বেগম খালেদা জিয়াঃ “আগুনের পরশমণি”
ফজলে এলাহী: বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ১৯৯১-৯৬ শাসনামলে হুমায়ূন আহমেদের একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বেগম জিয়া ছিলেন হুমায়ূনের একজন গুণগ্রাহী। হুমায়ূন আহমেদ এটা জানতেন। এ বিষয়ের ওপর কয়েকটি তথ্য দিতে চাই –
ঘটনা ১) ১৯৯৩ সালে জাসাস নেতা কবি আব্দুল হাই শিকদার তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘কথামালা’ নামে একটি সাহিত্য-সংস্কৃতিনির্ভর ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান নির্মাণ করতেন। । ৫০ মিনিটের প্রোগ্রাম, মাসে একবার প্রচার হতো। আব্দুল হাই শিকদার হুমায়ুন আহমেদের উপর একটা ডকুমেন্টারি নির্মাণ করে “কথামালা” অনুষ্ঠানে প্রচার করতে চাচ্ছিলেন কিন্তু বিটিভি কর্তৃপক্ষ জীবিত একজন মানুষের উপর ৫০ মিনিটের ডকুমেন্টারি প্রচারের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন।
শিকদার সাহেব গেলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি মরহুম মোজাম্মেল হক তখন প্রেস সচিব। তাকে গিয়ে বললেন তিনি নিজেও হুমায়ূনের মুগ্ধ পাঠক ছিলেন। প্রেস সচিব নিয়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সব শুনে বললেন, হুমায়ূন আহমেদের মতো একজন অসাধারণ গুণী লেখকের জন্য ৫০ মিনিটের একটা ম্যাগাজিন করা আর এমন বেশি কী? করুন।
নানা দৌড়ঝাঁপ করে ২০ দিনের মধ্যে নির্মাণ হলো ডকুমেন্টারির কাজ। ১৯৯৩ সাল, ৯ মার্চ প্রচার হলো যথারীতি ‘কথামালা : হুমায়ূন পর্ব’, হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে নির্মিত ও প্রচারিত বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ম্যাগাজিন।
ঘটিনা ২) হুমায়ূন আহমেদ তখন ‘আগুনের পরশমণি’ নির্মাণ নিয়ে মেতে উঠেছেন। সরকারি অনুদানের জন্য আবেদন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ছবি। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিষয়টা জেনে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাকে বলে দিলেন ” যদি একটা ছবিকেও অনুদান দিতে হয় তাহলেও সেটা যেন হুমায়ূন আহমেদের ছবিকে দেয়া হয়।” ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা সানন্দে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পালন করলেন।
ঘটনা ৩) সরকারি অনুদানের পরিমাণ সে সময় ছিল মাত্র সর্বনিম্ন ১৮ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ২৪ লাখ টাকার আর্থিক অনুদান। হুমায়ূন আহমেদ ছবি নিয়ে মাঠে নেমে গেলেন। দরকার সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনীর সাহায্য। কারণ মুক্তিযুদ্ধের ছবি, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাজার হাজার সদস্য, ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া যান ইত্যাদি না হলে চলবে কেন? সে ব্যবস্থা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তার মিলিটারি সেক্রেটারি আজকের আওয়ামী লীগের এমপি মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূইয়া করে দিলেন।
ঘটনা ৪) হুমায়ুন আহমেদের ” আগুনের পরশমণি ” নির্মাণ শেষ। এফডিসিতে বকেয়া পড়ে গেছে ২০ লাখের ওপর টাকা। আবারও এগিয়ে এলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। বেগম খালেদা জিয়া তথ্য মন্ত্রী নাজমুল হুদাকে ফোন দিয়ে বললেন ” ছবি বানাচ্ছেন হুমায়ূনের মতো নন্দিত কথাশিল্পীর, ছবিটার উপজীব্য মুক্তিযুদ্ধ। এ ছবি তো পুরোটাই রাষ্ট্রের টাকায় হওয়ার কথা। “.. ব্যস এফডিসির পুরো পাওনা মওকুফ হয়ে গেল।
ঘটনা ৫) ” আগুনের পরশমণি ” রিলিজের আগেই ছবি নিয়ে হৈ চৈ পড়ে গেল সর্বত্র। প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে উৎসাহ দেখালেন। হুমায়ূনও চাইলেন ছবিটা প্রধানমন্ত্রীকে দেখাবেন। তড়িঘড়ি ব্যবস্থা হলো। দ্রুত ডিএফপি’র ছোট প্রেক্ষাগৃহটির মেশিনপত্র, প্রজেক্টর, স্ক্রিন ঝাড়-পোছ হলো। বেগম খালেদা জিয়া হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে ছবিটা দেখলেন। ছবির শেষে উপস্থিত সবাই দেখলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া চোখ মুছছেন।
সে বছর আগুনের পরশমণি ৮টি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেল। আমার আনন্দ ধরে না। সহায় হলেন তত্কালীন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপিকা জাহানারা বেগম ও মরহুম মোজাম্মেল হক। প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের গলায় পরিয়ে দিলেন ‘একুশে পদক’। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান।
মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে উপরের তথ্যগুলো এজন্য দিলাম যে আজকের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বঘোষিত এজেন্ট ও তাদের চাটুকাররা হয়তো জানেন না যে এই মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সহযোগিতা করে গেছেন চেতনাবাদিদের কাছে তথাকথিত ”মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি” হিসেবে নিন্দিত ও পরিচিত বাংলাদেশ জাতীয়তবাদী দল বা বেগম খালেদা জিয়ার সরকার। সেদিন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এগিয়ে না এলে হুমায়ুন আহমেদের স্বপ্নের চলচ্চিত্র ” আগুনের পরশমণি ” নির্মাণ হতো না এবং আমরাও সেদিন হুমায়ুন আহমেদকে চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে পেতাম না। হুমায়ুন আহমেদ তাঁর জীবদ্দশায় ”আগুনের পরশমণি” সিনেমার জন্য বেগম খালেদা জিয়ার অবদান স্বীকার করে স্মৃতিচারণ করেছিলেন।
