দেশের সার্বভৌমত্ব আছে কী>>মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আছে কী? এমন প্রশ্ন এখন সবার মনে জাগের। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। সেই সরকারই প্রমাণ করছেন, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এখন কেবল পতাকার মধ্যেই সীমিত। দেশের সার্বভৌমত্বকে কোন তলানীতে নেমে গেছে তা অনুভব করি।
যে ভিসি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধির সামনে ‘জয়হিন্দ’ বলেছেন, তিনি তার চাকরিতে এখনো রয়েছেন। তাকে সরানোর ক্ষমতা সরকারের নেই। ১০ অক্টোবর ভারতীয় হানাদাররা বাংলাদেশের ভূখন্ডে ঢুকে র্যারের তিনজন সদস্য এবং তথ্য সরবরাহকারী তাদের দুইজন সদস্যকে ধরে নিয়ে গেছেন। আজ পর্যন্ত এই ব্যাপারে ভারতের বিরুদ্ধে সামান্য প্রতিবাদ করার ক্ষমতাও সরকার দেখাতে পারে নি। এমন নতজানুতা সার্বহীনতার পরিচায়ক।
শেখ হাসিনা ভারতীয় প্রভুদের ডাকে কেন বারবার দিল্লী যান এটাও বিরাট প্রশ্ন আমার কাছে। আর প্রভুরদের কেউ না কেউ প্রায় প্রতি সপ্তাহে বাংলাদেশে আসেন। এছাড়া আমাদের জায়গায় তো প্রভুদের লোকজন বসেই আছে। তারা আমাদেরকে, এমনকি শেখ হাসিনার ওপরও নজরদারি করে।
এতদসত্বেও তাকে দিল্লীর দরবারে তাকে যেতে হয় কেন? দিল্লীতে যাওয়া মানেই কিছু দিয়ে আসা। অনেকেই মনে করেন তিনি দিল্লী গিয়ে তার ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ নবায়ন করে আসেন। আর নবায়নের মাশুল হিসেবে তিনি ভারতকে একটার পর একটা স্পর্শকাতর বিষয়গুলো ভারতের কাছে সমর্পন করেন যেগুগোলের সাথে আমাদের স্বার্থ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব জড়িত। তার দিল্লী যাওয়া মানেই বাংলাদেশের একটা একটা অঙ্গ ভেঙ্গে যাওয়া কিংবা পঙ্গু হওয়া, এমনকি খোয়া যাওয়া।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো চুক্তির নামে ভারতের লিখে দেয়া দাসখতগুলো ভারত নিজের ইচ্ছেমতো লিখে দেয়। শেখ হাসিনা কিংবা তার সংশ্লিষ্ট সহশিল্পীরা সেগুলোতে স্বাক্ষর করেন। কোন চুক্তিরই পূর্ণাঙ্গ বিবরণ প্রকাশ করা হয় না কিংবা সেগুলো জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয় নি। অকেনেই মনে করেন শেখ হাসিনা শুধু ক্ষমতায় থাকার জন্য দেশকে বিক্রী করছেন। দেশটা ভারতের হাতে তুলে দিচ্ছেন। একজন মন্ত্রী কিংবা সচিবও এর প্রতিবাদ করছেন না। বরং তারা সমর্থন করছেন।
ভারতের সাথে স্বাক্ষরিত কোন চুক্তিুই চূড়ান্ত পর্যায়ে বাংলাদেশের অনুকূলে নয়। সবগুলো চুক্তিই কোন না কোনভাবে আমাদের স্বার্থ এমনকি স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে দুর্বল ও ভারতের কাছে বিকিয়ে দেয়ার পথ তৈরি করেছে। কোন দেশপ্রেমিক সরকার এই ধরনের একটি চুক্তিও করতে পারে না, যদিও শেখ হাসিনা তথাকথিত প্রতিরক্ষা চুক্তিসহ অজানা সংখ্যক দেশবিরোধী চুক্তি করেছেন। কোন দেশে এমন উদাহরণ নেই যে সরকার চাহিবামাত্র সবকিছু দিয়ে শুন্যহাতে দেশে ফিরে আসে। অংশীদারিত্বের চুক্তির অজুহাতে আমাদের সবকিছু, এমনকি ভূমি ভারতের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।
সর্বশেষ ৩ নভেম্বর দিল্লীতে প্রভুদের কাছে হাজিরা দিতে গিয়ে শেখ হাসিনা দেশঘাতী যেসব চুক্তি করেছেন তা কেমন ভয়ঙ্কর তা নিরক্ষর মানুষও বুঝেন। ক্ষমতা ও স্বার্থশিকারী মন্ত্রী বাহিনী এই জঘন্য চুক্তিগুলো মেনে নিয়েছেন। এরা নাকি স্বাধীনতার সপক্ষশক্তি। ভারতের কাছে দেশ সঁপে দেয়াই কী স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তির কাজ? তারা কী দেশবাসী নির্বোধ আর আঁন্ধা মনে করেন? ওয়ায়েদুল কাদের বলে ফেললেন শেখ হাসিনা দেশেবিরোধী কোন চুক্তি করেন না। কাদেরের এমন স্বাক্ষ্য কতোখানি মিথ্যা তা বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলো চুপ থাকলেও ভারতীয় পত্রিকায় আংশিকভাবে হলেও তা প্রকাশিত হয়েছে।
এখানে আমি ভারতীয় ইংরেজী দৈনিক ‘দ্য ডেকান র্হ্যাল্ড’এ ৬ অক্টোবর (২০১৯) প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বর্ণিত একটি প্যারা তুলে দিচ্ছি:
