একজন মাহমুদুর রহমান ও কিছু প্রশ্ন ?
গত দশ বছরে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি যার চাষ হয়েছে তা হলো ‘বিভাজন’ আর ‘ঘৃনা’। এই বিভাজন করা হয়েছে সুপরিকল্পিতভাবে; করা হয়েছে নানা রঙে নানান ঢঙে। কখনো বলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, বিপক্ষের শক্তি, চেতনার পক্ষের বা বিপক্ষের শক্তি, আস্তিক কিংবা নাস্তিক আবার কখনো জামাত শিবিরের ট্যাগ। বিষয়টা শেষমেষ এমন দাঁড়িয়েছে যে আপনি যদি গণতন্ত্রের কথা বলেন, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, সুশাসন, ন্যায্যতা, মানবিক মর্যাদা বা সামাজিক ন্যায়বিচারের দাবী তোলেন, সরকারের পাহাড়সম দুর্নিতী বা লুটপাট নিয়ে প্রশ্ন করেন আপনি তাহলে নিশ্চিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি, রাজাকার এবং পরিত্যাজ্য।
অর্থাৎ দেশের স্বার্থে কথা বলা, সরকারের যেকোন যৌক্তিক সমালোচনা কিংবা আরও সহজ করে বললে আওয়ামেলীগের যে কোন অপকর্মের আলোচনা এখন নিজেকে রাজাকার ঘোষনার শামিল।
এ অবস্থা একদিনে তৈরি হয়নি। এই শয়তানি খুব ধীরে মননে মগজে ছডিয়ে দেয়া হয়েছে মানুষের। আর জামাত শিবির ট্যাগটা আরও ইন্টারেস্টিং। বিষয়টা এখন এমন দাঁড়িয়েছে, যে কাউকে জামাতশিবির নাম দিয়ে হত্যা করা যায়, কোপানো যায়, হাতুড়ি দিয়ে হাড্ডি গুড়োগুডো করা যায়।
যে কোন নৃশংসতা জায়েজ হয়ে যায় যদি কোন ভাবে ছডিয়ে দেয়া যায় আক্রান্ত ব্যক্তিটি জামাত শিবিরের সমর্থক। আপনার ক্ষমতা নেই জামাতশিবিরের নেতা, কর্মী, সমর্থকদের নাগরিকত্ব বাতিল করেন। এমন কি দল হিসাবে জামাত নিষিদ্ধের শক্তিও আপনি রাখেননা। উল্টো মনে মনে আশা রাখেন কোন একদিন হয়তো জামাত আপনাদের সাথে একত্রিত হবে, যেমন যুগপৎ নাম দিয়ে হয়েছিল ৯৬ সালে। অথচ প্রতি পদে পদে মানুষের গনতন্ত্রিক, সাংবিধানিক এবং মৌলিক অধিকারগুলো দিব্যি হরণ করছেন এই জামাত শিশির নাম ব্যবহার করে যে অধিকার কোন ভাবেই রাষ্ট্র বা সংবিধান আপনাকে দেয়না।
যে সমাজে সবকিছু নিয়েই বিভাজনের খেলা চলে সেখানে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলায় একটি পক্ষ বিপক্ষ তৈরি হবে সেটাই স্বাভাবিক। এই বর্বরোচিত হামলায়ও একটি পক্ষ উল্লসিত হবে, সমর্থন যোগাবে এ আর বিস্মিত করেনা আমাকে। মাহমুদুর রহমান অনেকের কাছেই এক মূর্তীমান আতঙ্ক। অনেকের মুখোশ উন্মোচন করেছেন তিনি।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের সময় স্কাইপ কেলেঙ্কারি প্রকাশ করেছিলেন, জাতীয় মুক্তির ইশতেহার দিয়েছিলেন, শাহবাগের সারবত্তা তুলে এনেছিলেন, সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো তিনি ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন এবং আছেন। আমার নিজের বাড়িতে যে কথাটি শুনে আমি বড় হয়েছি, বাবার যে শ্লোগানটি এখনও কানে বাজে তা ছিল “পিন্ডি ছেড়েছি, দিল্লীর গোলামী করবো বলে নয়।” ঠিক একই ধরণের আওয়াজ আমি শুনেছি মাহমুদুর রহমানের কন্ঠে।
মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলা হয়েছে যখন তিনি কুষ্টিয়ার একটি আদালত থেকে মানহানির মামলায় জামিন নিয়ে ফিরছিলেন। হামলা হয়েছে আদালত প্রাঙ্গনে, পুলিশের উপস্হিতিতে, শত মানুষের সামনে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও ভাসছে অনেকগুলো। সেগুলো ঘাটলেই বোঝা যায় বর্ষিয়ান এই সাংবাদিকের ওপর নির্যাতনের পুরো সময়টাই পুলিশ নিরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল। অনেকটা যেন সাজানো নাটক মন্চস্থ হলো সবার সামনে। ছাত্রলীগের নৃশংস হামলায় রক্তাক্ত তিনি একা দাডিয়ে আবারও ঘোষনা দিয়েছেন তিনি একাই লড়াই করবেন। জীবন দেবেন বাংলাদেশের জন্য, ইসলামের জন্য।তিনি লড়াই করবেন ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে। তিনি নি:সঙ্কোচে বলেছেন ‘বাকি সব দিল্লীর কুকুর’। মুশকিল হলো এই পোড়ার দেশে আপনি ইসলাম ছাড়া যেকোন ধর্ম বা গোষ্ঠির সুরক্ষার জন্য সমিতি, কমিটি, সংসদ, পরিষদ যা ইচ্ছা গঠন করতে পারেন। সেটি মৌলবাদিত্ব হবেনা, ফ্যানাটিজম তো দুরের কথা। মৌলবাদ কেবল ইসলাম সুরক্ষাতেই হয়, তাইনা?