নির্মানের পরবর্তি মুক্তির পর জাতীয় চলচ্চিত্রের পুরস্কারে ১৯৯৪ সালের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র শাখায় হুমায়ুন আহমেদের ”আগুনের পরশমণি” যৌথভাবে কাজী হায়াতের ”দেশপ্রেমিক” চলচ্চিত্রের সাথে পুরস্কার অর্জন করেছিলো। এছাড়াও সেবছর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে হুমায়ুন আহমেদ (শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার ও সংলাপ রচয়িতা), বিপাশা হায়াত (শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী), শিলা আহমেদ (শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী), সত্য সাহা (শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক), মফিজুল হক (শ্রেষ্ঠ শব্দগ্রাহক) ”আগুনের পরশমণি”র জন্য জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেছিলেন ।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে ১৯৯৪ সালে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবর্তী পটভুমির উপর নির্মিত শহীদুল ইসলাম খোকনের ‘ঘাতক’ ও ‘কমান্ডার’ সিনেমা দুটোও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছিলো ।
১৯৯৪ সালের জাতীয় পুরস্কারে মুলত হুমায়ুন আহমেদের ”আগুনের পরশমণি” ও কাজী হায়াতে ”দেশপ্রেমিক” চলচ্চিত্র দুটোর মধ্যই সর্বাধিক পুরস্কারের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয় । আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে যে কাজী হায়াতের ”দেশপ্রেমিক” সিনেমাটির গল্পের বক্তব্য মুলত সরকারের তথ্যমন্ত্রণালয় ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডের বিপক্ষে চলে যায় যা আজকের রাস্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় নির্মাণ একেবারেই অসম্ভব কিন্তু সবাইকে বিস্মিত করে তৎকালীন গণতান্ত্রিক সরকারের প্রধান বেগম খালেদা জিয়া নিজহাতে ”দেশপ্রেমিক” সিনেমাটিকে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার সহ কাজী হায়াত, আলমগীরকেও পুরস্কার প্রদান করেছিলেন। ”দেশপ্রেমিক” সিনেমাটিকে পুরস্কৃত করে বেগম খালেদা জিয়া বা বিএনপির সরকার মুলত গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতাকেই স্বীকৃত দিয়েছিলেন যা আজ কেউ কল্পনাও করতে পারবে না।
কথা প্রসঙ্গে আরেকটি ছোট্ট তথ্য দেই বা যা না দিলে পাঠকদের সাথে অন্যায় করা হবে। ১৯৯৪ সালে নির্মিত শহীদুল ইসলাম খোকনের জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত ”ঘাতক” সিনেমাটি মুক্তির আগেই তৎকালীন সময়ের দর্শক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলেছিলো। তৎকালীন সময়ের বিরোধী দল ও আজকের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলিগের সাথে জোটবদ্ধ থাকা বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী ”ঘাতক” সিনেমাটি নিষিদ্ধ বা মুক্তি না দেয়ার দাবী জানিয়েছিলো যে দাবীর পক্ষে সমর্থন দিয়েছিলো আওয়ামীলীগ। তৎকালীন বিএনপি সরকার সেই দাবী অগ্রাহ্য করে ”ঘাতক” সিনেমাটি কোন রকম কর্তন ছাড়াই নির্দিষ্টদিনে মুক্তি দেয়ার অনুমতি দেয়। এতে জামায়াত ইসলামী আরও ক্ষুব্ধ হয়ে সারাদেশের সিনেমা হলগুলোর যেখানে যেখানে ”ঘাতক” সিনেমাটি প্রদর্শিত হবে সেখানেই হামলা করে প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়। সেই ঘোষণাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বিএনপি সরকার সারাদেশে যেসকল সিনেমাহলে ”ঘাতক” সিনেমাটি প্রদর্শিত হবে সবগুলো হলে পুলিশের চেকপোস্ট বসিয়ে দর্শকদের নিরাপত্তা প্রদান করে এবং সকল হুমকি ধমকিকে ব্যর্থ করে সারাদেশে ”ঘাতক” সিনেমাটি দেখার জন্য সববয়সি দর্শকদের ঢল নামে। পরিচালক শহিদুল ইসলাম খোকন সরকারের এই সহযোগিতার প্রশংসা করে বলেছিলেন ” স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটিয়ে আমরা সত্যি সত্যি এক গণতান্ত্রিক সরকার পেয়েছি যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান শর্তকে যথাযথভাবে মুল্যায়ন করছেন। এই ধারা অব্যহত থাকলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি আগামীতে আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে এবং বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ঠাই করে নিবে”।
যাই হোক, আগুনের পরশমণি সিনেমা নিয়ে বলতে গিয়ে অনেক কথাই বলে ফেললাম যে সত্যগুলো আজকের প্রজন্ম জানে না বলেই দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সম্পর্কে গত ১২ বছর ধরে চলা অনবরত মিথ্যা প্রোপাগান্ডাগুলোকে সত্য ভেবে ভুল ধারণা পোষণ করে। শহীদ রাস্ট্রপতি জিয়াউর রহমান , দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপির মতো মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি বাংলাদেশের আরও কোন শাসক ছিলোনা ও আসেওনি। যে আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো তার অন্যতম শর্ত ছিলো জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার যা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ব্যতীত আর কখনও কোন সরকার মেনে চলেনি।।
#ফজলে #এলাহী