চালনী বলে সুই …………>> মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন
‘চালনী বলে সুই তোমার কেন ছিদ্র’ এই প্রবাদ সমাজের ক্ষমতাবানরা ক্ষমতাহীনদের কীভাবে অপরাধীর কাঠগড়ায় তা দেখিয়ে দেয়। চালনী যদি একটি ছেঁদার জন্য সুই’এর নিন্দা করে তবে কেমন শুনায়? সুই’র মাত্র একটি আর চালনীর বহুসংখ্যক, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে অসংখ্য ছেঁদা। চালনীর যদি বিবেকবোধ থাকতো তবে একটিমাত্র ছিদ্র থাকার জন্য সুইকে খোটা দেয়া কিংবা সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকতো। চালনীই ছোট হয়ে যেতো। চালনী হাসির সামগ্রীতে পরিণত হতো। সমাজে এমন কিছু লোক রয়েছেন যারা নিজের গুরু দোষ সম্পূর্ণ অস্বীকার করে অন্যের লঘু দোষ বলে বেড়ায়।
৫ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সরকারী উকিলের ব্যর্থতার কারণে কারারুদ্ধ সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি’র মরণাপন্ন চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের শুনানী পিছিয়ে দেয়ায় বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা আশাহত হয়ে প্রধান বিচারপতির কক্ষে অবস্থানে করে শ্লোগান দেয়ায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক যেভাষায় বিএনপি’কে ধমক দিয়েছেন তার প্রেক্ষিতেই চালনী-সুই প্রবাদের কথা মনে পড়ে। বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা যা করেছেন তা সমর্থন করি না। কিন্তু আইনমন্ত্রীর এমন বক্তব্য আইনসম্মত হলেও তিনি কিংবা তার দলের কারোর মুখেই আইন রক্ষার জন্য এমন বক্তব্য তথা ধমক মানায় না। কারণ তারাই বাংলাদেশে এমন, এমনকি এরচেয়ে জঘন্য অপসংস্কৃতির প্রবর্তক।
আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানকে অপমান বা অবমাননা করতে সরকার দেবে না। কারণ দেশের জনগণকে নিরাপত্তা দেয়া ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব। যারাই এরকম আচরণ করবে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে সরকার বাধ্য হবে।’
আইনমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের সাথে আওয়ামী লীগের অতীত ইতিহাসের কোন মিল নেই, বরং সম্পূর্ণ বিপরীত। বাংলাদেশে হাসিনার রাজত্বে আদৌ আইনের শাসন আছে কী? মানুষের জীবনের মানইজ্জতের সম্পদের নিরাপত্তা বলতে কিছু আছে কী? তাহলে আইনমন্ত্রী কোন জনগণকে নিরাপত্তা দিয়েছেন। বরং সরকার, এমনকি তাদের দলীয় নেতাকর্মীরাই প্রতিদিন আইনবিরোধী কাজে লিপ্ত হয়। সারা দুনিয়ার মানুষ জানেন: খোদ সরকারই জনগণের প্রতিপক্ষে পরিণত হয়েছে। তারা জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।
