যেকারণে ইমরানকে বেছে নিলো পাক সেনাবাহিনী
পাকিস্তানের নির্বাচনের আগে থেকে একটি অভিযোগ নিয়ে আলোচনা চলছে এবং নির্বাচনের পরও সে আলোচনা তুঙ্গে—নির্বাচনে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ছিল এবং ইমরান খানকে জেতানোর জন্যই সেটা করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন ইমরান?
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত পাকিস্তানের বয়স ৭১ ছুঁই ছুঁই। এ দীর্ঘ সময়ের অর্ধেকটাই কেটেছে সেনা শাসনে। প্রথম ৯ বছর তো পাকিস্তানে কোনো সংবিধানই ছিল না। স্বাধীনতার এক বছরের মাথায় রোগভোগে জুলফিকার আলী ভুট্টোর মৃত্যু, দীর্ঘ সময় সংবিধানহীনতা এবং এর জেরে রাজনীতিকদের অগোছালোভাবে দেশ শাসন—সব মিলিয়ে স্বাধীনতার যুগপূর্তির আগেই পাকিস্তানে সেনা অভ্যুত্থান ঘটে। দেশে সফলভাবে সেনা শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এ বাহিনী হয়ে ওঠে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। ফলে পরবর্তী সময়ে নিজেদের স্বার্থের প্রয়োজনে সব সময় সফলতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে পেরেছে তারা। সরাসরি শাসনব্যবস্থায় না থেকে এখন অবশ্য তারা আড়ালে থেকে নিয়ন্ত্রণের নীতিতে পথ চলছে।
সেনাবাহিনীর এ আচরণের ধারাবাহিকতা এবারের নির্বাচনেও ছিল যথারীতি এমনটাই মনে করেন সমালোচক ও বিশ্লেষকরা। তাঁদের অভিমত, পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) মতো দলগুলোকে হটিয়ে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) এগিয়ে যাওয়ার পেছনে রয়েছে রয়েছে সশস্ত্র বাহিনীর কারসাজি।
সাবেক ক্রিকেটার ও পিটিআই প্রধান ইমরান কেন সেনবাহিনীর পছন্দের পাত্র হয়ে উঠলেন, সে ব্যাপারে ভারতের প্রবীণ সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল প্রকাশ কাটোচ বলেন, ‘সেনাবাহিনী পিএমএল-এন কিংবা পিপিপিকে সমর্থন দেয়নি, কারণ নওয়াজ শরিফ ও আসিফ আলী জারাদারিকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে বলে ভাবা হচ্ছিল।’ এর কারণ ব্যাখ্যায় ফার্স্টপোস্টডটকমে গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত নিবন্ধে তিনি জানান, ক্ষমতায় থাকাকালে জারদারি পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টারসার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সকে (আইএসআই) স্বরাষ্ট্র দপ্তরে ডেকে জবাবদিহির মুখোমুখি করার মতো সাহস দেখিয়েছিলেন। আর নওয়াজ তো সরাসরি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে দেশে প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার দিকে ঝুঁকেছিলেন, এমনকি সীমানা শত্রু ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। ‘আর তাই ইমরান খান হচ্ছেন আইএসআইয়ের সেরা পছন্দ’ এমনটা বলেন এই ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা। তাঁর মতে, এ সমর্থন এতটাই পাকাপোক্ত যে ভোটের মাধ্যমে ইমরান পর্যাপ্ত আসন না পেলেও যেকোনোভাবে তাঁকে বেশি আসন পাইয়ে দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনী প্রস্তুত ছিল।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সব মিলিয়ে এক হাজার কোটি ডলারের বেশি মূল্যের ব্যবসা রয়েছে। সেটা নির্বিঘে চালিয়ে যাওয়া, বাহিনীর জন্য সরকারি বরাদ্দ ঠিক রেখে ভবিষ্যতে আরো বাড়িয়ে নেওয়া এবং চীন-ভারত-যুক্তরাষ্ট্রনীতিসহ গুরুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতিতে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা—এ সবকিছুর জন্য আপাত গণতান্ত্রিক সরকারে এমন এক নেতৃত্ব সেনাবাহিনীর প্রয়োজন, যার মাধ্যমে সব স্বার্থ ঠিক রাখা সম্ভব হবে। এসব বিবেচনায় ইমরানকেই বেছে নিয়েছে সশস্ত্র বাহিনী।
সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইমরানের এসব যোগসাজশের সমালোচনা করে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নাতনি ফাতিমা ভুট্টো রাখঢাক না রেখে এই পিটিআই নেতাকে ‘ক্লাউন’ অ্যাখ্যা দিয়েছেন। গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘পাকিস্তানের গণতন্ত্র এখন সার্কাসে পরিণত হয়েছে আর এ সার্কাসের আয়োজক হচ্ছে সেনাবাহিনী। ইমরান খান সেই সার্কাসের একজন খেলোয়াড়মাত্র, আর কিছু নন।’ ফাতিমা আরো লিখেছেন, ‘আমাদের সার্কাসে শক্তিশালী রিং মাস্টার আছে, আছে খাঁচাবন্দি সিংহ, এমনকি প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতাও এতে যোগ হয়েছে। এ সার্কাসের সমাপ্তির আগে শুরু হয়ে গেছে শেষ খেলা। এতে আবির্ভূত হয়েছে ক্লাউন। সাবেক ক্রিকেট তারকা ইমরান খানের রাজনৈতিক ইতিহাস শুধুই সুবিধাবাদ আর আনুগত্যের।’ দুর্নীতির দায়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে কারাবন্দি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজের অবস্থা থেকে ইমরানকে শিক্ষা নেওয়ার পরামর্শও দেন ফাতিমা। সূত্র : টাইমস অব ইন্ডিয়া, ফার্স্টপোস্ট, গার্ডিয়ান।