নিজেরে করিতে গৌরবদান >>মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন
‘নিজেরে করিতে গৌরবদান নিজেরে করি কেবলই অপমান’ গীতাঞ্জলী কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা তথা গানের পঙতি । বাংলাদেশের বিতর্কিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রভুদেশ ভারতসহ বিভিন্ন দেশ সফরে গিয়ে অবহেলা ও তাচ্ছিলে পড়েন তা দেখেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওই পঙক্তিটি স্মরণে আসে। তিনি কী নিজেকে কিংবা আমাদেরকে গৌরবাম্ভিত করতে গিয়ে নিজেকে এবং আমাদেরকে আমাদের দেশকে অপমানিত করছেন?
শেখ হাসিনার সর্বশেষ (২২ নভেম্বর, ২০১৯) প্রভুদেশ সফরের সময় মোদি সরকারের তাচ্ছিল্যমূলক আচরণ এই নিবন্ধের উৎস। ওই সফরে শেখ হাসিনাকে কেমন হেয় করা হয় তা ভারতীয় আনন্দবাজারসহ অন্যান্য প্রচার মাধ্যম প্রতিবাদের আদলে পরিবেশন করে। আনন্দবাজারের ২৪ নভেম্বরের প্রতিবেদনের অংশবিশেষ ছিল এমন:
“প্রধানমন্ত্রী (মোদি)’র আমন্ত্রণে কলকাতায় এলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। কিন্তু তাঁকে স্বাগত জানাতে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে কোনও মন্ত্রী, এমনকি শীর্ষ আমলাকেও পাঠানো হয়নি। যা কি না বাঁধাধরা কূটনৈতিক প্রথা এবং সৌজন্যের বিরোধী। কেন এমন উদাসীনতা প্রদর্শন, সে বিষয়ে সরকারি ভাবে মুখ খুলতে চাইছে না সাউথ ব্লক। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের খবর, ঘরোয়া রাজনীতির বাধ্যবাধকতাই কারণ। —– কিন্তু সিনিয়র কোনও আমলাকেও কেন কলকাতায় পাঠায়নি মোদী সরকার, তা নিয়ে চুপ সাউথ ব্লক’এর কর্তারা।”
আনন্দবাজার আরো লিখেছে: “বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক যে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে, বিভিন্ন মঞ্চে এ কথা বার বার বলেছেন খোদ মোদী। পাকিস্তান সীমান্তের ওপার থেকে আসা জঙ্গিপনায় ভারত যখন চাপে, সেই সময় হাসিনা প্রতিশ্রুুতি দিয়েছিলেন যে বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারত-বিরোধী সন্ত্রাস উৎখাত করবেন। সে কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। প্রতিবেশীদের মধ্যে একমাত্র ঢাকাকেই বিভিন্ন চড়াই উতরাইয়ে পাশে পেয়েছে দিল্লী। সম্প্রতি ভারতের অনুরোধে ঢাকা তাদের দেশের ভিতর দিয়ে আসাম-ত্রিপুরায় পণ্য পরিবহণের জন্য ‘ফি’ এক ধাক্কায় টন প্রতি ১০৫৪ টাকা থেকে কমিয়ে করেছে ১৯২ টাকায়। এমন ‘পরম মিত্রের’ ভারত সফরে দিল্লীর এই উদাসীনতা কেন, সে প্রশ্ন উঠেছে।”
“ —– বাংলাদেশের সফরকারী রাষ্ট্রপ্রধানের (আসলে সরকার প্রধান) সঙ্গে দিল্লীর এমন শীতল ব্যবহারে অবাক অনেকেই।”
সর্বশেষ ভারত সফরের সময় প্রভুদেশ শেখ হাসিনার সাথে যে আচরণ করেছে এমনটি এর আগে বাংলাদেশের অন্যকোন প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতিদের ক্ষেত্রে হয় নি। কেবল ভারত নয় শেখ হাসিনা অনেক দেশ সফরের সময়ই এই ধরনের ঘটনা ঘটে।
কেন এমনটি হয়? সমাজতাত্তিক বিশেষজ্ঞদের মতে যদি আমরা আমাদের স্বত্বা ও অস্তিত্ব কারো কাছে বিলিয়ে দেই, নিজের দুর্বলতা অন্যের কাছে প্রকাশ করি কিংবা স্বার্থসিদ্ধিও জন্য কারো মুখাপেক্ষী হই, কিংবা আমাদেরকে কেউ তাদের সমপক্ষীয় মনে না করে অথবা আমাদের কাছে প্রতিপক্ষের কোনভাবেই ঠেকা না থাকলে, সর্বোপরি কারো কাছে অতিমাত্রায় দায়বদ্ধ থাকলে আমরা এই ধরনের আচরণের মুখে পড়তে পারি। কোন নিকট আত্মীয়ও কারণে অকারণে ঘন ঘন আমাদের বাড়িতে মেহমান হয়ে আসলে এক সময় আমরা তার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। তাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করি না, এবং যতোদিন থাকে আন্তরিকভাবে মিশি না। হাসিনার সাথে ভারতের এমন তাচ্ছিল্য তথা অপমানজনক আচরণের পেছনে উপরোক্ত সবগুলো কারণই বিদ্যমান বলে বিজ্ঞজনরা মনে করেন।