Bangladesh Prime Minister Sheikh Hasina’s visit to India was productive in terms of pacts signed. Six pacts were signed and three projects were inaugurated during her visit. Among the significant accords is an MoU under which Bangladesh has agreed to set up a network of 20 radar systems along its coast. This will add to India’s surveillance of its Bay of Bengal coast. In addition to preventing terrorists from entering our territory to launch attacks, improved surveillance of coastal waters wil enable India to keep an eye on Chinese naval activity in the Bay of Bengal. While India’s national security will get a boost from the coastal radar system, its energy security has been increased with the launch of a project under which Bangladesh will supply India with 3,000 tonnes of liquefied petroleum gas (LPG) per month for distribution in the Northeast. The two sides also agreed on a Standard Operating Procedure pact for India to use Bangladesh’s Chittagong and Mongla ports. With the Bangladesh-Bhutan-India-Nepal Motor Vehicles Agreement failing to take off on account of Bhutan’s failure to ratify it, Delhi and Dhaka have decided to implement the India-Bangladesh leg of this pact.
(স্বাক্ষরিত চুক্তির নিরীখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ফলপ্রসু হয়েছে। এই সফরকালে ছয়টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং তিনটি প্রকল্প উদ্বোধন করা হয়েছে। এইগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো একটি সমঝোতা স্মারক, যার অধীনে বাংলাদেশ এর সমুদ্র উপকূলব্যাপী ২০টি রাডারের জাল (নেটওয়ার্ক) স্থাপনে রাজী হয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগর ভারতের নজরদারি সাথে যুক্ত হচ্ছে। সন্ত্রাসীদের আক্রমণ চালাতে আমাদের ভূখ-ে প্রবেশ বন্ধ করার ছাড়াও উপকূলীয় সমুদ্রাঞ্চলে উন্নত নজরদারি বঙ্গোপসাগরে চীনা নৌবাহিনীর তৎপরতার ওপর চোখ রাখতে ভারতকে সক্ষম করবে। উপকূলীয় রাডার ব্যবস্থা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা আরো উন্নত করার পাশাপাশি ভারতের জ্বালানী প্রকল্প উদ্বোধন হবার ফলে ভারতের জ্বালানী নিরাপত্তা বাড়বে, যার অধীনে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিতরণের জন্য বাংলাদেশ প্রতিমাসে তিনহাজার টন তরলীকৃত পেট্রোলজাত গ্যাস সরবরাহ করবে। এছাড়াও দুইপক্ষ বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মঙ্গলা বন্দর ব্যবহারে ভারতের জন্য স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসীজার (মানসম্মত পরিচালনা কার্যপ্রণালী বিষয়ক) চুক্তিতে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল মোটরযান চলাচল চুক্তি ভুটান অনুমোদন না করার কারণে দিল্লী ও ঢাকা (চুক্তির) ভারত-বাংলাদেশ অংশকে বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।)
ওবায়েদুল কাদের বলুন এখানে কোন বিষয়টি বাংলাদেশের পক্ষে গিয়েছে। একটিও না। সবকিছুই হয়েছে ভারতের পক্ষে, ভারতের অনুকূলে, ভারতের স্বার্থে। আমাদের সমুদ্র সীমায় ভারতীয় নৌ দস্যুরাই মাছ ধরে, জাহাজ লুট করে। ভারতীয় জাহাজ বঙ্গোপসাগরে আমাদের সার্বভৌমত্ব অহরহ প্রবেশ করে । অথচ সেই ভারতকেই আমাদের ভূমিতে রাডার বসানোর অধিকার দেয়া হয়েছে, যেগুলো ভারতীয় পত্রিকা তথা সরকারী ভাষ্যানুযায়ী সম্পূর্ণ চীনবিরোধী সামরিক কাজে ব্যবহৃত হবে। রাডারগুলো সম্পূর্ণ ভারতের নিয়ন্ত্রণে ভারতীয়রা বাংলাদেশে বসে নিয়ন্ত্রণ করবে। তাহলে আমাদের সার্বভৌমত্ব কোথায়? আমাদের প্রয়োজন হলে আমরা ২০টি কেন আরো বেশি রাডার কেনার ও বসানোর ক্ষমতা রাখি। ভারতের রাডার আমাদের ভূখন্ডে কেন? চীন কিংবা আমেরিকা বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারতে ঢুকবে না। তারা তো পশ্চিম বংগ, উড়িষ্যা, কিংবা মাদ্রাজ হয়েই ঢুকতে পারে। আমাদের সাগরে নজরদারির নামে আমাদেরকে যে ঘেরাও করা হচ্ছে, তা শেখ হাসিনা এবং তার সহশিল্পীবৃন্দ কী বুঝেন না? ভারত কখন এখান থেকে চলে যাবে কী না, কখন যাবে, ইত্যাদির জবাব শেখ হাসিনারা জানেন কী না ? তবে আমার মনে হয় ভারত আর কখনোই এখান থেকে সরে যাবে না। বরং তার দখলদারিত্বকে আরো শক্ত করবে।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো এইসব রাডার কেবল চীনই নয়, এমনকি আমেরিকার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। এই দুটি দেশের কাছে আমাদের দেশের অবস্বান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। আমরা কেনো আমেরিকা বা চীনের সাথে ভারতের দ্বন্দের অংশীদার হবো ?