‘জনগণকে নিরাপত্তা দেয়া ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি’ কোন তলানীতে নেমেছে সেই খতিয়ান তো আইনমন্ত্রীদের কাছেই আছে। স্বচ্ছতা প্রমাণের জন্য আইনমন্ত্রী তাদের হালআমলের খুন, গুম, ক্রসফারারে নামে বিনা বিচারে খুন, চলন্ত বাস-কিংবা ট্রাকের নিচে ফেলে খুন, গুপ্ত হত্যা, উধাও, মিথ্যা ও সাজানো মামলা, হুলিয়া, গ্রেফতার, রিমান্ডের নামে অত্যাচার, চাঁদাবাজি, রাহাজানি, নদী-পুকুর-সরকারী জমি দখল, ব্যাংক-শেয়ারবাজার ডাকাতি, পেঁয়াজ চুরি, ঘুষ-দুর্নীতি, দেশের সম্পদ দেশের বাইরে পাচার, সর্বক্ষেত্রে দলীয়করণ, সরকারী কর্মচারী-কর্মকর্তাদের চড়্-থাপ্পড়-অপমান, দলীয় ক্যাডার ও ভারতীয় নাগরিকদেরকে দিয়ে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষকে জিম্মী করা থেকে শুরু করে নারী-নির্যাতন, ধর্ষণ, গণ-ধর্ষণ, ধর্ষণোত্তর খুন, অবৈধ সন্তান জন্মানোর পরিবেশ তৈরি, অবৈধ গর্ভপাতসহ হাজারো আইনবিরোধী অপকর্মের পরিসংখ্যান প্রকাশ করুন। এই ধরনের হাজারো অপরাধের আইনবিরোধী কাজের কোন বিচারই হয় নি, হচ্ছে না। বরং দলীয় অপরাধীদের বিরুদ্ধে রুজুকৃত সাড়ে আট হাজারের বেশী মামলা আইনমন্ত্রীরা তুলে নিয়েছেন। অথচ বিরোধীদলের বিরুদ্ধে সব মামলা সচল রেখে আরো নতুন নতুন মামলা দায়ের করেছেন। এই হচ্ছে আইনের প্রতি বিচারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থকার নমুনা। তারা অতি পবিত্র কথিত তুলসী পাতা।
বিএনপি বিচারকের কক্ষে অবস্থান করে শ্লোগান দেয়ার পরেই আইনমন্ত্রীর মনে পড়েছে ‘বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানকে অপমান বা অবমাননা করতে সরকার দেবে না’ এবং ‘জনগণকে নিরাপত্তা দেয়া ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব।’ কিন্তু তারাই জনগণের সাথে কেমন আচরণ করছেন আর করেছেন তার ভুক্তভোগীরা এখনো জীবিত। সেইসব আইনবিরোধ, শাসনতন্ত্রবিরোধী, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিরোধী অপকর্মের করুণ কাহিনী আইনমন্ত্রীরা কী মনে করেন মানুষ ভুলে গেছেন?
বিরোধীদলে থাকাকালীন অওয়ামী লীগ আদালত কিংবা বিচারকদের প্রতি কেমন সৌজন্যতা দেখিয়েছে আইনমন্ত্রীর তা ভুলে যাবার কথা নয়। নতুন প্রজন্ম ছাড়া এইদেশের জীবিত সব মানুষই আদালত ও বিচারকদের সাথে আইনমন্ত্রীদের আচরণে সাক্ষী। তারা দেশের প্রচলিত আইনকে যেভাবে অপমান ও অমান্য করেছেন লিখতে হলে বেশ সময় নিয়ে বিরাট ইতিহাস লিখতে হবে। আওয়ামী লীগ অতীতে যা করেছে তার সাথে বিএনপি’র ৫ ডিসেম্বরের অসমর্থনযোগ্য আদালতে বসে থাকা কিংবা শ্লোগানের কোন তুলনাই হয় না।
আদালত ও বিচারপতিদের ‘অপমান বা অবমাননা’ আইনমন্ত্রী সহ্য করবেন না, তা-ই প্রত্যাশিত। কিন্তু আওয়ামী লীগ অতীতে, এমনকি এই মেয়াদেও আদালত ও বিচারপতিদের সাথে যে আচরণ করেছেন তা কী ‘অপমান বা অবমাননা’র মধ্যে পড়ে না? বর্তমান প্রজন্ম আইনমন্ত্রীর দলের সেইসব মহান কাজের কাহিনী জানেন না।
বেগম জিয়া সরকারের প্রথম মেয়াদে জনৈক আওয়ামীপন্থী আইনজীবী (নাম লিখছি না) তৎকালীন প্রধান বিচারপতির দরজায় যে লাথি মেরেছিল তা কী আদালত ও বিচারপতিদের ‘অপমান বা অবমাননা’র মধ্যে পড়ে না ? সেই ঘটনা বর্তমান আইনমন্ত্রী অবশ্যই জানেন। ১৯৯৬ সনে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা ওই আইনজীবীকে হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ করে প্রধান বিচারপতির দরজায় লাথি মারার জন্য পুরস্কৃত করেছিলেন। আর আইনমন্ত্রী এটাও জানেন সুপ্রীমকোর্টের সামনের মাঠে বস্তিবাসীদেরকে ঢুকিয়েছিল কারা।
বিচারপতির অপরাধ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদকালীন চাওয়া-পাওয়া অনুযায়ী বিচারপতিরা বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের কারারুদ্ধ না করায় তিনি ক্ষুব্ধ হন। তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন: আমরা সন্ত্রাসীদের ধরি আর আদালত তাদেরকে ছেড়ে দেয়। বিচারপতিদের ওপর চাপ তথা ভয় সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই সময়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ হাইকোর্টের ভিতরে ঢুকে বিচারকদের বিরুদ্ধে লাটি মিছিল করেছিল। তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ বিচারপতিদের উদ্দেশ্যে বলেছেন: কোথায় লাঠি মারতে হয়, আওয়ামী লীগ তা জানে ।
তৎকালীন এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আদালত ও বিচারক বিরুদ্ধে একাধিকবার অগ্রহণযোগ্য মন্তব্য করেন, যা কোন প্রধানমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা সাধারণ মানুষের কাছেও প্রত্যাশিত নয়। শেখ হাসিনার ওইসব আদালত ও বিচারকবিরোধী মন্তব্য কী আদলতকে অপমান ও অবমাননার পর্যায়ে ছিল না ? বিজ্ঞ আদালত শেখ হাসিনার এতদসংক্রান্ত বক্তব্য ও মন্তব্য পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করে ‘রং-হেডেড লেডি’ বলে আখ্যায়িত করেন। বর্তমান আইনমন্ত্রী এইসবই জানেন।
এই তো সেই দিন আওয়ামী লীগ তাদেরই নিয়োগকৃত প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্রকুমার সিন্হা’কে কীভাবে কেবল বলপ্রয়োগ ও জীবনের ভয় দেখিয়ে পদত্যাগে তথা দেশত্যাগে বাধ্য করে তা’ নতুন প্রজন্মও জানেন। কারণ সিনহা’র কোন কোন পর্যবেক্ষণ তথা রায় আওয়ামী লীগের বিপক্ষে গিয়েছিল। তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলেছেন তার সরকারী বাসভবনে কোন কোন বাহিনীর দায়িত্বসম্পন্ন ব্যক্তি ঢুকে তার সাথে অসাদাচরণ করে। তাকে মারধর করার অভিযোগও তিনি করেন। তখনো তিনি প্রধান বিচারপতি। তার আত্মজীবনীতেও তিনি এই ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতির সাথে আওয়ামী লীগের এমন আচরণ ‘বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানকে অপমান বা অবমাননা’ আইনমন্ত্রী কীভাবে সহ্য করলেন? তখন তো তাকে নীরব থাকতে দেখেছি।