শেখ হাসিনা প্রায়ই রাষ্ট্রীয় সফরে বিদেশে যান। বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম তার সফরকে রাষ্ট্রীয় সফর হিসেবে প্রচার করলেও সেগুলো বাস্তবে কতোখানি রাষ্ট্রীয় সফর তা নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে। কারণ প্রায়ই দেখা যায় কথিত রাষ্ট্রীয় সফরের অনেকগুলোতেই সংশ্লিস্ট দেশের রাষ্ট্র কিংবা সরকার প্রধান, এমনকি তাদের প্রতিনিধিরাও শেখ হাসিনাকে বিমানবন্দরে এসে স্বাগত জানান না। স্বাগত জানান আমাদের রাষ্ট্রদূত। সফরগুলো রাষ্ট্রীয় সফর হলে আমাদের রাষ্ট্রদূত তাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানানোর কথা নয়।
শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় সফরের নামে কাতার, কুয়েত, সৌদি আরব গেলেও তাকে অনেক সময়ই রাষ্ট্রপ্রধানরা বিমানবন্দরে এসে স্বাগত জানান না। ভুটানের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রীকেও লালগালিছা বিছিয়ে স্বাগত জানাতে শেখ হাসিনা বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন। অথচ কলিকাতায় নামলে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানান কলিকাতার মেয়র, আমাদের দূত এবং সৌরভ গাঙ্গুলি। এমনকি মমতা বন্দোপাধ্যায়ও আসেন নি। দাওয়াতদাতাদের মধ্যে মেদিও ছিলেন। হায়রে রাষ্ট্রীয় সফর।
এমন অবমাননাকর অবস্থার জন্য অনেকেই শেখ হাসিনারকেই দায়ী করেন। তাদের মতে শেখ হাসিনা প্রায়ই বিদেশ সফরে যান। কোন অজুহাত হলেও হলো। যেইসব অনুষ্ঠানে বিশ্বের অন্যকোন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা সরকার প্রধানরা আসেন না সে ধরনের অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা গিয়ে হাজির হন। যেমন পরিবেশ কিংবা জলবায়ু সংক্রান্ত সম্মেলনে পরিবেশমন্ত্রীকে পাঠানোই য্ুিক্তসংগত সেখানে শেখ হাসিনা হাজির হন। দুবাই এয়ারশো’তে শেখ হাসিনা ছাড়া অন্যকোন দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না। ওই প্রদর্শনীতে সবিচ বড়জোর মন্ত্রী গেলেও। কেউ না গেলেও চলতো।
তাদের আপত্তি ক্রিকেট খেলা দেখতে একজন ক্রিকেটারের, এমনকি মোদির দাওয়াতে কলিকাতা যাওয়া একেবারেই ছেলে-মানুষী কাজ। তিনি দাওয়াত প্রত্যাখান করে ক্রিকেট কন্ট্রোলবোর্ডের সভাপতি, কিংবা বড়জোড় ক্রীড়ামন্ত্রীকেও তার প্রতিনিধি হিসেবে পাঠাতে পারতেন। কিন্তু প্রচার-পাগল এবং ‘সবকিছু আমিই করবো’ এমন ব্যারামে আক্রান্ত হাসিনা কেউ যেকোনভাবে ঢাক দিলেই হাজির হয়ে যান।
মাত্র একমাস আগে (অক্টোবরে) সরাসরি সরকার সফরে ভারতে গেলে শেখ হাসিনার সাথে একই আচরণ করা হয়। আনন্দবাজার জানায় শেখ হাসিনা বিমানে নয়াদিল্লীতে তাকে “অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত ছিলেন নারী ও শিশু কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরী। হাসিনার সফরসঙ্গী নেতারা ঘরোয়া ভাবে জানিয়েছিলেন, এটা ‘যেচে অপমান নেওয়া’। প্রতিবেশী বলয়ে ভারতের ‘পরম মিত্র’ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানাতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে বা কোনও সিনিয়র ক্যাবিনেট মন্ত্রী উপস্থিত থাকবেন এটাই ছিল প্রত্যাশা।”
অথচ এই সফরের সময় শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সর্বনাশ করে সমুদ্রবন্দর, আমাদের উপকূলীয় অঞ্চল ব্যবহারের, আমাদের নিজস্ব ফেণী নদী থেকে পানি তুলে নেয়ার অধিকার দিয়ে ভারতের সাথে সাতটি সমঝোতা স্মারক তথা চুক্তি করেন। কিন্তু ভারতের কাছ থেকে কিছুই আনতে পারেন নি। তিনি অপমানে বিধ্বস্ত হলেও ভারতকে ‘চাওয়ামাত্র’ দান করতে কার্পণ্য করেন না।
শেখ হাসিনা কী বুঝেন না, ভারত তাকে কতোখানি অপমান করে? আর আমাদের দেশ কতোভাবে পরাজিত হয়? তারপরেও ভারত তার ভাষায় আমাদের ‘অকৃত্রিম বন্ধু’। তার সাথে সাথে দিল্লী গিয়েছেন, এমন আমলা তার নিজের অভিজ্ঞতা এবং পূর্বসুরীদের বরাতে জানিয়েছেন: শেখ হাসিনা ভারতের আচরণে কিল খেয়ে কিল হজম করেন। একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যে ধরনের সম্মান ও সৌজন্যতা পাওয়া উচিত পর্দার আড়ালে শেখ হাসিনার বেলায় অনেক সময়য়েই তা’ও জোটে না। অনেক সময় তাকে ধমক দিতেও ভারতের কোন কোন মন্ত্রী দ্বিধা করেন নি। তার কথা শেষ হবার আগেই থামিয়ে দেয়া হয়। তার সাথে বিকট শব্দে কথা বলা হয়। বিশেষত ভারত যা চায় তাতে আপত্তি করলে কিংবা গড়িমসি করলে চোখ রাঙিয়ে কথা বলা হয় – যেন প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক। বন্ধুত্ব শুধু প্রচার মাধ্যমে। পুরাটা সফর জুড়েই শেখ হাসিনা ¤্রয়িমান থাকেন। শুধু ছবি তোলার সময় তাকে হাস্যোজ্জ্বল দেখা যায়। আমরা যা অনুভব করি হয়তো তার চেয়েও বেশি বাজে আচরণ করা হয় তথাকথিত রুদ্ধদ্বার, অর্থাৎ শেখ হাসিনার সাথে একাকী বৈঠকে। শেখ হাসিনাকে কখনোই রুদ্ধদ্বার বৈঠক থেকে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বের হতে দেখা যায় নি।
রুদ্ধদ্বার বৈঠক থেকে এমন মলিন চেহারা নিয়ে বেরিয়ে আসার পিছনে কী কারণ থাকতে পারে জানতে চাইলে শেখ হাসিনার ওই সফরসঙ্গী বলেন: অবশ্যই মনোকষ্ট – হয়তো শেখ হাসিনা ভারতকে যেসব ছাড় দিতে চান নি, ভারত তা দিতে তাকে বাধ্য করায়। আর যা তিনি চান ভারত তা না পাওয়ায়। তিনি বলেন, ভারত শেখ হাসিনার সব দুর্বলতা বুঝে। শেখ হাসিনার পায়ের নীচে যে মাটি নেই তা’ তাকে ধমক দিয়ে শুনিয়ে দেয়া হয়। এমন খোঁটাও দেয়া হয়: ভারতের সমর্থন না পেলে শেখ হাসিনা জিন্দেগীতেও ক্ষমতার মুখ দেখ তো না। এমন ইঙ্গিত দেয়া হয়: ভারত যা বলে তা শুনতে হবে, না হলে সরতে হবে।
শেখ হাসিনার ক্ষমতা দখলের এবং দেশ শাসনের প্রক্রিয়ার আমি তীব্র বিরোধী। কিন্তু তাকে ছোট করা মানে আমাদের দেশকে আমাদের জাতি আর অস্তিত্বকে ছোট করা। এটা আমার জাত্যভিমানে স্বদেশপ্রেমকে আহত করে। অথচ শেখ হাসিনা এগুলো নীরবে হজম করেন কেবল ক্ষমতার তাগিদে।
শেখ হাসিনার এমন অবস্থা পড়ে প্রয়াত স্বাধীন সিকিমের ভারতীয় চর লেন্দুপ দর্জির কথা মনে পড়ে। সিকিমের অস্তিত্ব ভারতের হাতে তুলে দেয়ার বিনিময়ে ভারত তাকে পাঁচ বছরের জন্য তাকে সিকিমের ক্ষমতায় রাখে। এরপর ভারত লেন্দুপ দর্জির কোন খবর রাখে নি। ভারতের আচরণে ক্ষুদ্ধ হয়ে দেশঘাতক লেন্দু দর্জি মৃত্যুর আগে আক্ষেপ করে বলেছিলেন: সিকিমের রাজতন্ত্রীবিরোধী আন্দোলন করার সময় দিল্লীর দাওয়াতে গেলে লালগালিছা সংবর্ধনা দেয়া হতো । প্রধানমন্ত্রী বিমানবন্দরে অপেক্ষা করতেন স্বাগত জানানোর জন্য। আর এখন ভারতের তৃতীয় সারির রাজনীতিকরাও আমার খবর নিতে আসে না।
কারণ লেন্দুপকে ব্যবহার করে সিকিম দখলের পর তার প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়। তাই তাকে থুতুর মতো ফেলে দেয়াই ছিল ভারতের কাজ। শেখ হাসিনার সাথে ভারতের এমন অসৌজন্যমূলক আচরণ কী ইশারা করছে যে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় এনে এবং রেখে তার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রায় সবকিছুই নেয়া শেষ হয়ে গেছে? এখন কী কেবল বাংলাদেশ দখলের প্রকাশ্য ঘোষণই বাকি ? তাই তার সাথে এমন আচরণ? *
রচনাকাল: ২৬ নভেম্বর, ২০১৬
সৌজন্যে: রানার নিউজ