যাই হোক মূল আলোচনায় ফিরি। গনমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী গতকাল তার জামিন আবেদন শুনানী কেন্দ্র করে সকাল থেকেই ছাত্রলীগের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী আদালত এলাকায় অবস্থান নেয়। ছাত্রলীগের মহডায় জামিন পাওয়ার পরও নিরাপত্তা শঙ্কায় মাহমুদুর রহমান এজলাসেই প্রায় সাডে চার ঘন্টা অবস্থান করেন। পরে ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে পুলিশ নিরাপত্তা দিতে এলে মাহমুদুর রহমান এজলাস থেকে বের হতেই হামলার শিকার হন। এ সময় পুলিশ নিরবে দাঁড়িয়ে থাকে। মাহমুদুর রহমানের ভাষ্য মতে প্রথমে ম্যাজিষ্ট্রেট তাকে এজলাসে আশ্রয় নেবার জন্য বলেন। বিকাল সাডে তিনটা পর্যন্ত সেখানে থাকার পর ম্যাজিস্ট্রেট জানান তিনি RAB স্কোয়াডের ব্যবস্থা করছেন।
সাডে চারটার দিকে পুলিশের ওসি তাকে একটি গাড়িতে তুলে দেয়। গাড়িতে ওঠার দু মিনিটের মধ্যে ৪০ থেকে ৫০ জন বড় বড় পাথর লাঠি দা নিয়ে হামলা চালায়। গাড়ির কাঁচ ভেঙে মাহমুদুর রহমানের মাথায় তিন চারটা পাথর দিয়ে আঘাত করে তারপর লাঠি দিয়ে বাড়ি দেয়, রড দিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে। এসময় ড্রাইভার ও আরোহী একজন আইনজীবীও মারধরের শিকার হন। পরে তিনি এক আইনজীবীর চেম্বারে আশ্রয় নিলে আধাঘন্টা পর পুলিশ আসে।
এই ঘটনায় যে প্রশ্নগুলো স্বাভাবিক ভাবেই উঠে আসে তা হলো-
(১) নানাবিধ বিতর্কের পরও যে আদালতকে মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল বলে ধরা হয় সে আদালতে এমন নৃশংস ঘটনা ঘটলো কি করে?
(২) পুলিশ নিরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল কার নির্দেশে?
(৩) দেশে যখন খুশি তখন যে কোন অপকর্ম করার লাইসেন্স ছাত্রলীগকে কে দিয়েছে?
(৪) কোন মহাশক্তির ইশারায় ছাত্রলীগ সকল ক্ষেত্রে দায়মুক্তি লাভ করে?
(৫) বর্ষিয়ান প্রথিতযশা এই সাংবাদিকের ওপর আক্রমণ কি বাকস্বাধীনতা ও ভিন্ন মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ নয়?
