত, জাতীয় দাবী, সেটি গতকাল তোলা হয়েছে, দ্বিতীয়ত অন্য সকল দল গোষ্ঠিকে অন্তর্ভুক্ত করা, গতকাল যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা এসেছে। তৃতীয়ত, অন্যের পদত্যাগ চাইতে হলে আগের নিজের লোকদের পদত্যাগ করাতে হয় , সেটিও গতকাল হয়ে গেছে (এরপরে বিএনপির আন্তরিকতা নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন থাকবে না)। বন্ধুদের সমর্থন, এটি নিয়ে ওপরে বর্ণনা করা হয়েছে।
দল হিসাবে বিএনপির দায়িত্ব_____
সার্বিক অবস্থার আলোচনা করে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস গতকাল তাদের মন্তব্যে লিখেছে, বাংলাদেশ এখন রাজনৈতিক পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে, যেমনটা ২০০৯ সালের পর আর প্রত্যক্ষ করা যায়নি। ফলে এই রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটানো বিএনপির পবিত্র দায়িত্ব হয়ে দাড়িয়েছে। জনগনকে সাথে নিয়ে বিদেশী বন্ধুদের সমর্থনে (ঢাকায় এ নিয়ে অনেক মিটিং সিটিং হয়েছে) এই পরিবর্তন অচিরেই ঘটবে এমন প্রত্যাশা সকলের।