আওয়ামী লীগের বেআইনী অপকর্মের ধরন ও ব্যাপকতাকে স্মরণ করে তাদের মুখ বন্ধ রাখা উচিত। তারা মনে বলতে চাইছেন: আমরা যা করেছি, অন্যদেরকে তা করতে দেবো না। আমি মনেপ্রাণে চাই এমন সংস্কৃতি বন্ধ হওয়া জরুরী। কিন্তু আওয়ামী লীগ আজ ক্ষমতা হারিয়ে বিরোধীদলে গেলে আগামীকাল আরো বেপরোয়া হয়ে আইনবিরোধী কাজে লিপ্ত হবেন। তারা তো দেশের কোন আইনই মানেন না। তাদের ইচ্ছা আর চাওয়া-পাওয়াই আইন। এমনটি তারা অতীতেও করেছেন। বিদ্যুত লাইন কাটা, বিদ্যুৎ বিতরণ কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে ভাঙ্চুর করা, রেললাইন উপড়ে রেল যোগাযোগ বিঘিœত করা, সড়ক-মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ করা, সড়কের পাশের গাছপালা উপড়ে ফেলা, হরতালের দিন পায়ে হেঁটে অফিসে যাবার সময় অফিসগামী বয়স্ক অফিসারের জামা-কাপড় খুলে প্রকাশ্য রাস্তায় ন্যাংটা করে বসিয়ে রাখা, অবরোধের নামে ঢাকাসহ সারা দেশের শহরগুলোকে অচল করা, পুলিশের ওপর মহিলাদের উড়ন্ত লাথি মারা, অফিস- গার্মেন্টস ফ্যাকরী-দোকানে হামলা চালানো, গাড়ি ভাঙ্চুর, ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় সম্পদহানি, প্রতিপক্ষের যুবককে বিনা কারণে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা, এমনকি বঙ্গভবনের বিদ্যুত-পানি-গ্যাসলাইন কেটে দেয়ার হুমকি দেয়া কিংবা বঙ্গভবনকে কাসিমবাজার কুঠি (ওবায়েদুল কাদের) বলে ধিকৃত করা ইত্যাদি কী ‘বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানকে অপমান বা অবমাননা’ কিংবা আইন-শৃঙ্খলা পরিপন্থী নয়? দেশের সম্পদ ধ্বংসও নয়? পুশিল দেখামাত্রই রাস্তায় শুয়ে পড়ে পুলিশী অত্যাচারের অভিনয় করা মতিয়া-সাহারারা কোন দলের? আইনমন্ত্রী কী তাদেরকে চিনেন না? এদেরকে কোন বিচার হয়েছে? এদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা তুলে নিল কারা? এরা কী আইনের উর্ধ্বে?
আইনমন্ত্রীর ধমকে মনে হচ্ছে কেবল বিরোধী দলকে কোণঠাসা তথা নির্মূল করার জন্যই আইন। বিরোধীদলকে রাস্তায় নির্বিঘেœ মিছিল করতে না দেয়া কিংব সভা-সমাবেশ করতে না দেয়া, ঘরে বসে থাকলেও বায়বীয় অভিযোগে ভাঙ্চুরের আগুন জ্বালানোর অভিযোগে মামলা গ্রেফতার কিংবা কারারুদ্ধ, কিংবা জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া করা কী গণতন্ত্র, আইন এবং সংবিধানবিরোধী নয়? এতো ধরনের গণতন্ত্র, সংবিধান ও আইনবিরোধী অপকর্মের নজির স্থাপন করার দলের আইনমন্ত্রী প্রধান বিচারপতির দপ্তরে বসে থাকা কিংবা শ্লোগান দেয়া সমর্থনযোগ্য না হলেও তাদেরকে আইন রক্ষার জন্য আইনমন্ত্রীর ধমক কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আগে আইনমন্ত্রীরা দেখান তারা তারা আইন, সংবিধান, নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা, গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, সবার সম-অধিকার নিশ্চিত না করে বিএনপিকে ধমক দিলে সেই ‘চালনী বলে সুই তোমার কেন ছিদ্র’ প্রবাদকে সামনে নিয়ে আসে। নিজে দোষ করে অপরাধ করে মানুষ মেরে অন্যকে ছবক দেয়া কিংবা ধমক দেয়া কোনভাবে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় না। আইনমন্ত্রী নিজেও এই বাস্তবতা যে বুঝেন না, তা নয়।*
রচনাকাল: ১০ ডিসেম্বর, ২০১৯
সৌজন্যে: রানার নিউজ