(৬) আদালত কতৃক জামিন লাভের পরও যখন আদালত প্রাঙ্গনে পুলিশ প্রশাসনের সামনে এধরনের ঘটনা ঘটে তখন কি তাকে আদালতের ওপর আক্রমণ বলেই ধরা উচিত
ফ্যাসিজমের কিছু বৈশিষ্ট আছে।
ক) উগ্র জাতীয়তাবাদ তার অন্যতম। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে সরকার ও জনগন উভয়ই জাতীয়তাবাদী গান, চিহ্ন বা শ্লোগান নিয়ে মুখর থাকে হালে যেটা ‘চেতনা’র নামে বাংলাদেশে হয়।
খ) মানবাধিকারের প্রতি অবজ্ঞা, এই সব রাষ্ট্রে মানুষ বিশ্বাস করে একটু আধটু মানবাধিকার লঙ্ঘন তেমন বড় কিছু নয়, বরং কারাবন্দীদের প্রতি অত্যাচার, নির্যাতন বা হত্যার মত বিষয়েও তারা কোন উচ্চবাচ্য করেনা বরং এক ধরনের নিরব সমর্থন থাকে। যার প্রকাশ আমরা বাংলাদেশে দেখেছি জঙ্গী বা মাদক দমনের নামে বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে।
গ) কমন শত্রু তৈরি করা এবং সকল সমস্যার জন্য তাদের দায়ী করা। বাংলাদেশে বিষয়টি এমন পর্যায় গেছে যে বিল্ডিং ধ্বসে পড়ার জন্যও এক সময় বিরোধি দলকে দায়ী করা হয়েছিল।
ঘ) সেনাবাহিনীকে প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব দান।
ঙ) লিঙ্গ বৈষম্যকে লালন পালন।
চ) নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম বাংলাদেশে যার প্রকাশ ঘটে ৫৭ ধারা বা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মধ্য দিয়ে। চলে সেল্ফ সেন্সরশীপ। ৯০ শতাংশ গনমাধ্যমের মালিকানা বা নীতিনির্ধারকের আসনে আছে সরকার দলীয় ব্যক্তি।গনমাধ্যম এখন সরকারপন্থী ভাষ্যকার ও দলীয় মুখপাত্রদের দখলে।
ছ) জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে আহাজারি
জ) ধর্ম ও রাষ্ট্রের মাখামাখি
ঝ) কর্পোরেটদের নিরাপত্তা যা আমরা দেখি বড় বড় কর্পোরেট ঋণ খেলাপীদের নতুন নতুন সুবিধা দানের মধ্য দিয়ে, শেয়ার কেলেঙ্কারী বা পরিবেশ বিধ্বংসী রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বা রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের মাধ্যমে।
জ্ঞ) শ্রমিকদের ক্ষমতা সীমিতকরণ। সরকার সকল প্রকার শ্রমিক আন্দোলন দমন করে এবং শ্রমিক ইউনিয়নও হয় নিয়ন্ত্রনের মধ্যে থেকে।
ট) বুদ্ধিজীবীতা ও শিল্পকর্মের প্রতি অবজ্ঞা এখানে দেখা যায় বিভিন্ন সময়ে সরকার প্রধানের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। গৃহপালিত বুদ্ধিজীবী হয়েও ‘ডাস্টবিন’, ‘use me’ বা ‘গাধা’ উপাধি থেকে রেহাই পায়নি কেউ।
ঠ) অপরাধ ও শাস্তির মাত্রাধিক আগ্রহ দেখা যায় এখানে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জবাবদিহিতাহীন ভাবে ক্ষমতা ভোগ করে। তাদের হাতে বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ড এখানে নিত্য দিনের ঘটনা। বিচারের নামে হত্যা, গুম, ধর্ষন, পঙ্গু করা সবই চলে।
ড) অবাধ স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি। এ নিয়ে এতবার এত কথা বলা হয়েছে যে এ লেখায় নতুন করে আর বলবার কিছু নেই। মেগা প্রজেক্ট মেগা দুর্নিতী, লক্ষ কোটি টাকা পাচার, মন্দ ঋণের চাপে ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি, পুকুর চুরি না সাগর চুরি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক লুট, ছিল সোনা হলো তামা এসবেই অভ্যস্ত আমরা।
ঢ) নির্বাচনে কারচুপি। গত কয়েক বছরে পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থা এতটাই ধ্বসে পড়েছে যে কারচুপি শব্দটি এখানে খুব হালকা হয়ে যায়।
একটি প্রমানিত ফ্যাসিবাদি রাষ্ট্রে মাহমুদুর রহমানের সাথে যা ঘটেছে সেটাই স্বাভাবিক। বরং এর ব্যত্যয় হলেই অবাক হতাম আমি। এ ধরনের রাষ্ট্র থেকে উদার গনতন্ত্রিক রাষ্ট্রে উত্তোরনের দায় কেবল কোন নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠির নয়। আপাত সুবিধার লোভে যারা আজ চুপ থাকছে কিংবা মিনেমিনে শব্দে কিন্তু, যদি, তবুও ভাষায় হাল্কা বিরোধিতা করছে তারা কেউই কিন্তু নিরাপদ নয়। বুঝে বা না বুঝে যারা এই ‘হাজার বছরের ঐতিহ্য’, ‘প্রপাগান্ডা’কে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন তারা কেউ দায় এড়াতে পারবেনা।
লেখকঃ
ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা,
সহ-আন্তর্জাতিক সম্পাদক,
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল।