সড়ক দুর্ঘটনাঃ ছাত্ররা জাতির কাছে নিরাপত্তা চায় -মোশাররফ হোসেন মুসা
সড়ক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে যে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন গড়ে ওঠেছে তাকে এক কথায় নজিরবিহীন ও অভূতপূর্ব বলা যায়। এ আন্দোলনকে কোনে ক্রমেই রাজনৈতিক আন্দোলন বলা চলে না, কারণ সড়ক পথ দিয়ে সকলকেই যাতায়াত করতে হয়। একইভাবে সকল পর্যায়ের মানুষকে বাস-ট্রাক ব্যবহার করতে হয়। সেজন্য এ আন্দোলনকে সর্বদলীয় আন্দোলন বলাই যুক্তিযুক্ত হবে। গত ২৮ জুলাই দুই বাসের চাপায় পড়ে শহীদ রফিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুইজন শিক্ষার্থী মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করে। এই দুঃখজনক ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকা শহরের সমস্ত স্কুলের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। ফলে ঢাকা কার্যত অচল হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে তারা ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করা শুরু করে। এমনকি তারা একজন মন্ত্রীসহ কয়েকজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার গাড়ি থামিয়ে লাইসেন্স পরীক্ষা করে। যাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই তাদেরকে পুলিশে সোপর্দ করে। পুলিশ তাদের কথামতো মামলা গ্রহণ করে। আন্দোলনের পঞ্চম দিনে তারা ৯দফা দাবী উত্থাপন করে। এই ৯ দফা দাবীর মধ্যে রয়েছে- বেপরোয়া চালকদের শাস্তির ব্যবস্থা করা, নৌপরিবহন মন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার সহ ক্ষমা প্রার্থনা করা, শিক্ষার্থীদের চলাচলে এমইএস ফুট ওভার ব্রিজ বা বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া, প্রতিটি দুর্ঘটনা প্রবণ এলাকায় স্পিড ব্রেকার নির্মাণ করা, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্র-ছাত্রীদের দায়ভার নেওয়া, সারা দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করা, ফিটনেস বিহীন গাড়ি ও লাইসেন্স বিহীন চালকদের গাড়ি চালনা বন্ধ করা এবং অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া বন্ধ করা। সরকারও তাদের দাবী মেনে নিয়েছে এবং বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে। নৌপরিবহন মন্ত্রী তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছেন এবং নিহতদের বাসায় গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী নিহত দুই শিক্ষার্থীর পিতা-মাতাকে ডেকে এনে প্রতি পরিবারকে ২০ লক্ষ টাকা করে পারিবারিক সঞ্চয়পত্র প্রদান করেছেন। ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, যে বিষয়গুলো রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে দীর্ঘদিন উপেক্ষিত ছিল তা কোমলমতি শিক্ষার্থীরা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এতদিন বলা হত বর্তমান শিক্ষার্থীরা ব্রয়লার পদ্ধতিতে মানুষ হচ্ছে, সেজন্য তারা দেশের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে সজাগ নয়। কিন্তু প্লাকার্ডের লেখাগুলো সেটা প্রমাণ করে না। যেমন-‘বিবেক তবে কবে ফিরবে’, ‘দেশ সংস্কারের কাজ চলছে’, ‘যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ/যদি তুমি রুখে দাঁড়াও তবেই তুমি বাংলাদেশ’। তাদের এই প্রতিবাদকে ক্ষোভের প্রাথমিক বহিঃপ্রকাশ বলা যায়; কিংবা রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রের অনিয়ম-দুর্নীতির পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও বলা যায়। তারা দীর্ঘদিন যাবৎ দেখে এসেছে সরকার তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। সেজন্য তারা নিজেরাই রাষ্ট্র সংস্কার করতে চায়। এটি বড়দের জন্য লজ্জারও বিষয়। এখানে বলে রাখা ভাল, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য শুধু চালক নয়, গোটা সরকার ব্যবস্থাই দায়ী। স্কেন্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে বন্য প্রাণী রাস্তা অতিক্রমের সময় গাড়ি থামিয়ে দেওয়া হয়, জাপানে শিক্ষার্থীরা রাস্তা পারাপারের সময় গাড়ি থামিয়ে দেওয়া হয়, অক্সফোর্ড শহরে সীমিত গতিতে গাড়ি চালানোর নিয়ম রয়েছে। এক জরিপ সূত্রে জানা গেছে, গত সাড়ে তিন বছরে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২৫ হাজার ১২০জন লোক মারা গেছে। অর্থাৎ প্রতিদিন ২০ জন লোকের মৃত্যু ঘটছে। এসব দুর্ঘটনা ৯০ শতাংশ চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও অতিরিক্ত গতির কারণে ঘটছে (সূত্রঃ প্রথম আলো, ৪ আগস্ট, ২০১৮)। তাছাড়া হোন্ডা, কাভার্ডসহ যাবতীয় অযান্ত্রিক পরিবহনের কারণে প্রতিদিন অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটছে। শুধু সড়ক দুর্ঘটনাই নয়, দেশের সকল ক্ষেত্রে অনিয়মের চিত্র বিদ্যমান রয়েছে। এখন বড়দের কাজ হলো গোটা সরকার ব্যবস্থা সংস্কার করার জন্য উপযুক্ত নকশা প্রস্তুত করা এবং তা বাস্তবায়ন করা। বর্তমানে ঢাকা শহরে প্রায় আড়াই কোটি লোকের বসবাস রয়েছে। প্রতি বছর পাঁচ লক্ষাধিক নতুন লোক যুক্ত হচ্ছে। অধিক জনসংখ্যার কারণে সেখানে কোনো ব্যবস্থাই কার্যকর করা সম্ভব নয়। সরকার ও বিরোধীদল কোনো পক্ষই বিকেন্দ্রিকরণ চায় না। সম্ভবত তারা মনে করে, ঢাকা শহর দখলে রাখা মানে গোটা দেশ দখলে রাখা। সরকার অধিক জনসংখ্যার বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে নতুন নতুন ফুটওভারব্রিজ, ফ্লাইওভার, মেট্টোরেল ইত্যাদি নির্মাণ করছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী এক জনসভায় বলেছেন, ঢাকার চারদিকে অনেকগুলো উপশহর গড়ে তোলা হবে। সারাদেশে বর্তমানে ৫ কোটি লোক অপরিকল্পিত নগরে বসবাস করছে। সমগ্র দেশের রাস্তাগুলো অপরিকল্পিত। রাস্তার উভয় পার্শে¦ সরকারি জায়গা দখল করে মানুষ দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করছে। হাট-বাজার রাস্তার উপর ওঠে এসেছে। জাতীয় রাস্তা ও স্থানীয় রাস্তা একাকার হয়ে পড়েছে। গ্রামে-গঞ্জে চেয়ারম্যান-মেম্বর ও প্রভাবশালীদের ইচ্ছায় অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট নির্মাণ হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে মহাবিপর্যয় ডেকে আনবে। ট্রাফিক আইন ত্র“টিপূর্ণ, দুর্নীতিগ্রস্থ বিআরটিএ ও পুলিশ-প্রশাসন, অদক্ষ ড্রাইভার ছাড়াও দায়-দায়িত্বহীন মালিক পক্ষ। সমগ্র দেশে সরকারি দলের নেতাকর্মীর ছত্রছায়ায় সড়কে চাঁদাবাজী চলছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আগামীতে সমগ্র দেশটিকে নগরে রূপান্তরিত করা হবে। আমরা জানি, গ্রামের উন্নয়ন হওয়া মানে নগরীয় সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়া। কিন্তু অপরিকল্পিত উপায়ে কোনো উন্নয়নই কাম্য নয়। সেজন্য এখনই সমগ্র দেশটিকে সংস্কার করার জন্য উপযুক্ত ডিজাইন গ্রহণ করতে হবে এবং বাস্তবায়ন করার জন্য সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক ঃ গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক।