মুসলিম রেনেসাঁর প্রখ্যাত কবি ফররুখ আহমদের ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকী ১৯ অক্টোবর
ইঞ্জিনিয়ার একেএম রেজাউল করিম: মুসলিম জাগরণের কবি, বাংলা জাগরণের কবি ফররুখ আহমদ ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।ফররুখ আহমদ ছিলেন বাংলাদেশের কবি, গণমানুষের কবি । তার কবিতায় বাংলাভাষা ও বাংলাদেশের মানুষের জীবনচিত্র অসাধারণভাবে ফুটে উঠেছে। তার কবিতায় তিনি তুলে এনেছেন বাংলার শেকড় ও সংস্কৃতি। তিনি ছিলেন বাংলা কাব্য-সাহিত্যের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। আমাদের সাহিত্য-ইতিহাসের স্বল্পালোচিত ব্যক্তিদের অন্যতম। বাংলা কাব্যে তাঁর আসন তর্কাতীতভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত। নজরুলের মতই বাংলা কাব্যগগণে তাঁর আবির্ভাব ছিল ধূমকেতুর মত।
মাইকেল তার কাব্যকাহিনী গড়ে তুলতে যেমন মহাভারত ও রামায়ণের মতো গ্রন্থ বেছে নিয়েছিলেন; ফররুখ তেমন সামনে টেনেছিলেন বিশ্ব মুসলিম সাহিত্য, আলিফ লায়লা ও হাতেম তাই এর মতো কাহিনীর। উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়ার দিকে মুসলিম জাগরণের যে স্রোত প্রবাহিত হয়, তিনি তার প্রত্যক্ষ ফসল। সেই সাথে গেয়েছেন মানবতার জয়গান। আযানের মতো উদাত্ত স্বরে তার আহবান ধ্বনিত হয়েছে জাতির উদ্দেশ্যে।
রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?
সেতারা, হেলাল এখনো উঠেনি জেগে?
তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।(পাঞ্জেরী, সাত সাগরের মাঝি)
কবি ফররুখ ছিলেন গণজাগরণের কবি। তিনি মানুষের মধ্যে চেতনাবোধ তৈরি করে গেছেন। স্বাধীনতা, সাম্য ও মুক্তির চেতনা। আজকে কবিদের মধ্যে সেই জাগরণ নেই। দেশের মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা নেই। চলাফেরার স্বাধীনতা নেই। কিন্তু কবি-সাহিত্যিকেরা নীরবতা পালন করছেন। ফররুখ বেঁচে থাকলে অবশ্যই জাগরণের কথা বলতেন।
ফররুখ আহমদ বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষার একজন প্রখ্যাত মৌলিক কবি। বাঙালি ‘মুসলিম রেনেসাঁর কবি’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন ফররুখ। তার কবিতায় বাংলার অধঃপতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের অণুপ্রেরণা প্রকাশ পে বিংশ শতাব্দীর এই কবি ইসলামী ভাবধারার বাহক হলেও তাঁর কবিতা প্রকরণকৌশল, শব্দচয়ন এবং বাক্প্রতিমার অনন্য বৈশিষ্টে সমুজ্জ্বল। আধুনিকতার সকল লক্ষণ তার কবিতায় পরিব্যাপ্ত। রোমান্টিকতা থেকে আধুনিকতায় উত্তরণের ধারাবাহিকতায় ফররুখ আহমদের সৃষ্টিশীলতা মৌলিক বলে সর্বজন স্বীকৃতি পেয়েছে।
একটি জাতির ঐতিহ্য ও ইতিহাস চেতনা জাতির অস্তিত্বের জন্য অতীব প্রয়োজন। ঐতিহ্য মূলতঃ কোন আরোপিত সম্পদ নয়, গ্রহণ, বর্জন ও অর্জনের মাধ্যমেই তার ব্যাপ্তি; সুতরাং ঐতিহ্যের মূল সম্পদকে গ্রহণ করে এবং তা পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মাধ্যমে ব্যাপ্ত করে যে সাহিত্য রচিত হয় তার মজবুত স্থাপন ও স্থায়ী মূল্য অপরিসীম। টিএস এলিয়ট ও আইরিশ কবি ডাব্লিউ বি ইয়েটস দেখিয়ছেন ঐতিহ্য কবিতার জন্য কত গভীর তাৎপর্য বহন করে। সাহিত্য সৃষ্টিতে ঐতিহ্য অবলম্বনকারী বিখ্যাত ইংরেজ কবি ইয়েটস ও এলিয়ট, উর্দু মহাকবি ইকবাল এবং বাংলার কবি মধুসূদন ছিলেন ফররুখের প্রিয় কবিদের সূচীতে শীর্ষ অবস্থানে।
কবি ফররুখ আহমদের সমসাময়িক ও সহকর্মীদের সমগ্র উদ্যোগ ঐতিহ্য চেতনা মন্ডিত সাহিত্য সৃষ্টিতে যতখানি ভূমিকা রেখেছে, তার চেয়ে অধিক তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছে ফরুখ আহমদের একক সৃজনবুদ্ধি ও ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টা। নিছক আবেগ আতিশয্য প্রবাহে কবি এ পথে বেরিয়ে পড়েননি। কবির কাব্য প্রতিভার সাথে ঐতিহ্যবোধ ও গভীরতর বিশ্বাসের সমন্বয় সাধনই তাঁকে এ পথে বিচরণে সার্থক করেছে। কবির বিশ্বাসের সাথে আলোকের ও বাণীমূর্তিও দৃঢ়তর বন্ধন জাতীয় কাব্য সৃষ্টির ভূমিকায় এতটা সফলতা প্রদান করেছে।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মৌলিক প্রতিভার অধিকারী শক্তিমান কবি ফররুখ আহমদ বৃহত্তর যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার (বর্তমানে জেলা) অন্তর্গত মাঝআইল গ্রামে ১৯১৮ সনের ১০ জুন জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সনের ১৯ অক্টোবর তিনি ঢাকায় ইন্তিকাল করেন। বাংলা কাব্যে তাঁর অবদান বিপুল ও নানা বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্যে অনন্যসাধারণ।
তার পিতা সৈয়দ হাতেম আলী এবং মাতা বেগম রওশন আখতার। পুলিশ ইন্সপেক্টর সৈয়দ হাতেম আলী আই.এ. পাশ করেই চাকরিতে যোগ দেন। প্রাচীন শিক্ষিত পরিবার হিসেবে গ্রামে তাঁদের ব্যাপক সম্মান ও খ্যাতি ছিল। ফররুখ আহমদের দাদা ছিলেন সরকারী চাকরিজীবী আর দাদী ছিলেন তৎকালীন সময়ের শিক্ষিত জমিদার কন্যা। সৎ মানুষ হিসেবে পরিচিত হাতেম আলীর দুই স্ত্রী। প্রথম স্ত্রীর ঘরে পর পর তিনটি মেয়ে জন্মের পর রমজান মাসে ফররুখ আহমদের জন্ম হয়। এই জন্য দাদি তাঁকে আদর করে রমজান বলে ডাকতেন। ফররুখ ছিলেন সচ্ছল পরিবারের সন্তান। ছয় বছর বয়সে ১৯২৪ সালে মাতৃহারা হয়েছিলেন ফররুখ। প্রথম পক্ষের স্ত্রী মারা যাবার পর দ্বিতীয় বিয়ে করেন তার পিতা সৈয়দ হাতেম আলী। ১৯৪৩ সালে ফররুখের বাবা ইন্তেকাল করেন। তাঁর দাদিও ঐ বছর মারা যান।
বাল্যকালে মাঝআইল গ্রামের পাঠশালাতেই ফররুখ আহমদের শিক্ষাজীবনের হাতে খড়ি। ফারসি-জানা এক মহিলা বাড়িতে এসে তাঁকে ধর্মীয় শিক্ষা দিতেন। পরবর্তীতে কলকাতায় এসে তালতলা মডেল এম. ই. স্কুলে ভর্তি হন। এরপর কলকাতার বিখ্যাত বালিগঞ্জ সরকারী হাইস্কুলে ভর্তি হন। পরবর্তীতে তিনি খুলনা জেলা স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই ১৯৩৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৩৯ সালে তিনি কলকাতা রিপন কলেজ থেকে আই. এ পাস করেন। কলকাতা স্কটিশ চার্চ কলেজ ও সিটি কলেজেও পড়াশুনা করেছেন তিনি। আই. এ পাস করার পর প্রথমে তিনি দর্শন ও পরে ইংরেজীতে অনার্স নিয়ে বি. এ তে ভর্তি হন। ইংরেজী সাহিত্যে বেশ কিছু দিন অধ্যয়ন করলেও শেষ পর্যনত্ম তাতে তিনি পরীক্ষা দিতে পারেননি।