চারদেশীয় চুক্তির অধীনে ভারত আমাদের দেশের বুক চিরে নয়টি জায়গা দিয়ে যাতায়াত করে। কিন্তু এই চুক্তির অধীনেই ভারত আমাদেরকে নেপাল-ভূটানে যেতে দেয়া না। ওই দুটি দেশ যেনো কোনভাবেই ভারত হয়ে বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করতে না পারে তা নিশ্চিত করতে ভারত তার আশ্রিত ভুটানকে চুক্তি অনুমোদনে নিষেধ করেছে। ভুটানকে দিয়ে যুক্তি দেখানো হয়েছে তা মোটেই গ্রহণযোগ্য। ভূটানের যে অংশে দিয়ে যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ, তার বিকল্প সড়কের সড়ক ব্যবহারের কোন উদ্যোগ নেয়া হয় নি। নেপালের সাথেও আমাদের যাতায়াতের সুযোগ দিচ্ছে না। এই অবস্থায় এইচুক্তি আপনাআপনি মৃত। এই অজুহাতে বাংলাদেশ ওই চুক্তিকে মানার কোন সুযোগ নেই। ভারতীয় ধূর্তরা এই ফাঁকটি বুঝে । আমি নিজেও এই ফাঁক ব্যবহার করে এই চুক্তি হতে বের হয়ে ভারতকে বাংলাদেশ ভূখন্ড ব্যবহার করার সুযোগ না দেয়ার জন্য একাধিকবার লিখেছিলাম। এখন ভারত সেই ফাঁক বন্ধ করতে শেখ হাসিনার এই সফরকালে ওই চুক্তির ভারত-বাংলাদেশ অংশকে জায়েজ করে নেয়। হায়রে প্রধামন্ত্রী? হায়রে দেশপ্রেম? হায়রে ক্ষমতা? দেশের বুঝি কোন মূল্যই নেই? ক্ষমতায় থাকার বিনিময়ে কী দেশ?
একান্তভাবেই আমাদের নদ ফেণী। এর সাথে ভারতের কোন সম্পৃক্ততা নেই। ভারত এর ওপরও দখলদারিত্ব নিয়েছে। বিনিময়ে কিছুই পায় নি। শেখ হাসিনার ব্যাখ্যা: কেউ খাবারের জন্য পানি চাইলে কী করে না দেই। তিনি কতো মহানুভব? ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীর পানি হতে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করার সময় তার এই মানবতার কথা বলার মুখ কোথায় থাকে? তিনি আমাদেরকে একেবারেই শিশু মনে করেন। ভারতের হয়ে কথা বলার জন্য নানা ধরনের অভিনয় করতে আজগুবি যুক্তি দিতে তিনি লজ্জাবোধ করেন না। তার মধ্যে দেশের জন্য সামান্যতম মমত্ববোধও নেই। তার দেশপ্রেম মুখে বাস্তবে নয়, বাস্তবে ক্ষমতাপ্রেম।
ওবায়েদুল কাদেররা এখন বলুন ‘শেখ হাসিনা দেশবিরোধী কোন চুক্তি করেন না’ – আপনাদের এই দাবি কতোখানি সত্যি? কেবল ক্ষমতার জন্য পদের জন্য মিথ্যা বলছেন।
শেখ হাসিনা তার ক্ষমতা রক্ষার জন্য দেশের অস্তিত্বকে ভারতে হাতে কতো জঘন্যভাবে তুলে দিচ্ছেন, তার সর্বশেষ নজির এই জঘন্য চুক্তিগুলো। আর আপনারা ওইসব চুক্তিকে জায়েজ করার জন্য গলাবাজি করছেন। আপনারা রামায়ন পড়লেও আপনাদের উদ্দেশ্য পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত উল্লেখ করছি: “তোমরা সত্যকে মিথ্যা দিয়ে আড়াল করো না এবং জেনেশুনে সত্য গোপন করো না।” (সুরা বাকারা: আয়াত: ৪২)
এখন আপনারই ঠিক করবেন পার্থিব স্বার্থে সত্য-মিথ্যাকে একত্রিত করবেন কী না, কিংবা সত্যকে গোপন করবেন কী না।*
রচনাকাল: ১৫ অক্টোবর, ২০১৯