বাংলাদেশের চলমান আন্দোলন আরব বসন্তের প্রতিচ্ছবি : আনন্দবাজার
বাংলাদেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে চলমান আন্দোলনকে আরব বসন্তের সঙ্গে তুলনা করেছে আনন্দবাজার পত্রিকা।
সোমবার পত্রিকাটির সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় এমন তুলনা করেন সম্পাদকীয়তে।
তিনি বলেন, ‘তারিখ, মাস, মরসুম অনুযায়ী এখন বর্ষাকাল। কিন্তু এ মরসুমকে বসন্তও বলা যেতে পারে। বসন্ত হল এমন এক ঋতু, যা কারণে-অকারণে, সময়ে-অসময়ে হানা দিতে পারে। তাই ফুল ফুটলেও বসন্ত হয়, না ফুটলেও হয় বসন্ত। যখন তখন হানা দেওয়া যেন অলিখিত অধিকার বসন্তের। সেই অধিকারেই বোধহয় বাংলাদেশে আজ বসন্ত।’
অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘আরব বসন্তের’ কথা আমরা সবাই কম-বেশি শুনেছি। ২০১০ সালে এ বসন্ত হানা দিয়েছিল উত্তর আফ্রিকায়, মধ্য এশিয়ায়, পশ্চিম এশিয়ায়। একের পর এক রাষ্ট্রে স্বৈরাচারী, অগণতান্ত্রিক বা ছদ্ম গণতান্ত্রিক সরকারকে ছুড়ে ফেলেছিল সে বসন্ত। যেন এক তুফানে সওয়ার হয়ে বদলের ঋতু হানা দিয়েছিল এই আরব্য প্রান্তে। তিউনিশিয়া, মিশর, লিবিয়া— একের পর এক দেশে জন আন্দোলনের তথা গণবিক্ষোভের প্রবল ঢেউ আছড়ে পড়েছিল। বদলে গিয়েছিল দেশগুলির শাসন কাঠামো, বদলে গিয়েছিল শাসকও। দশকের পর দশক ধরে স্বৈরাচারের গুমোটে হাঁসফাঁস করতে থাকা রাষ্ট্রগুলোয় চারিয়ে গিয়েছিল খোলা হাওয়া। তাই গোটা বিশ্ব বলেছিল বসন্ত এসেছে ওখানে, আরব বসন্ত।’
শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন আরব বসন্তের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, ‘আরব বসন্তের প্রতিচ্ছবি যেন আজ বাংলাদেশে। গোটা ঢাকা শহর জুড়ে যেন বাংলা বসন্ত। হাজার হাজার স্কুল পড়ুয়া পথে নেমেছে ঢাকায়। যান নিয়ন্ত্রণের ভার নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে তারা। পুলিশের গাড়ি হোক বা আধাসেনার, মন্ত্রীর গাড়ি হোক বা সরকারি কর্তার, ঢাকার রাজপথে আজ পড়ুয়াদের অঙ্গুলি নির্দেশ অনুসারে চলতে হচ্ছে প্রত্যেককে। পথ আটকে প্রত্যেক গাড়ির নথিপত্র সংক্রান্ত বৈধতা পরীক্ষা করে দেখছে রাজপথে নামা পড়ুয়ারা। কাগজপত্রে গোলমাল থাকলে গাড়ির গায়ে অবৈধতার ছাপ পড়ছে, গাড়ি তৎক্ষণাৎ পথপ্রান্তে দাঁড় করিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।’
কেন এই পরিস্থিতি তৈরি হল বাংলাদেশে? তার ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, পরিস্থিতি তৈরি হল প্রশাসনের প্রতি সাধারণ্যে বাড়তে থাকা অনাস্থা থেকে। সড়ক দুর্ঘটনা মারাত্মক চেহারা নিয়েছিল বাংলাদেশে। বেপরোয়া ড্রাইভিং, বাসে বাসে রেষারেষি, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা— নানা অভিযোগে ক্ষোভ বাড়ছিল সাধারণ্যে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা। প্রায় গোটা বাংলাদেশ বলতে শুরু করেছিল, সড়ক দুর্ঘটনা বা দুর্ঘটনায় মৃত্যু নয়, এ সব আসলে ‘সড়ক হত্যা’।
‘কারও বেপরোয়া চালচলন, কারও কর্তব্যে গাফিলতি— এর জেরেই একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে, একের পর এক মৃত্যু নেমে আসছে। বলতে শুরু করেছিলেন সাধারণ মানুষ। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটল এক অভূতপূর্ব এবং অসাধারণ ভঙ্গিতে। ছাত্র-ছাত্রীরা হাজারে হাজারে নেমে এল রাস্তায়, ঢাকার রাজপথে যান নিয়ন্ত্রণের ভার দখল করে নিল তারা। শুধু যান নিয়ন্ত্রণের ভার ছিনিয়ে নেওয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকল না ঘটনাপ্রবাহের ফলশ্রুতি।
অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে যান চলাচলের ব্যবস্থা যে ঢাকাতেও সম্ভব, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের মোকবিলাও যে অত্যন্ত কড়া হাতে করা সম্ভব, প্রশাসনের গালে সজোর চপেটাঘাত আঁকতে আঁকতে সে কথা স্পষ্ট করে দিল স্রেফ পড়ুয়ারা। ঢাকার রাজপথে আপৎকালীন পরিষেবার জন্য যে এমারজেন্সি লেন তৈরি রাখা সম্ভব, স্কুল ইউনিফর্মে রাস্তার দখল নেওয়া ছেলেমেয়েগুলো তা দেখিয়ে দিল।’
অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, বেশ কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশ এই অভিনব পরিস্থিতির সাক্ষী হল। গোটা বাংলাদেশ সর্বাত্মক ভাবে এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছে, এমন নয়। প্রশংসা, অভিভূতি এসেছে বিভিন্ন দিক থেকে। নিন্দা, বিরোধও শোনা গিয়েছে বিভিন্ন শিবিরে। কিন্তু ‘সড়ক হত্যা’র প্রতিবাদে এই অভূতপূর্ব ছাত্র আন্দোলনকে কেউ সমর্থন করুন বা না করুন, অবজ্ঞা কেউ করতে পারেননি। বাংলাদেশের এই ‘বসন্ত’ আরব বসন্তের মতো দেশের শাসন কাঠামো বদলে দিতে পারেনি। তাই আরব বসন্তের তুলনা টেনে বাংলাদেশের এই পরিস্থিতিকে ‘বাংলা বসন্ত’ নামে ডাকা যুক্তিযুক্ত কি না, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন। কিন্তু সে প্রশ্নের সপাট উত্তরও প্রস্তুত— শাসন কাঠামো বদলে দেওয়া বা সরকার ফেলে দেওয়া উদ্দেশ্যই ছিল না স্কুল ইউনিফর্মে পথে নামা এই হাজার হাজার পড়ুয়ার, উদ্দেশ্য ছিল প্রশাসন তথা সরকারের টনক নড়ানো, তা নড়েওছে।
সম্পাদকীয়তে বলা হয়, বাংলাদেশ যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হল, তার একটা ইতিবাচক দিক আছে, একটা নেতিবাচক তাৎপর্যও রয়েছে। ফেসবুকে, টুইটারে, সোশ্যাল মিডিয়ায়, ভিডিও গেমে, ইন্টারনেটে বুঁদ হতে হতে যে প্রজন্ম বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে এবং সামাজিকতা থেকে বিমুখ হয়ে পড়ছে বলে আমরা অনেকেই অভিযোগ করে থাকি, সেই প্রজন্মই ঢাকার বুকে দেখিয়ে দিল, প্রয়োজনে রাষ্ট্রকে শিক্ষা দেওয়ার ভূমিকাও পালন করতে পারে তারা। অতএব অত্যন্ত ইতিবাচক একটা ছবি তৈরি করল এই ছাত্র বিক্ষোভ।
কিন্তু বাংলাদেশের এই উত্তাল ছাত্র আন্দোলন এও বুঝিয়ে দিল যে, প্রশাসনের প্রতি তথা রাষ্ট্রের প্রতি সামূহিক অনাস্থা তৈরি হয়েছে জন সংখ্যার এক বিরাট অংশের মধ্যে। সেই তীব্র অসন্তোষের প্রতিনিধি হয়ে রাস্তায় নামতে হয়েছে স্কুল পড়ুয়াদের। যে প্রজন্ম বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ, প্রশাসন তথা রাষ্ট্রের প্রতি সেই প্রজন্মের অনাস্থা তৈরি হওয়া রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত নেতিবাচক ইঙ্গিত।
‘আবার বলি, বাংলাদেশের বেনজির ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। এ আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্ত, নাকি নেপথ্যে কোনও কায়েমি স্বার্থের উস্কানি, নানা মত রয়েছে তা নিয়ে। মত, পাল্টা মত থাকতেই পারে। বিতর্কও স্বাগত। কিন্তু প্রশাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ তুঙ্গস্পর্শী না হলে এ ভাবে গোটা দুনিয়ার নজর কেড়ে নিতে পারে না একটা ছাত্র আন্দোলন। বাংলাদেশের শাসককুলকে সতর্ক হতে হবে অতএব। এই বেনজির আন্দোলনের ইতিবাচক প্রেক্ষিতটাকে ইতিবাচক ভঙ্গিতেই বোঝার চেষ্টা করতে হবে। নেতিবাচক ইঙ্গিতগুলোর কারণ নিবারণে অবিলম্বে পদক্ষেপ করতে হবে। তাতে বাংলাদেশের মঙ্গল তো বটেই, মঙ্গল দেশটার শাসককুলেরও।’