ব্যাক্তিগত জীবনে ১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসে আপন খালাতো বোন সৈয়দা তৈয়বা খাতুন (লিলি)-এর সঙ্গে ফররুখ আহমদের বিয়ে হয়। তাঁর নিজের বিয়ে উপলক্ষে ফররুখ ‘উপহার’ নামে একটি কবিতা লেখেন যা ‘সওগাত’ পত্রিকায় অগ্রহায়ণ ১৩৪৯ সংখ্যায় ছাপা হয়।
ফররুখ আহমদের ছেলে-মেয়ে ১১ জন। তাঁরা হলেন- সৈয়দা শামারুখ বানু, সৈয়দা লালারুখ বানু, সৈয়দ আবদুল্লাহল মাহমুদ, সৈয়দ আবদুল্লাহেল মাসুদ, সৈয়দ মনজুরে এলাহি, সৈয়দা ইয়াসমিন বানু, সৈয়দ মুহম্মদ আখতারুজ্জামান (আহমদ আখতার), সৈয়দ মুহম্মদ ওয়হিদুজ্জামান, সৈয়দ মুখলিসুর রহমান, সৈয়দ খলিলুর রহমান ও সৈয়দ মুহম্মদ আবদুহু।
ফররুখ আহমদকে বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে মূল্যায়ন করার প্রয়াস পেয়েছেন। কেউ তাঁকে ‘ইসলামী রেনেসাঁর কবি’ কেউ ‘মুসলিম নবজাগরণের কবি’, কেউ ‘মানবতাবাদী কবি’ ইত্যাদি নানা অভিধায় বিশেষায়িত করেছেন। এর কোনটিই অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রত্যেকের মূল্যায়নই তথ্যভিত্তিক, যুক্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ফররুখ এক ও অবিভাজ্য-আলাদা আলাদাভাবে তাঁকে বিশ্লেষণ করার সুযোগ নেই। ফররুখের নিকট ‘ইসলাম’, মুসলিম’, ‘মানবতাবাদ’, এসবই মুদ্রার বিভিন্ন দিক মাত্র। তিনি দৃঢ়ভাবে ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন এবং গভীর নিষ্ঠার সাথে তাঁর জীবনে ও কর্মে এর প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। ইসলামে বিশ্বাসের কারণেই তিনি মুসলিম জাতির নবজাগরণ প্রত্যাশা করেছেন এবং ইসলাম থেকেই তিনি মানবতাবাদের প্রেরণা লাভ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ইসলাম আল্লাহ-প্রদত্ত এক অভ্রান্ত জীবনাদর্শ। একমাত্র ইসলামই মানবজাতির সকল সমস্যার সুষ্ঠু, সুন্দর সমাধান দিতে সক্ষম। এতে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকল মানুষের মুক্তি ও কল্যাণ সুনিশ্চিত। সে কারণেই তিনি একাধারে ইসলামে বিশ্বাসী, মুসলিম নবজাগরণের নকীব ও মানবতাবাদের বলিষ্ঠ প্রবক্তা।
কবি ফররুখ আহমদ প্রথম জীবনে প্রখ্যাত মানবতাবাদী কমরেড এম. এন. রায়ের শিষ্য ছিলেন। কিন্তু জন্মসূত্রে ইসলামী আদর্শ ও ঐতিহ্যের অধিকারী কবি ফররম্নখ আহমদ বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ধর্মীয় চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে পড়েন। এর বহিঃপ্রকাশ তাঁর সাহিত্য কর্মের মধ্যে অন্তর্নিহিত। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন সৎ, ধার্মিক, মানবতাবাদী ও অসাধারণ ব্যক্তিত্ববান কর্মপুরুষ। দেশ বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত কবি কলকাতায় ছিলেন। কলকাতায় থাকাকালীন ফররুখ আহমদ অনেকগুলি চাকরি করেছেন। তবে এসব কোনো চাকরিই বেশি দিন করেননি তিনি। তাঁর সবগুলি চকরি ছিল স্বল্পস্থায়ী। শুধুমাত্র ‘মোহাম্মদী’ ছাড়া অন্যগুলির কোনটিই তাঁর কবিমনের সঙ্গে খাপ খায়নি। ফররুখ আহমদ ১৯৪৩ সালে আই.জি.প্রিজন অফিসে, ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাইতে এবং ১৯৪৫ জলপাইগুঁড়িতে একটি ফার্মেও কিছু দিন চাকরি করেন। এর পর ১৯৪৫ সালে মাসিক ‘মোহাম্মদী’-র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। কিন্তু তাঁর একটি কবিতা সেই সময়কার ‘মোহাম্মদী’ ও ‘আজাদ’ সম্পাদক নিজের নামে ছাপানোর কারণে তিনি ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘মোহাম্মদী’-র চাকরি ছেড়ে দেন। এর পর ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে চাকরি করেন তিনি।
ইসলামী রেনেসাঁর কবি হিসাবে খ্যাত হলেও ফররুখ তাঁর কাব্য-কবিতায় সরাসরি ইসলামের কথা উচ্চারণ করেননি। প্রতীক ও রূপকল্পের মাধ্যমে তিনি তাঁর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কাব্য-ভাষায়, অসাধারণ কাব্য-কুশলতায় যে বলিষ্ঠ ভাব ও আবেদন ফুটিয়ে তুলেছেন, তা ইসলামের ব্যঞ্জনাকেই প্রমূর্ত করে তোলে। এখানেই তাঁর অনন্যসাধারণ কৃতিত্ব ও বিস্ময়কর প্রতিভার মহিমাময় অত্যুজ্জ্বল প্রকাশ।
আধুনিক বাংলা কাব্য মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-৭৩) থেকে সমুদগত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে (১৮৬১-১৯৪১) এসে পরিণতরূপ লাভ করেছে। কাজী নজরুল ইসলামে (১৮৯৯-১৯৭৬) তা নতুন বাঁক নিয়েছে। ভাব-বিষয়, ভাষা-ব্যঞ্জনায় নজরুল-কাব্য এক অভিনব অভিব্যঞ্জনা লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলামের সমকালেই পাশ্চাত্য কাব্যাদর্শে অনুপ্রাণিত তিরিশের কবিরা বাংলা কাব্যে আরেক নতুন সুর ও অনুরণন সৃষ্টি করেছেন। তিরিশের উজ্জ্বলতম কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাস (১৮৯৯-১৯৫৪), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-৬১), অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-৮৬), প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-৮৮), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৪), বিষ্ণু দে (১৯০৯-৮২), সমর সেন (১৯১৬-৮৭) প্রমুখ স্ব-স্ব বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হওয়া সত্ত্বেও সকলেই চেয়েছিলেন রবীন্দ্র-প্রভাব থেকে মুক্তি। তাঁরা নজরুলের কাব্যিক উচ্চারণ ও উত্তাপে অনুপ্রাণিত হওয়া সত্ত্বেও নজরুলের ভাব-ভাষার সাথে তাঁরা কখনো সাজুয্য খুঁজে পাননি। নজরুল তাঁর ভিন্ন সামাজিক পটভূমি ও বিশ্বাসের কারণেই তিনি অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছেন।
তিরিশোত্তর যুগে বাংলা কাব্যে আরেক ভিন্ন ধারার কবি জসীমউদ্দীন (১৯০৩-৭৬)। তিনি এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ধারার অনুসারী বা প্রবর্তক। তিনি পল্লী-জীবনের চিত্র, পল্লীর সাধারণ মানুষ, ভাব ও বিষয়কে ধারণ করে সাধারণ গণ-মানুষের ভাষায় তাঁর কাব্যের বিচিত্র ভুবন রচনা করেছেন। নজরুলের সাথে তাঁর কিছুটা সাজুয্য থাকলেও ভাব-ভাষা-উচ্চারণ ও কাব্যিক স্নিগ্ধতায় তিনি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক উজ্জ্বল কবি-প্রতিভা। বাংলা সাহিত্যে তিনি ‘পল্লীকবি’ হিসাবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করলেও মূলত তিনি একজন নিজস্ব ধারার আধুনিক কবি।
কাব্য-ক্ষেত্রে ফররুখ আহমদের যখন আবির্ভাব-তখন রবীন্দ্রনাথের জীবনাবসান ঘটেছে, নজরুল বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। জসীমউদ্দীন ও তিরিশোত্তর যুগের কবিদের তখন প্রবল দাপট চলছে। তা সত্ত্বেও ফররুখ আহমদ তাঁর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে আবির্ভূত হয়ে সকলের সপ্রসংশ দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁর এ বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয়েছে কাব্যের বিচিত্র রূপরীতি, শিল্প-নৈপুণ্য, রূপক-উপমা-প্রতীক-রূপকল্পের অভিনব ব্যবহার ও নিজস্ব কাব্য-ভাষা নির্মাণের অসাধারণ সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে। তিনি একাধারে গীতি কবিতা, সনেট, ব্যঙ্গ কবিতা, গান-গজল, শিশুতোষ কাব্য, মহাকাব্য, কাব্যনাট্য, গীতিনাট্য, ব্যঙ্গনাট্য ইত্যাদি রচনা করেছেন। তিনি মূলত রোমান্টিক, কিন্তু তাঁর কিছু কিছু কাব্য কবিতায় ধ্রুপদ বৈশিষ্ট্যের ছাপ স্পষ্ট। ইংরেজি সাহিত্যের মেধাবী ছাত্র হিসাবে তিনি একাধারে আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের শিল্প-বৈশিষ্ট্যের সাথে আধুনিক বাংলা কাব্যের উজ্জ্বলতম শিল্প-বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় ঘটিয়ে সফল কাব্য-চর্চায় ব্রতী হয়েছেন।
ফররুখ ও মুসলিম রেনেসাঁস
১৭৫৭ সালে পলাশীর ঘটনা, ১৮৫৭-৫৮ সালে ভারতের আজাদী আন্দোলন, পরবর্তী দিনগুলোতে ব্রিটিশ বিরোধী বিভিন্ন তৎপরতা, ১৯২৩ সালে তুরস্কে দীর্ঘকালের মুসলিম খেলাফতের অবসান প্রভৃতি ঘটনাবলি ফররুখ আহমদকে প্রভাবিত করেছিল দারুণভাবে। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে রেনেসাঁয় জ্বলে উঠে ইউরোপ। তাদের অনুপ্রেরণা ছিল প্রাচীন গ্রিক ও রোমান শিক্ষা, শিল্প এবং সভ্যতা। ফররুখ আহমদ অনুপ্রেরণা খুঁজে পেয়েছেন নবম ও দশম শতকের বাগদাদ, কায়রো কিংবা কর্ডোবার ভাঁজে। আর তাই রুমি, ফেরদৌসি, জামী, কারবালা কিংবা শবে কদর অনায়াসে তার কবিতার বিষয়স্তু হয়ে উঠেছে। তার উদাত্ত বাণী,
ভেঙে ফেল আজ খাকের মমতা আকাশে উঠেছে চাঁদ
দরিয়ার বুকে দামাল জোয়ার ভাঙছে বালুর বাঁধ,
ছিঁড়ে ফেলে আজ আয়েশী রাতের মখমল-অবসাদ,
নতুন পানিতে হাল খুলে দাও, হে মাঝি সিন্দবাদ।- সিন্দবাদ, সাত সাগরের মাঝি
রেনেসাঁ মানে পুরেনোকে জাগিয়ে তোলা না। পুরাতন ভিতের উপর নতুন ব্যবস্থা ও নতুন পরিস্থিতিতে সামঞ্জশ্যপূর্ণ জাগরণ। ফররুখ তা বুঝতে পেরেছিলেন তীব্রভাবে।
কবি ফররুখ আহমদ ঐতিহ্য সচেতন ইসলামী পুনর্জাগরণের কবি। ঐতিহ্য চেতনাকে উজ্জীবিত করার প্রয়াসে অনেক সময় তিনি তার রচনায় মরুচারিতা, সমুদ্রাভিযান ও আরব্য আবহ নির্মানে সচেষ্ট হয়েছেন। কবি মুসলিম জাগরণের নায়ক ও ইসলামী সংস্কৃতির তুর্যবাদকদের অভিনন্দন যানিয়ে যে কবিতা রচনা করেছেন তাতে রয়েছে মুসলিম ঐতিহ্য ও মরুচারিতার মনোহর প্রতিচ্ছবি। কবি কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে-
“তোমরা এনেছো জ্যোছনা- ভেজানো স্বপ্ন-সবুজ শাখে
গভীর রাতের গূঢ় মোরাকাবা বন- ডাহুকীর ডাকে,
কোথা নলবনে চৌচির হয়ে বাঁশী যেতে চায় ফেটে,
কোথা জোলায়খা দেখায় মাশুক চাঁপার আঙ্গুল কেটে।
কোথা মজনুর বিরহী হৃদয়ে আকাশের নিরবতা
কোন ঝরোকায় শাহেরজাদীর ঘুম ভাঙ্গা রূপকতা,
নিশীত রাতের ঘনায়িত ব্যথা কোথা লাইলির প্রাণে,
মৌসুমী হাওয়া বলে গেছে বুঝি তোমাদের কানে কানে।
তোমাদের সুরে শুনেছি আমরা পথ চলবার বাঁশী
রুদ্ধ কপাটে যেখানে ঝঞ্ঝা বেজেছে সর্বনাশী।
ম্লান জড়তার জড়বাদ – বাঁধ ভাঙ্গে তোমাদের হাতে
গোলাব কলির ফুটবার খোঁজ দাও অমাবশ্যাতে
বন্ধু! তোমরা এনেছো দরদ উমরের বুক হতে
কল্পলোকের আকাশ ছেড়েও নেমেছো ধূলির স্রোতে।
দুর্গত জনগণের সঙ্গে বেঁটে নাও ব্যথা বিষ,
মরু ওয়েসিসে জাগাও তোমরা দোয়েলের মিঠে শিস্”
[দল-বাঁধা বুলবুলি, মাসিক মোহাম্মদী, জ্যৈষ্ঠ, ১৩৫০]
কবি মুসলিম জাগরণের নায়ক ও ইসলামী সংস্কৃতির তুর্যবাদকদের অভিনন্দন জানিয়ে রচনা করেছেন ‘সিরাজাম মুনিরা।’ তিনি লিখেছেন,-
‘আজকে উমর-পন্থী পথীর দিকে দিকে প্রয়োজন
পিঠে বোঝা নিয়ে পাড়ি দেবে যারা প্রান্তর প্রাণপণ ,
উষর রাতের অনাবাদী মাঠে ফসল ফলাবে যারা,
দিক- দিগন্তে তাদেরে খুঁজিয়া ফিরিছ সর্বহারা। ’ [উমর- দারাজ দিল।]
অন্য যায়গায় লিখেছেন-
‘তাঁর তক্বীরে কাঁপে অম্বর ফাটে মরু -প্রান্তর ,
গর্জে খোদার সিংহ: আল্লা, আল্লাহু আক্ব।
নবীজীর পাশে আল্লার সেনা এল আলী হায়দার।’
[আলী হায়দার। ]
কবিতায় ঐতিহ্যের এমন রূপায়ণে ফররুখ আহমদের ভূমিকা আধুনিক কবিদের সবার শীর্ষে বললে অত্যুক্তি হবে না। মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ লিখেছেন: “মুসলিম ঐতিহ্যের ছায়া-ঘেরা এই অপূর্ব অবদান কবিকে, চিরদিনের জন্য স্মরণীয় কর রাখবে সন্দেহ নেই।” কবিতায় ঐতিহ্যের এমন নবরূপায়ণে ফররুখ আহমদের ভূমিকা আধুনিক কবিদের সবার শীর্ষে বললে অত্যুক্তি হবে না। তিনি পুঁথি সাহিত্যের শব্দ সম্ভার, উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও চিত্র কল্পকে অবলম্বন করে আধুনিক কাব্য রচনার প্রচেষ্টায় সফলকাম ও স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব।
কবি ফররুখ আহমদের প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’র রচনা কাল ১৯৪৩-৪৪ সাল। অশিক্ষিত, অবহেলিত ও দুর্দশার পঙ্কে নিমজ্জিত বাঙ্গালী মুসলমানদেরকে উজ্জীবিত করার মানসেই রচিত হয়েছে ‘সাত সাগরের মাঝি।’ মুসলিম সম্প্রদায়ের জীবন ও জীবনের অনুসংগগুলি স্বপ্নালোকে ও আদর্শকে রোমান্টিকতা ও আদর্শিকতার সমন্বয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন কবি তাঁর ‘সাত সাগরের মাঝিতে।’ বাংলা কবিতায় মুসলিম রেনেসাঁর যে সুরটি নজরুল ইসলাম সৃষ্টি করেছিলেন কবি ফররুখের ‘সাত সাগরের মাঝি’ তারই পরিপূরক। এ কাব্যে আরবের মরুময়তা ও বিখ্যাত আরব্য উপন্যাস ‘আলফা লায়লা ওয়া লায়লা’র প্রাণস্পর্শী চিত্র ফুটে উঠেছে মনোহারী রূপ নিয়ে। যেমন:
‘ভেঙে ফেলো আজ খাকের মমতা আকাশে উঠেছে চাঁদ,
দরিয়ার বুকে দামাল জোয়ার ভাঙছে বালুর বাঁধ,
ছিঁড়ে ফেল আজ আয়েশী রাতের মখমল -অবসাদ,
নতুন পানিতে হাল খুলে দাও, হে মাঝি সিন্দবাদ!’
ঐতিহ্য ও আদর্শিকতার এমন সফল সমন্বয় কাব্য জগতে সত্যই বিরল। কবি শামসুর রহমান বলেছেন: “ইসলামী ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনে যেসব কবি বিশ্বাসী ফররুখ আহমদ তাঁদের পুরোধ high Priest। ফররুখ আহমদের “সাত সাগরের মাঝি” আমাদের কাব্যসাহিত্যের একটি উজ্জ্বল বই। সর্বপ্রথম হলেও “সাত সাগরের মাঝি”ই এখন পর্যন্ত তাঁর সবচেয়ে পরিণত গ্রন্থ। এ কাব্য গ্রন্থেই তাঁর কাব্য শক্তির সবগুলো লক্ষণ বর্তমান। আরবী-ফারসী শব্দের সুনিপুণ ব্যবহার করে, পুঁথি সাহিত্য থেকে উপাদান সংগ্রহ করে তিনি নিজস্ব একটি ডিকসান তৈরী করতে সক্ষম হয়েছেন।”
কবি ফররুখ আহমদ মানবতাবাদী আদর্শ উজ্জীবনের জন্য ‘হেরার রাজ তোরণ’-এর দিকে প্রত্যাবর্তনের প্রয়োজনয়িতা অনুভব করেছেন গভীর ভাবে। কবি তাই বার বার সাতসাগরের মাঝিকে আহ্বান জানিয়েছেন ‘হেরার রাজ তোরণ’-এর দিকে ’তার কিশতি চালাতে। আশা করা যায় তা হলে সুন্দরতর দিনকে পুনরায় ফিরে পাওয়া যাবে। কবি তাই বলেন:
‘এখানে এখন রাত্রি এসেছে নেমে,
তবু দেখা যায় দূরে বহু দূরে হেরার রাজ-তোরণ,
এখানে এখন প্রবল ক্ষুধায় মানুষ উঠছে কেঁপে,
এখানে এখন অজস্র ধারা উঠছে দু’ চোখ ছেপে
তবু দেখা যাায় দূরে বহু দূরে হেরার রাজ-তোরণ। ’
[ সাত সাগরের মাঝি]
ফররুখ আহমদের কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ “সিরাজাম মুনিরা।” এর রচনা কাল ১৯৪৩-৪৬ সাল। উপমা ও চিত্রকল্পে মানবতার আদর্শকে তিনি অনবদ্যভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এ কাব্যে। “সাত সাগরের মাঝি”র কবি স্বপ্ন “সিরাজাম মুনিরা”তে খোলাফায়ে রাশেদীনের জীবনালোকে নতুন রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্নের মধ্যে দিয়েই প্রথম বাস্তবায়নের পথ খুঁজছে। মানবতাবাদী আদর্শেও উজ্জীবনের প্রত্যাশায় কবি মানবতার মুক্তির দিশারী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) এবং খোলাফায়ে রাশেদা সহ কয়েকজন গাউস-কুতুব, পীর ও মরমী সাধকদের মানবিক আদর্শ ও জীবন সৌন্দর্যকে এ কাব্যে ফুটিয়ে তুলেছেন। ত্যাগ তিতিক্ষা ও প্রেম-ভালবাসার যে আদর্শ তাঁরা মানুষের সামনে রেখে গেছেন তাকে প্রকৃত ইনসানের আদর্শ হিসেবে পেশ করছেন কবি ফররুখ। তিনি মানবতা বোধের জাগরণের জন্য গাইলেন:
“সত্য ন্যায়ের সে পথে ভাঙুক সব সংকীর্ণতা,
হারানো সে -দিন এ রাতের সাথে আবার বলুক কথা,
অসুক আবার এ হাতে আমার র্দোরা তলোয়ার
এই কলুষিত জীবনের বুকে হানিতে শেষ প্রহার।
এ নির্লজ্জ মানবতাহীন পশুদের যেথা ভিড়,
দ্বীনের রোশ্নি মুছে যারা টানে শামিয়ানা রাত্রির
সেথা ওমরের র্দোরা হানিয়া আনো পথ মুক্তির
আনো আজাদীর শুভ্রতা, ভাঙো শঙ্কা ধরিত্রীর।”
[উমর -দারাজ দিল]
মনীষী ভূদেব মুখোপাধ্যায় আমাদের স্বপ্রকৃতি সচেতন করবার অভিপ্রায়ে বলেছেন: “জাতিভেদে সর্বপ্রকার সাহিত্য রচনা রীতী ভিন্ন হয়। ইতিবৃত্ত প্রণয়নের প্রণালীও স্বতন্ত্র হয়।…..মূলত সকল জাতির কাব্য, ইতিহাস, দর্শন শাস্ত্রাদি তাহাদিগের বিশেষ জাতীয় লক্ষণ প্রকাশ করে।” এ কথাটি ফররুখ রচনাবলীতে সুস্পষ্টভাবে সত্য প্রমাণিত। অমুসলিম ও প্রাগ ইসলামী যুগের নানা চিত্র ও চরিত্রকে কবি আপন কল্পনায় আদর্শের প্রতীক রূপে চিত্রিত করেছেন। এমন এক চরিত্র ‘হাতেম তা’য়ী’। কবির কাব্য গ্রন্থ ‘হাতেম তা’য়ী ’রচিত হয়েছে প্রাগ ইসলামী যুগের আরবের কিংবদন্তী সৃষ্টিকারী এক সাধারণ মানুষ হাতেম তা’য়ীকে কেদ্র করে। পুঁথি সাহিত্যের সম্পদশালী অঙ্গকে ভিত্তি করে কাব্য রচনায় এবং পুঁথি সাহিত্যের নবরূপায়ণে ফররুখ আহমদের কৃতিত্ব উল্লেখ যোগ্য। কবি তাঁর এ কাব্যে সৈয়দ হামজার পুঁথি ‘হাতেম তা’য়ীর’ একটি প্রত্যক্ষ নিদর্শন ফুটিয়ে তুলেছেন তার স্বীয় বৈশিষ্ট্যে। পুঁথি সাহিত্যের শব্দ সম্ভার, উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও চিত্রকল্পকে অবলম্বন করে আধুনিক আঙ্গিকে কাব্য রচনার প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে ফররুখ আহমদ তুলনাহীন।
কবি মানবতা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নই দেখেছেনতাঁ ‘হাতেম তা’য়ী ’ কাব্যে। পূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার পথ বড়ই কন্টকাকীর্ণ। হাতেম তা’য়ীর সাধনা সেই বন্ধুর পথকে জয় করার সাধনা। এ সত্যই ফুটে উঠেছে ‘হাতেম তা’য়ী’ কাব্যে। কবি বলেন:
“অথবা কি সাধনায় পায় খুঁজে পূর্ণতা মানুষ,
বিপথে বিভ্রান্ত হয়ে মরে ফের কোথায় বেহুঁশ,
কি উপায়ে, কোন পথে কামালাৎ পায় খুঁজে প্রাণ ,
কোথায় অপূর্ণ সত্তা হয় পূর্ণ কামিল ইনসান,
অসত্যের অন্ধকার, -পার হয়ে তরঙ্গ ফেনিল
কোথায় জীবন -তরী পায় খুঁজে অভীষ্ট মঞ্জিল
কিম্বা হয় বানচাল কোন্খানে কেন কি কারণে
জেনে নিতে চাই আমি প্রাণের নিগূঢ় প্রয়োজনে।”
[ হাতেম তা’য়ী- পহেলা সওয়াল]
একটি সত্য এইযে, কবি সাহিত্যিকদের সৃষ্টি তাঁর সমকালকে যেমন ভাবে আন্দোলিত করে পরবর্তী সময়কে কখন তেমন তীব্রভাবে নাড়া দেয় না। কারণ মানুষের ভাবনা, বিশ্বাস, রুচিবোধ, জীবনবোধ সময় প্রবাহের সাথে নিরন্তর পরিবর্তিত হতে থাকে, নতুন ধারণা, নতুন অনুসঙ্গ জন্ম নেয় মানুষের মনে। কিন্তু এমন কিছু সৃষ্টি আছে যা কালের প্রাকার ডিঙ্গিয়ে বহুকাল মানুষের মনে দোলা দিতে থাকে। প্রাচীন অরবী সাহিত্যের এমন কিছু উপমা ও উপাদান যেন কবি চিত্তকে দোলা দিয়েছে। আরবী কবি ইমরাউল কায়েস লবঙ্গ ফুলকে তার কাব্যে উপমা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। “যখন তারা দু’জন দাঁড়াত তখন লবঙ্গের (কারাণ ফুর) গন্ধ বহন কারী পূবালী বাতাসের মতো (নাসিম) তারা মৃগনাভীর গন্ধ নিঃসরণ করত।” কবি ফররুখ লবঙ্গ ফুলকে আরবী কবির অনুকরণে নয় বরং নিজস্ব শৈলীতে তাঁর রচনায় স্থান দিয়েছেন। যেমন:
“তুমি কি ভুলেছ লবঙ্গ ফুল, এলাচের মৌসুমী,
যেখানে ধূলিতে, কাঁকরে দিনের জাফরান খোলে কলি,
যেখানে মুগ্ধ ইয়সমিনের শুভ্র ললাট চুমি
ঈরীর দেশের স্বপ্ন-সেহেলি জাগে গুলে বকাওলী।”
[সাত-সাগরের মাঝি]
আরবী সাহিত্যের সপ্তর্ষি মন্ডল যেন কবিকে বিমোহিত করেছে। আরবী সাহিত্যে জু’আর রুম্মার, ইবনুল মুতাজ, আল আসহাব বিন রুমাইলা, ইবনে তাসরিয়া প্রমুখ কবি তাঁদের কবিতায় সপ্তর্ষি মন্ডলের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। ফরুখ তাঁর কাব্যে সরাসরি সপ্তর্ষি মন্ডলকে চিত্রিত না করলেও সুরাত জামাল ও সেতারার কথা বার বার উচ্চারণ করেছেন। যেমন:
* ‘সুরাত জামাল জওয়ানির ঠোঁটে কেটেছে স্বপ্ন রাত
শুনেছি নেশার ঘোর কেটে যেতে এসেছে নয়া প্রভাত।’
[ সিন্দবাদ]
* ‘দেখ আসমানে ফোটে সেতারার কলি,
আরশির মত নিটোল পানিতে মুখ দেখে বকাওলি”
[বা’র দরিয়া]
* “হে মাঝি তোমার সেতারা নেভেনি এ -কথা জানোতো তুমি,
তোমার চাঁদনি রাতের স্বপ্ন দেখেছে এ মরুভূিম,”
[সাত-সাগরের মাঝি]
“তোমাকে মুশতারি তারা জীবনে দেখছি যতবার
জেগেছি বিস্ময়ে তত। প্রথম শৈশব দিন থেকে”
[ মুশ্তারি সেতারা]
* “মুশতারি সিতারা জ্বলে শতাব্দীর নিরন্ধ্র তিমিরে,”
[ সাম্পান মাঝির গান]
বিশুদ্ধ সাহিত্যরস মানবিক অনুভূতি বা চিত্তের অন্যবিধ আহার্যের চাইতেও বেশি কিছু ফররুখর কাছ থেকে সংগ্রহ করেছে এদেশের মুসলিম সমাজ। কবির সৃষ্টি জল সিঞ্চন করেছে আমাদর রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক ও স্বদেশিকতার চেতনার শিকড়ে। ঐতিহ্য সচেতন ইসলামী পুনর্জাগরণের কবি যে ভাবে পুঁথি ও প্রাচীন আরবী এতিহ্য আত্মস্ত করে আধুনিক চিন্তার আলোকে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সাহিত্য নির্মাণ করেছেন তা ফররুখ উত্তর -সুরিদের জন্য আলোক বর্তিকা হিসেবে কাজ করবে।
কবি ফররুখের কাব্য প্রতিভার প্রদীপ্ত ছটায় বাংলা কাব্যের দিগন্ত যেমন প্রসারিত ও আলোকিত হয়েছে, তেমন তাঁর জীবনবোধের দীপ্তি ও ঐতিহ্যানুসারিতার স্নিগ্ধ আলোয় বাংলা সাহিত্য নব জীবন ও অপূর্ব রূপ অর্জন করেছে। কবি ফররুখের ঐতিহ্য প্রীতির জয়গান গেয়ে মুহম্মদ আবদুল হাই লিখেছেন, “কবি হিসাবে তিনিও বিশিষ্টতা ও খ্যাতি অর্জন করেছেন ইসলামের ইতিহাস চেতনা ও মুসলিম জীবনাদর্শমূলক সাহিত্যের ঐতিহ্য প্রীতির জন্য। তাঁর শব্দানুশীলন, বাক্য বিন্যাস ও ভাষা ব্যবহারের রীতিতে ইসলামের অতীত যুগের চিত্র ও আদর্শ প্রতিফলিত হয়েছে। এ যুগে মুসলিম জীবন ও মানসের আদর্শ বিচ্যুতির জন্যে কবি বেদনাবোধ করেছেন। সংস্কারকামী মনের আশ্চর্য প্রতিফলন রয়েছে তাঁর শব্দ চয়ন কুশলতায়।”
রূপক-উপমা-প্রতীক-রূপকল্পের ব্যবহার কাব্যের সৌন্দর্য ও আকর্ষণ বৃদ্ধি করে। প্রাচীনকাল থেকেই এসবের ব্যবহার চলে আসছে দুনিয়ার তাবৎ সাহিত্যে। আধুনিক কবিরা এসবের ব্যবহারে অধিকতর সচেতন এবং প্রত্যেকেই তার নিজস্বতার ছাপ রাখায় সচেষ্ট। ফররুখ আহমদ এক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য প্রদর্শন করছেন। এখানে দু একটি উদাহরণ দিচ্ছি-
কেটেছে রঙিন মখমল দিন, নতুন সফর আজ,
শুনছি আবার নোনা দরিয়ায় ডাক,
ভাসে জোরওয়ার মউজের শিরে সফেদ চাঁদির তাজ,
পাহাড়-বুলন্দ ঢেউ ব’য়ে আনে নোনা দরিয়ার ডাক;
নতুন পানিতে সফর এবার, হে মাঝি সিন্দবাদ।
(সিন্দবাদঃ সাত সাগরের মাঝি)
সমুদ্র থেকে সমুদ্র ঘোরে দরিয়ায় শাদা তাজী!
খুরের হল্কা,-ধারালো দাঁড়ের আঘাতে ফুল্কি জ্বলে
সমুদ্র থেকে সমুদ্রে ঘোরে দরিয়ায় শাদা তাজী…
কেশর ফোলানো পালে লাগে হাওয়া, মাস্তুলে দোলে চাঁদ,
তারার আগুনে পথ বেছে নেয় স্বপ্নেরা সারারাত,
(সিন্দবাদঃ সাত সাগরের মাঝি)
ঐ আসে আসে সেই বিহঙ্গ সাতরঙা তার শ্বেত পাখায়,
আকাশের বুক ঘন হ’য়ে ওঠে নীল মরকত স্বচ্ছতায়,
সোনালী আলোয় শ্বাপদ রাত্রি আহত, লুপ্ত নিমেষ মাঝে;
থির-বিদ্যুৎ আভা তরঙ্গ আলোকের সুর আকাশে বাজে।
(সিরাজাম মুনীরা মুহম্মদ মুস্তফাঃ সিরাজাম মুনীরা)
আমার হৃদয় স্তব্ধ, বোবা হ’য়ে আছে বেদনায়,
যেমন পদ্মের কুঁড়ি নিরুত্তর থাকে হিমরাতে,
যেমন নিঃসঙ্গ পাখী একা আর ফেরেনা বাসাতে;
তেমনি আমার মন মুক্তি আর খোঁজেনা কথায়।
(ক্লান্তিঃ মুহূর্তের কবিতা)
ফররুখের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য সাফল্য সম্ভবত তাঁর নিজস্ব কাব্য-ভাষা নির্মাণের ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে তিনি অনেকটা নজরুলকে অনুসরণ করলেও তাঁর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলেছেন। মধ্যযুগে মুসলিম শাসনামলে রচিত সাহিত্যের ভাষাকে একসময় ‘মুসলমানী যবান’, ‘আরবি-ফারসি মিশেল ভাষা’ অথবা ‘ফারসি বাংলা’ হিসাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে অপাঙতেয় করে রাখা হলেও বাঙালি মুসলমানের সেটাই আসল ও অকৃতিম ভাষা। নজরুল সর্বপ্রথম সে ভাষাকে তাঁর কাব্যে স্থান দিলেন। এক্ষেত্রে নজরুলকে অনেকেই অনুসরণ করার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের মধ্যে ফররুখ আহমদ সর্বাধিক সফল। তিনি আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহারে অধিকতর পরিমিতি ও নৈপুণ্যের পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন। তাই তিনি তাঁর কাব্যে নিজস্ব ভাষারীতি চালু করে অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছেন। এক্ষেত্রে দু’ একটি উদাহরণ দিচ্ছি-
হাজার দ্বীপের বদ রূসমের উপরে লানত হানি’
কিশতীর মুখে ফেরায়েছি মোরা টানি-
বুরাঈর সাথে পেয়েছি ভালাই অফুরাণ জিন্দিগী,
আব্লূস-ঘন অাঁধারে পেখম খুলেছে রাতের শিখী।
আর থেকে থেকে দমকা বাতাসে নারিকেল শাখে হাওয়া
ভোলায়েছে সব পেরেশানি, শুরু হ’য়েছে গজল গাওয়া
সুরাত জামাল জওয়ানির ঠোঁটে কেটেছে স্বপ্ন রাত
শুনেছি নেশার ঘোর কেটে যেতে এসেছে নয়া প্রভাত।
(সিন্দবাদঃ সাত সাগরের মাঝি)
স্থির হও বাদশা নেকনাম। সামান্য খাদিম আমি
ইন্সানের, তবু বলি, এলাহির রেজামন্দি চেয়ে
যে হয় খিদমতগার মানুষের কিম্বা মখলুকের
হয় না সে কোন দিন খ্যাতির পূজারী। যে মুমিন,
মুজাহিদ, বিশ্বাসী যে, হয় না সে আনত কখনো;
হয় না সে নতশির আল্লা ছাড়া অন্য কারো কাছে।
যদি সে প্রলুব্ধ হয় ধ্বংস করে সত্তা সে নিজের,
অসত্যের ভারবাহী মরে সেই গুমরাহ্য প্রাণ
অবরুদ্ধ হয় যদি খ্যাতি, অর্থ, স্বার্থের পিঞ্জরে।
(নৌফেল ও হাতেম)
ওপরে উদ্ধৃত পঙতিমালাতে ফররুখের রূপক-উপমা-প্রতীক-রূপকল্প ব্যবহারের অভিনবত্ব ও অসাধারণ কৃতিত্ব সকলকে বিস্ময়-বিমুগ্ধ করে। তিনি রূপক-উপমা-প্রতীক-রূপকল্পের ব্যবহারে গতানুগতিক ধারা ও রীতি অনুসরণ না করে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও সৃজনশীলতার ছাপ রেখেছেন। এ সবের ব্যবহারে তিনি একাধারে প্রকৃতি সঞ্জাত, ঐতিহ্যিক ও বুদ্ধিদীপ্ত রীতির অনুসরণ করেছেন। এটা কবি হিসাবে তাঁর সাফল্যের অন্যতম প্রধান মাপকাঠি।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের কিছুদিন পরে কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন ফররুখ আহমদ। এখানে তিনি ঢাকা বেতারে ‘স্টাফ আর্টিস্ট’ হিসেবে যোগদান করেন। ঢাকা বেতারে তিনি ‘ছোটদের খেলাঘর’ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। ঢাকা বেতারে থাকাকালীন সময়ে তিনি বিভিন্ন নিবন্ধ, কবিতা ও সর্বোপরি অসংখ্য গান, হামদ, নাত, গজল লিখে রেডিওতে পরিবেশন করেছেন। সঙ্গীত বিষয়ে কবি ফররুখ আহমদের অগাধ জ্ঞান ছিল। তাঁর লিখিত গান গুলির মধ্যে কয়েকটি জনপ্রিয় গানঃ
১। দ্বীন দুনিয়ার সাথী আমার নূরনবী হয়রত —
২। শুনেছি এ বাণী পথে ঊষার, মান একতা শৃঙ্খলার।
৩। তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে, খোদা ——– ছাড়া ।
৪। চাঁদ ছিল জেগে রাতের মিনারে প্রভাতের কিনারায় ।
যুগ-চেতনা প্রত্যেক বড় কবির একটি বিশেষ লক্ষণ। যুগ-চেতনা কবির কাব্যকে ব্যাপক জনগণের নিকট অধিকতর গ্রহণযোগ্য করে তোলে। বলাবাহুল্য, কালিক ঘটনা পরম্পরার হুবহু বর্ণনাকে বলা হয় ইতিহাস, আর সে বর্ণনা যখন কবির কল্পনা ও অভিজ্ঞতার জারক রসে অভিষিক্ত হয়ে কাব্য-স্বরূপে উপস্থাপিত হয়, তখন তা হয় যথার্থ সাহিত্য। ফররুখ আহমদ প্রকৃত জীবনশিল্পী হিসেবে যুগের চঞ্চলতা ও আবেগকে ধারণ করেছেন, কিন্তু যুগের কলকণ্ঠ উচ্চারণকে তিনি সযত্নে পরিহার করেছেন। যুগ-চেতনা ও আবেগকে হৃদয়ের সূক্ষ্মতন্ত্রীতে ধারণ করে তিনি তা রূপক ও প্রতীকের মাধ্যমে রং-তুলি, সুর-ছন্দের অভিনব ব্যঞ্জনায় বর্ণাঢ্য ও কাব্যিক মহিমায় প্রকাশ করেছেন। তাঁর সমকালে সংঘটিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-৪৫), যুদ্ধজনিত পঞ্চাশের মন্বন্তরে (বাংলা ১৩৫০) লক্ষ লক্ষ নিরন্ন মানুষের করুণ মৃত্যু, ১৯৪০ সালে গৃহীত মুসলিম লীগের ‘লাহোর প্রস্তাবে’র ভিত্তিতে পাকিস্তান আন্দোলন, ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত গণভোট, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা (১৯৪৭), ভাষা আন্দোলন (১৯৪৭-১৯৫২), পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকদের শোষণ, দুর্নীতি, বৈষম্য ও আশাহত বঞ্চিত জণগণের নিদারুণ আর্তি, ১৯৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধ, লক্ষ লক্ষ জানমাল-ইজ্জতের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়, স্বাধীনতা পরবর্তী কালের ব্যাপক দুর্নীতি, অনাচার ও অরাজকতার ফলে সৃষ্ট ১৯৭৪ সনের দুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষের করুণ মৃত্যু ইত্যাদি মানবিক আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, সাফল্য ও বিপর্যয় ফররুখ কাব্যে প্রাণবন্ত রূপ লাভ করেছে। এ থেকে সুস্পষ্ট হয় যে, ফররুখ আহমদ ছিলেন একজন যুগ-সচেতন প্রকৃত জীবনশিল্পী। তাঁর রচিত ‘হে বন্য স্বপ্নেরা’, ‘সাত সাগরের মাঝি’, ‘আজাদ কর পাকিস্তান’, ‘সিরাজাম মুনীরা’, ‘কাফেলা’, ‘মুহূর্তের কবিতা’ ও বিভিন্ন ব্যঙ্গ কাব্য-কবিতায় তিনি ব্যক্তি ও সমাজের স্বপ্ন-কল্পনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও আশাভঙ্গের মর্মন্তুদ অবস্থা নিবিড় অনুষঙ্গে অন্তরঙ্গ অনুভূতির আলোয় প্রাণবন্ত করে তুলেছেন। একারণে ফররুখ আহমদকে যথার্থই একজন যুগ-সচেতন জীবনশিল্পী হিসাবে আখ্যায়িত করা চলে। এতে কবি হিসাবে তাঁর অনন্য শক্তিমত্তার পরিচয় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মুসলিম বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবি ফররুখ আহমদের সাহিত্য অনুরাগ ও কাব্যপ্রীতি অল্প বয়স কাল থেকেই লক্ষ্যণীয় এবং তাঁর আত্নপ্রকাশ ছাত্র জীবনেই পরিলক্ষিত হয়। তাঁর লেখনী যেন সদ্য প্রস্ফূটিত একটি গোলাপী পদ্ম। হান্সা হেনার মত সুরভিত করেছে জগৎ ও জীবনকে। তাঁর প্রতিটি কাব্যে ফুটে উঠেছে মানব প্রেম ও অকৃত্রিম পলস্নীপ্রীতি। ১৯৪৪ সালে কবি বেনজির আহমদের অর্থানুকূল্যে ঊনিশটি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’।
ফররুখ আহমদের বিচিত্র রচনা-সম্ভার বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি প্রধানত কবি। তাই তাঁর রচিত গ্রন্থাবলির মধ্যে কাব্যের সংখ্যাই অধিক। এছাড়া, তিনি ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক ও কিছুসংখ্যক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। অবশ্য তাঁর রচিত প্রবন্ধগুলো আজও গ্রন্থবদ্ধ হয়নি। নিচে তাঁর রচনাবলির একটি তালিকা প্রদান করা হলোঃ
গীতিকাব্যঃ সাত সগারের মাঝি (১৯৪৪), আজাদ করো পাকিস্তান (১৯৪৬), সিরাজাম মুনীরা (১৯৫২), ফররুখ আহমদের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৭০), হে বন্য স্বপ্নেরা (১৯৭৬), কাফেলা (১৯৮০),হাবেদা মরুর কাহিনী (১৯৮১), কিস্সা কাহিনী (১৯৮৪)।
সনেটঃ মুহূর্তের কবিতা (১৯৬৩), দিলরুবা (১৯৯৪), অনুস্বর (ব্যঙ্গ কবিতা)।
গানঃ রক্ত গোলাব, কাব্যগীতি।
মহাকাব্যঃ হাতেম তা’য়ী (১৯৬৬)।
কাব্যনাট্যঃ নৌফেল ও হাতেম (১৯৬১)।
গীতিনাট্যঃ আনার কলি (১৯৬৬)।
গদ্য ব্যঙ্গ নাটিকাঃ রাজ-রাজরা (১৯৪৮)।
ব্যঙ্গ কবিতাঃ ধোলাই কাব্য (ফারুক মাহমুদ সম্পাদিত) (১৯৬৩), বিসর্গ (রচনাকাল ১৯৪৬-৪৮), ঐতিহাসিক-অনৈতিহাসিক কাব্য (১৯৯১), হালকা লেখা, তস্বিরনামা, রসরঙ্গ।
অনুবাদ কাব্যঃ ইকবালের নির্বাচিত কবিতা (১৯৮০), কুরআন মঞ্জুষা, আমপারা (কুরআন শরীফের ২৯ টি সূরার অনুবাদ)।
ছোটগল্পঃ ফররুখ আহমদের গল্প (১৯৯০)
উপন্যাস ঃ সিকান্দার শা’র ঘোড়া (একটি অসম্পূর্ণ উপন্যাস)।
শিশুতোষ কাব্যঃ পাখির বাসা (১৯৬৫), হফরের ছড়া (১৯৬৮), নতুন লেখা (১৯৬৯), ছড়ার আসর-১ (১৯৭০), চিড়িয়াখানা (১৯৮০), ফুলের জলসা (১৯৮৫), মহফিল (প্রথম খন্ড ১৯৮৭), মহফিল (দ্বিতীয় খন্ড ১৯৮৭), হাল্কা লেখা, ছাড়ার আসর-২, ছাড়ার আসর-৩, সাঁঝ সকালের কিস্সা, আলোকলতা, খুশির ছড়া, মজার ছড়া, পাখির ছড়া, রং মশাল, জোর হরফের ছড়া, পড়ার শুরু, পোকামাকড়।
পাঠ্য-পুস্তুক ঃ নয়া জামাত (প্রথম ভাগ) (১৯৫০), নয়া জামাত (দ্বিতীয় ভাগ) (১৯৫০), নয়া জামাত (তৃতীয় ভাগ) (১৯৫০), নয়া জামাত (চতুর্থ ভাগ) (১৯৫০)।
এ ছাড়াও তাঁর আরো অনেক কাব্য গ্রন্থের অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি রয়েছে। কবি সাহিত্যে তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বিভিন্ন পুরস্কারে ভুষিত হয়েছেন। ১৯৬০ সালে ফররুখ আহমদ বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৬৫ সনে প্রেসিডেন্ট পদক “প্রাইড অব পারফরমেন্স” এবং ১৯৬৬ সালে পান আদমজী পুরস্কার ও ইউনেস্কো পুরস্কার। ১৯৭৭ ও ১৯৮০ সালে তাঁকে যথাক্রমে মরণোত্তর একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়।
উপরোক্ত গ্রন্থ-তালিকা থেকে ফররুখ আহমদের প্রায় ৫০টি গ্রন্থের পরিচয় পাওয়া যায়। এরমধ্যে তাঁর জীবনকালে অতি অল্পসংখ্যক গ্রন্থই প্রকাশিত হয়। তাঁর মৃত্যুর পর অধিকাংশ গ্রন্থ প্রকাশিত হলেও পান্ডুলিপি আকারে আরো কিছু গ্রন্থ থাকা অসম্ভব নয়। দুর্ভাগ্যবশত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে অল্পসংখ্যক ব্যতিত অন্য সবই দূ্রাপ্য। ফলে ফররুখের পঠন-পাঠন ও মূল্যায়ন করা অনেকটা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। তাই বাংলা সাহিত্যের এত বড় একজন কবি আমাদের অবহেলায় বর্তমানে অনেকটা বিস্মৃত হতে চলেছেন। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা এখন সময়ের অপরিহার্য দাবি।
কবি ফররুখ আহমদের ছিল অত্যাধিক কবিতা প্রীতি। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তাঁর প্রধান পরিচয় ‘কবি’। ফররুখ আহমদ কিছু সনেট রচনারও করেছেন তাঁর রচনায় ধর্মীয় ভাবধারার প্রভাব দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যের সার্থক রূপকার কবি ফররুখ আহমদের ‘হাতেম তা’য়ী’ কাব্যটি অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত এক অমূল্য সম্পদ। এখানে তিনি কবি মাইকেলকে সম্পূর্ণরূপে অনুস্মরণ করেননি। ‘হাতেম তা’য়ী’ কাব্যটিকে বাংলার অনেক কবি সাহিত্যিক ‘মহাকাব্য ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কবি এখানে পৌরাণিক উপমার আশ্রয় না নিলেও মুসলিম ঐতিহ্যের উপমা সম্ভার ভাষা ও ছন্দের মনোহারিত্বে বর্ণনা করেছেন। এ কাব্য বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। তবে ডানপন্থার প্রতি সমর্থন থাকলেও তিনি ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ছিলেন। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা ‘মধুর চেয়ে মধুর যে ভাই আমার দেশের ভাষা ’ গানটি বিশেষ প্রশংসিত হয়েছিল। এ ছাড়া আরবি ও ফারসি শব্দের প্রাচুর্য তাঁর লেখার অন্যতম বৈশিষ্ঠ্য।
ফররুখের সমগ্র রচনাবলি পর্যালোচনা করে তাঁর প্রতিভার বিশালত্ব, তাঁর রচনার বৈচিত্র্য ও বিষয়বস্তুর ব্যাপকতা সম্পর্কে সহজেই ধারণা করা চলে। ফররুখ আহমদ একজন শিল্প-সচেতন কবি। বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য বিশেষত বিশ্ববরেণ্য কবি-সাহিত্যিকদের সুবিখ্যাত সাহিত্য-কর্মের সাথে তাঁর পরিচয় ছিল। তিনি সেসব সাহিত্যের ভাব, শিল্প-কুশলতা, বর্ণনাভঙ্গী ও সাফল্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নিয়ে বাংলা ভাষায় যথার্থ শিল্প-সুন্দর সাহিত্য-সম্ভার উপহার দিয়েছেন। কিন্তু তাই বলে তিনি কখনো কাউকে অনুকরণ করেননি। যথার্থ মৌলিক প্রতিভা কখনো কাউকে অনুকরণ করে না। তবে তাঁরা উৎকৃষ্ট উদাহরণ ও অনুপ্রেরণা গ্রহণ করে থাকেন এবং শিল্প-প্রকরণগত বিভিন্ন ভঙ্গি ও দৃষ্টিকে কাজে লাগাবার প্রয়াস পান। ফররুখ আহমদ ছিলেন যথার্থ সৃষ্টিশীল মৌলিক প্রতিভার অধিকারী কবি। তিনি তাঁর ভাব-ভাষা-ব্যঞ্জনা ও আবেদনের দিক দিয়ে কাব্যের এক মহীয়ান, দীপ্তিমান, স্বতন্ত্র ভুবন নির্মাণে সক্ষম হয়েছেন। কবি হিসাবে এটা তাঁর অনন্য-উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য।
কবিতাকে তিনি ভালবাসতেন ছন্দের মহিমায়। বিংশ শতাব্দীর এই কবি ইসলামী ভাবধারার বাহক হলেও তাঁর কবিতা প্রকরণকৌশল, শব্দচয়ন এবং বাক্প্রতিমার অনন্য বৈশিষ্টে সমুজ্জ্বল। আধুনিকতার সকল লক্ষণ তাঁর কবিতায় পরিব্যাপ্ত। তাঁর কবিতায় রোমান্টিকতা থেকে আধুনিকতায় উত্তরণের ধারাবাহিকতা পরিস্ফুট। তিনি ছিলেন গদ্য ছন্দে কবিতা লেখার বিরোধী পক্ষ। তাঁর ধারণা কবিতা মানেই মানুষের মনের ছন্দবদ্ধ কথা, ভাবনার কথা। ফররুখ আহমদ শিশু মনস্তত্ব সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন। তাই শিশুদের জন্যও তিনি অনেক ছড়া, কবিতা ও গান রচনা করেছিলেন। ফররুখ আহমদ শুধু শিশু-মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন তাই নয়, শিশু কিশোরদেরকে তিনি গভীরভাবে ভালবাসতেন। ছন্দ, শব্দ, ছড়া-কবিতার মাধ্যমে শিশু-কিশোররা আনন্দ লাভের সঙ্গে সঙ্গে যাতে চরিত্রবান নাগরিক ও আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়ে উঠতে পারে, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই তিনি তাঁর বিভিন্ন ছড়া-কবিতার মধ্যে কৌশলে ছোট ছোট কথায় চমৎকার সব উপদেশ ও উৎসাহব্যঞ্জক বাণী পরিবেশন করেছেন। যেমনঃ
নতুন সফরে শুরু হোক আজ জীবন সেই,
মুক্ত প্রাণের রোশনিতে ভয়-শংকা নেই।
অথবাঃ
(মেলায় যাওয়ার ফ্যাঁকরা)
বাপ্রে সে কী ধুম ধাড়াক্কা
দিচ্ছে ধাক্কা, খাচ্ছে ধাক্কা,
গুঁতোর চোটে হয় প্রাণান্ত
হাঁপিয়ে ওঠে ক্যাবলা কাণ্ড!
লাগলো যখন বিষম তেষ্টা
ক্যাবলা করে ডাবের চেষ্টা।
তাকিয়ে দেখে পকেট সাফ,
ভিড়ের ভিতর দেয় সে লাফ।
কিংবাঃ
(চিড়িয়াখানা : চিড়িয়াখানা)
দেখতে যাবো কাজের ফাঁকে
প্রাণীর বাসা জগৎটাকে
খোদার গড়া এই দুনিয়ায়
কেউ পানিতে কেউবা ডাঙায়
কেউবা ঘোরে শূন্য হাওয়ায়
দেখি আজব চিড়িয়া খানায়।
হরিণ ঘাটা নদীর বাঁকে
দল বেঁধে ভাই হরিণ থাকে,
একটু খানি শব্দ হ’লে
হাওয়ার আগে হরিণ চলে
বিজলি আলো ঝিলিক দিয়ে,
মিলায় যেন চোখ ধাঁধিয়ে।
এভাবে ফররুখ আহমদ শিশুদের জন্য অসংখ্য ছড়া-কবিতা রচনা করেছেন। এগুলো বিষয়বস্তুর দিক থেকে যেমন বৈচিত্র্যপূর্ণ তেমনি শিশু-কিশোরদের মন-মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে সম্পূর্ণ উপযোগী। এতে তারা যেমন আনন্দ পায়, তেমনি নানা বিষয়বস্তুর আকর্ষণ তাদেরকে এগুলো পাঠ করতে উৎসাহ যোগায়। আনন্দ লাভের সাথে সাথে তারা অনেক শিক্ষণীয় বিষয়ও জানতে পারে। সার্বিক বিচারে বাংলা শিশুতোষ কাব্য রচনার ক্ষেত্রে ফররুখ আহমদের অবদান অসামান্য এবং তিনি এক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে অন্যতম শ্রেষ্ঠ।
কবি ফররুখ আহমদ তাঁর কাব্যযাত্রা শুরু করেছিলেন স্বপ্নের গান গেয়ে। আর জীবনের শেষ কবিতাটি লিখলেন, ‘স্বপ্নের অধ্যায় শেষ’ বলে। ফররুখের কবিতা, অথচ-সেখানে দরিয়ার মাঝি নেই। সাহসের তেজ নেই। স্বপ্নের মিছিল নেই। এ যেন অন্য গ্রহের, অন্য এক জাগ্রত ফররুখ। আলাদা জগতের বিষণœতায় কান্ত এক ফররুখ। ফররুখ আহমদের জীবনের শেষ কবিতাটির মধ্যে হৃদয়স্পর্শী একটি সম্পূর্ণ জলছবি আমরা পাচ্ছি। যেহেতু কবির জীবনের এটাই শেষ লেখা কবিতা, সুতরাং সম্পূর্ণ কবিতাটিই এখানে তুলে ধরছি :
১৯৭৪
[একটি আলেখ্য]
স্বপ্নের অধ্যায় শেষ। দু:স্বপ্নে র এ বন্দী শিবির
সাত কোটি মানুষের বধ্যভূমি! দেখ এ বাংলার
প্রতি গৃহে অপমৃত্যু ফেলে ছায়া তিক্ত হতাশার,
দুর্ভিক্ষের বার্তা আসে, আসে বার্তা নিরন্ধ্র রাত্রির।
বাষট্টি হাজার গ্রাম উৎকন্ঠিত, নিভৃত পল্লীর
প্রতি পথে ওঠে আজ হাহাকার তীব্র বুভূক্ষার
চোখে ভাসে চারদিকে অন্ধকার-কাল অন্ধকার;
ক্ষুধা, মৃত্যু ভাগ্য আজ স্তিমিত এ ভ্রান্ত জাতির!
এ মুহূর্তে কী উজ্জ্বল রাজধানী!Ñনতুন শহর
অতুগ্র যৌবন মদে মত্তা যেন নটিনী-চঞ্চল,
কাটায় উল্লাসে তার জীবনের উদ্দাম প্রহর।
উপচিয়া পড়ে যায় পানপাত্র ফেনিল, উচ্ছল
নির্লজ্জের রঙ্গমঞ্চে অকল্পিত বিলাসের ঘর
দু’চোখ ধাঁধানো রূপে, নগ্ন মেকী ঐশ্বর্য্যে উজ্জ্বল [রচনাকাল : ১ আষাঢ়-১৩৮১]
এই কবিতাটির মাধ্যমে মহকবি ফররুখ আহমদ আমাদের দেশের তৎকালীন পরিবেশ-পরিস্থিতির একটি উজ্জ্বল কালচিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন অত্যন্ত নিপুণভাবে। আমাদের দুর্ভাগ্য, কবিতাটি লেখার অল্প কিছুদিন পরেই [আষাঢ় : ১৩৮১; ১৯ অক্টোবর ১৯৭৪] এই অসামান্য কবি মৃত্যুবরণ করেন। সন্দেহ নেই, যতদিন যাবে, ততই কবি ফররুখ আহমদ আমাদের প্রতিদিনকার সাহিত্যের অনুষঙ্গে আরও বেশি করে উচ্চারিত হবেন। কারণ, ফররুখ আহমদ ছিলেন বড় মাপের একজন মহাকবি। যিনি তাঁর কাব্য প্রতিভায় কালকে জয় করতে পেরেছেন।
সময় ও কাল বদলে যায়, তবুও কালোত্তীর্ণ, কালজয়ী কবিতা বেঁচে থাকে অনন্তকাল। আর সেই কবিতার সাথে বেঁচে থাকেন কবিও।
ফররুখ আহমদ নিঃসন্দেহে তেমনি একজন কালজয়ী, মৌলিক মহাকবি। আমাদের সাহিত্যঅনুষঙ্গে তিনি অমর, অনিঃশেষ। প্রাচুর্য্যের মাঝে জন্মগ্রহন করা এই অভিমানী কবি চরম দারিদ্র্যতার মধ্যে চিকিৎসার অভাবে পরম পৌরষত্বের সাথে মৃত্যু বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অভাবনীয় শূন্যতা সৃষ্টি করেছে।
কবি ফররুখ আহমদ এর সমাধি বে-নজীর বাগানস্থ হিলফুল ফুজুল মসজিদে।কথা সাহিত্যিক মরহুম শাহেদ আলী ও শিশু সাহিত্যিক সাইয়েদ আতেক নকীব ভাই এর নেতৃত্বে আশির দশকে মহাকবি ফররুখ আহমেদ এই সমাধীর সাথে নতুন করে জাতিকে পরিচয় করিয়ে ছিলেন । পাঁচজন মানুষ কবিকে নিয়ে বেশী কাজ করেছেন ।তারা হলেন কবি ও সমালোচক আব্দুল মান্নান সৈয়দ, নজরুল গবেষক বিশিষ্ট আবৃতিকার শাহবুদ্দীন আহমেদ, শিশু সাহিত্যিক সাইয়েদ আতেক নকীব ভাই , অধ্যাপক আহমেদ মতিউর রহমান এবং কবি ও গীতিকার মতিউর রহমান মল্লিক ।
আমরা কি ফররুখকে ভুল বুঝছি?
নয়া প্রগতিশীলতার স্রোতে ফররুখ আহমদের তাৎপর্য মূল্যায়নে বিশাল বড় ভুল হচ্ছে। প্রায়ই পাকিস্তান ও সাম্প্রদায়িকতার এক পৈতা ঝুলিয়ে দেয়া হচ্ছে তার গলায়। অথচ বিষয়টাকে আমরা ইতিহাসের আলোয় ফেললে সত্যিকার ফররুখের মনস্তত্ত্ব ধরা যায়। তার উত্থানের সময় নিখিল ভারতে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব প্রকট। শুধু ভারতের স্বাধীনতা নয়, মুসলিম জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম অংশ চেয়েছিল স্বতন্ত্র শাসনব্যবস্থা। বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ (২০১৪) বইতে তখনকার তরুণদের মনোভাব টানতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন,
পাকিস্তান আনতে না পারলে লেখাপড়া শিখে কি করব?
তিনি আরও লেখেন,
অখণ্ড ভারতে যে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না এটা আমি মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতাম।
আনিসুজ্জামানের আত্মজীবনী কাল নিরবধিতে বলা হয়েছে, ‘আমার জ্ঞান হতে দেখি, বাড়ির সকলে পাকিস্তান চান, মুসলিম লীগকে সমর্থন করেন এবং জিন্নাহ্কে নেতা মানেন। আশপাশেও এই ভাবটাই প্রবল ছিল’। পরবর্তী সময়ের আরেক কিংবদন্তি আহমদ ছফার ভাষায়,
পাকিস্তান এবং ইসলাম নিয়ে আজকের বাংলাদেশে লেখেননি, এমন কোনো কবি-সাহিত্যিক নেই বললেই চলে। অন্য অনেকের কথা বাদ দিয়েও কবি সুফিয়া কামালের পাকিস্তান এবং জিন্নাহ্র ওপর নানা সময়ে লেখা কবিতাগুলো জড়ো করে প্রকাশ করলে সঞ্চয়িতার মতো একখানা গ্রন্থ দাঁড়াবে বলেই আমাদের ধারণা। (ফররুখ আহমদ: ব্যক্তি ও কবি, পৃষ্ঠা- ৫৩৯)
আদতে ফররুখ আহমদের অবস্থান ছিল শোষণের বিরুদ্ধে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে পুলিশের গুলি চালানোর প্রতিবাদে রেডিও পাকিস্তান থেকে তাৎক্ষণিক সব অনুষ্ঠান বন্ধ করেন তিনি। নিজে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে সবাইকে নিয়ে নেমে আসেন রাস্তায়। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের হাত থেকে পুরস্কার নিতে অস্বীকৃতি জানান। ‘হায়াতদারাজ খান’ ছদ্মনামে পাকিস্তানি শাসকচক্রের অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে রচনা করেন অসংখ্য ব্যঙ্গ কবিতা। খুব সম্ভবত তার অপরাধ, তিনি তার জনগোষ্ঠীর ভাষা আন্দোলন-পরবর্তী নতুন জাগরণকে ধরতে পারেননি।
সে যা-ই হোক, ফররুখ আহমদকে বিয়োগ করলে বাংলা সাহিত্যের দীর্ঘ এক অভিজ্ঞতাকে বিয়োগ করার মতো বোকামি হবে। বাঙালি জাতিসত্তা এবং বাংলা কবিতার অনিবার্য সংগ্রামী ইতিহাসকে বিয়োগ করা হবে। ফররুখ আহমদের প্রয়োজনীয়তা বাঙালির ইতিহাসের জন্যই। পৃথিবীর কোনো জাতিই নিশ্চয়ই নিজের সংস্কৃতির সম্পদকে ছুড়ে ফেলবে না। ফররুখ আহমদের অস্তিত্ব বাংলা সাহিত্যের সৌন্দর্য বাড়ায় বৈ কমায় না। বহু ফুলের উপস্থিতি যেমন আরো বৈচিত্যময় ও সমৃদ্ধ করে তোলে বাগানকে।
লেখক : ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম, বিশিষ্ট সমাজ সেবক ও রাজনীতিবিদ, শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক রিসার্চ ইনস্টিটিউট’র প্রতিষ্ঠিতা ।